ঢাকা
ছোট অঙ্কের ঋণ আদায়ে একশ্রেণির ব্যাংক কর্মকর্তা আগ্রাসী আচরণ শুরু করেছেন। তাঁরা ইদানীং বিভিন্ন গ্রাহকের ওপর চড়াও হচ্ছেন। এসব ব্যাংকার গ্রাহকদের ব্যাংকে ডেকে এনে খারাপ ব্যবহার করছেন, এমনকি মারধরের ঘটনাও ঘটিয়েছেন—যার প্রমাণ মিলছে ভিডও চিত্র ও নথিপত্রে।
ব্যাংক খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঋণ আদায় না হলে গ্রাহকের সঙ্গে আলোচনা করা যায়। ঋণ একেবারে আদায় অনুপযোগী হলে কিংবা গ্রাহককে খুঁজে না পেলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু এভাবে মারধর করার এখতিয়ার বা গালিগালাজের সুযোগ ব্যাংকারদের কেউ দেয়নি। তাঁদের মতে, এ ধরনের ঘটনা পুরো ব্যাংক খাতের জন্য খারাপ উদাহরণ তৈরি করছে।
দেশের ব্যাংক খাতে ছোট গ্রাহকদের ওপর ব্যাংকারদের চড়াও হওয়ার ঘটনা অহরহই ঘটছে বলে অভিযোগ আছে। ভুক্তভোগীরাও চুপ করে থাকছেন। তবে সম্প্রতি দুটি ঘটনার বিস্তারিত খোঁজ মিলেছে। এই দুজন গ্রাহক পরিচয় প্রকাশ করে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। এর মধ্যে একটি বেসরকারি খাতের প্রাইম ব্যাংকের ও অপরটি রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের ঘটন। ঘটনা দুটির সত্যতা খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।
মারধরের পর হাসপাতালে
জানা গেছে, প্রাইম ব্যাংকের ঢাকার যাত্রাবাড়ী শাখা থেকে ২০১১ সালের অক্টোবরে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নেন নুরুল আলম ও ফাতেমা আক্তার দম্পতি। প্রতি মাসে ঋণের কিস্তি ছিল ৯০ হাজার টাকা। নুরুল আলম থাকেন সৌদি আরবে, ঋণ নেওয়ার সময় দেশে এসেছিলেন। ২০১১ থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তাঁরা ১ কোটি ৭ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। তবে করোনা শুরু হলে ঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করে দেন। এরই মধ্যে কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় সৌদি সরকার নুরুল আলমকে দেশে পাঠিয়ে দেয়। এদিকে করোনার মধ্যে প্রাইম ব্যাংকের যাত্রাবাড়ী শাখা ঋণ পরিশোধের জন্য বারবার চাপ দেয়। তবে তাঁরা কিস্তি পরিশোধ করতে পারেননি।
গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর স্ত্রী ফাতেমা আক্তার ও ছেলে ইব্রাহিম আলমকে নিয়ে প্রাইম ব্যাংকের মতিঝিলের প্রধান কার্যালয়ে যান ব্যাংকটির গ্রাহক ও সৌদি প্রবাসী নুরুল আলম। সেখানে আলোচনার একপর্যায়ে ব্যাংকটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নুরুল আলমকে মারধর করেন। এরপর অজ্ঞান হয়ে পড়লে নুরুল আলমকে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
নুরুল আলম জানান, ব্যাংক থেকে ডাকা হলে গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি তাঁর স্ত্রী ফাতেমা আক্তার ও ছেলে ইব্রাহিম আলমকে নিয়ে ব্যাংকের মতিঝিলের প্রধান কার্যালয়ে যান। সেখানে আলোচনার একপর্যায়ে ব্যাংকটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নুরুল আলমকে মারধর করেন। এরপর অজ্ঞান হয়ে পড়লে নুরুল আলমকে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে তিনি বাড়ি ফেরেন। হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, তাঁর গায়ে মারধরের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
এ ঘটনার পর নুরুল আলম ও ফাতেমা আক্তার দম্পতিকে ব্যাংকের পক্ষ থেকে আইনের আশ্রয় না নেওয়া আহ্বান জানায় এবং সুদ মওকুফের জন্য আবেদন করার মৌখিক প্রস্তাব দেয়। সেই অনুযায়ী গ্রাহক দুই দফা আবেদন করলেও ব্যাংক তা নাকচ করে দেয়।
নুরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ১৯৮৭ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সৌদি আরবে ছিলাম। সৌদি থেকে আমি ঋণের ১ কোটি ৭ লাখ টাকা পাঠিয়েছি। দেশে এসে গত ১৯ সেপ্টেম্বর পরিবার নিয়ে ব্যাংকে যাই। এ সময় ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা আপত্তিকর ভাষায় আমার স্ত্রীকে গালিগালাজ করেন। আমি প্রতিবাদ করলে আমাকে মারধর করেন। একপর্যায়ে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।’
নুরুল আলম বলেন, ‘আমি ৩৩ বছর বিদেশে ছিলাম। ব্যাংক কেন গ্রাহককে মারধর করবে। ব্যবস্থা নিতে হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নেবে। আমি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
গ্রাহক নিজেই ব্যাংকের ফ্লোরে শুয়ে পড়েন। এ ঘটনায় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সাধারণ ডায়েরি করা হয়। গ্রাহকের সঙ্গে কোনো ধরনের খারাপ আচরণ করা হয়নি, মারধরের প্রশ্নই আসে না।
হাসান ও রশীদ , ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রাইম ব্যাংক
ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা নুরুল আলমের ছেলে ইব্রাহিম আলম একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন কী হয়েছিল, ব্যাংকের সিসিটিভি ফুটেজ দেখলেই সব বের হবে। বাবাকে এমন মারধর করা হয়েছে যে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। আমি তাঁদের করজোড়ে অনুরোধ করলেও তাঁরা বাবাকে ছাড়েননি। পরে ব্যাংক কর্মকর্তারাই অ্যাম্বুলেন্স ডেকে বাবাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন।’
এ নিয়ে জানতে চাইলে প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাসান ও রশীদ বলেন, ‘ওই গ্রাহকের বক্তব্য সুবিধাজনক মনে হয়নি। একপর্যায়ে গ্রাহক নিজেই ব্যাংকের ফ্লোরে শুয়ে পড়েন। এ ঘটনায় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সাধারণ ডায়েরি করা হয়। গ্রাহকের সঙ্গে কোনো ধরনের খারাপ আচরণ করা হয়নি, মারধরের প্রশ্নই আসে না।’
জনতা ব্যাংকের কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর শাখার ব্যবস্থাপক আনন্দ চন্দ্র দাস গত বছরের ১০ অক্টোবর ঋণ গ্রহীতা স্কুলশিক্ষক মো. আবদুল কুদ্দুছকে তলব করলে তিনি গত বছরের ১০ অক্টোবর ওই শাখায় যান। ঋণ পরিশোধের বিষয়ে কথাবার্তা বলতে বলতে শাখা ব্যবস্থাপক এক সময় আবদুল কুদ্দুছকে গালিগালাজ শুরু করেন।
গালিগালাজ ও ধাক্কা
অন্য ঘটনাটি জনতা ব্যাংকের কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর শাখায় ঘটেছে। এই শাখা থেকে ২০২০ সালের জুলাইয়ে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন মো. আবদুল কুদ্দুছ নামের এক গ্রাহক। তিনি বাজিতপুর উপজেলার রাজ্জাকুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক। ঋণের মেয়াদ ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত। ঋণের প্রতি মাসের কিস্তি সাড়ে তিন হাজার টাকা। গত বছরে গ্রাহক দুটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হন। এ কারণে তাঁকে শাখাটির ব্যবস্থাপক আনন্দ চন্দ্র দাস তলব করলে তিনি গত বছরের ১০ অক্টোবর ওই শাখায় যান। ঋণ পরিশোধের বিষয়ে কথাবার্তা বলতে বলতে শাখা ব্যবস্থাপক এক সময় আবদুল কুদ্দুছকে গালিগালাজ শুরু করেন। এক ভিডিওতে শাখা ব্যবস্থাপকের গালিগালাজের ঘটনার প্রমাণ রয়েছে। একপর্যায়ে শাখা ব্যবস্থাপক ওই গ্রাহককে ধাক্কা দিয়ে ব্যাংক থেকে বের করে দেন। আবদুল কুদ্দুছের কাছে ব্যাংকের পাওনা ১০ হাজার ৩৬৪ টাকা।
ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক তাঁর কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে ব্যাংক থেকে আমাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছেন। আমার মানইজ্জতের ওপর আঘাত করেছেন। আমি এ ঘটনার বিচার চাই।
আবদুল কুদ্দুছ, গ্রাহক, জনতা ব্যাংক, বাজিতপুর শাখা
আবদুল কুদ্দুছ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষক। ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক তাঁর কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে ব্যাংক থেকে আমাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছেন। আমার মানইজ্জতের ওপর আঘাত করেছেন। আমি এ ঘটনার বিচার চাই। টাকা আদায় না হলে ব্যাংক ব্যবস্থা নেবে। এমন গালিগালাজ ও মারধর করার অধিকার ব্যাংকারদের কেউ দেয়নি।’
একজন ব্যাংকার হিসেবে এটা করা আমার ঠিক হয়নি। ভুল বুঝতে পেরে আমি তাঁর (গ্রাহক) কাছে ক্ষমাও চেয়েছি। আমি আসলে একটা ফাঁদে পা দিয়েছি, এটা ভুল হয়ে গেছে।
আনন্দ চন্দ্র দাস,শাখা ব্যবস্থাপক,জনতা ব্যাংক, বাজিতপুর শাখা
এ ঘটনার পর জনতা ব্যাংকের স্থানীয় কর্মকর্তারা বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নিলেও তাতে রাজি হননি বাজিতপুর শাখার ব্যবস্থাপক আনন্দ চন্দ্র দাস। এ বিষয়ে জানতে আনন্দ চন্দ্র দাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন,‘উনি (গ্রাহক আবদুল কুদ্দুছ) প্রথমে আমার অভিভাবকদের গালি দিয়েছেন, এরপর আমি তাঁর সঙ্গে চিৎকার করেছি। একজন ব্যাংকার হিসেবে এটা করা আমার ঠিক হয়নি। ভুল বুঝতে পেরে আমি তাঁর (গ্রাহক) কাছে ক্ষমাও চেয়েছি। আমি আসলে একটা ফাঁদে পা দিয়েছি, এটা ভুল হয়ে গেছে।’
এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুছ ছালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা দুঃখজনক ঘটনা। আমি খবর নিচ্ছি। সত্যি হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’