ব্যয় বাড়লেও রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না। ঘাটতি পূরণে দেশী-বিদেশী উৎসগুলো থেকে প্রতিনিয়ত ঋণ নিতে হচ্ছে সরকারকে। বাড়ছে সরকারের দেশী-বিদেশী উৎস থেকে নেয়া ঋণের স্থিতিও। ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে সরকারের নেয়া মোট ঋণের স্থিতি ছিল ১৩ লাখ ৪৩ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছর (২০২২-২৩) শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৩১৩ কোটি টাকায়। অর্থ বিভাগের গত মাসে প্রকাশিত ডেবট বুলেটিনের এ হিসাব অনুযায়ী গত এক অর্থবছরে সরকারের ঋণের স্থিতি বেড়েছে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা, যা এ সময় সরকারের আহরিত মোট রাজস্বের প্রায় ৮৩ শতাংশের সমপরিমাণ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আহরণ হয়েছিল ৩ লাখ ৩১ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা।
রাজস্ব ও ঋণের এ অসামঞ্জস্যতায় চাপ বাড়ছে সরকারের কোষাগারে। বাড়ছে ঋণের সুদ বাবদ পরিশোধিত অর্থের পরিমাণও। গত অর্থবছরে সরকারকে ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে এ বাবদ বরাদ্দের চেয়ে বেশি। গত অর্থবছরে বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৯০ হাজার ১৩ কোটি টাকা। যদিও পরিশোধ করতে হয়েছে ৯২ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা।
ঋণের কিস্তি পরিশোধ ও বাড়তি সুদব্যয় নির্বাহ করতে অভ্যন্তরীণের পাশাপাশি বহিস্থ উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ বাড়াতে হয়েছে সরকারকে। অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণের অর্থ পরিশোধের জন্য সরকারকে এখন নতুন করে আরো ঋণ নিতে হচ্ছে। এতে সুদসহ আনুষঙ্গিক ব্যয়ের পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকির মাত্রাও এখন বাড়ছে।
বাড়তি এ ঋণের মধ্যে বিদেশী ঋণের অবদানই সবচেয়ে বেশি। গত অর্থবছরে দেশে স্থানীয় উৎস থেকে নেয়া ঋণের স্থিতি বেড়েছে ৯৬ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। আর বিদেশী ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা। বিদেশী ঋণে নির্ভরতা বাড়ায় শঙ্কিত হয়ে উঠছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। টাকার অবমূল্যায়ন ও ডলারের সংকটজনিত কারণে এ ঝুঁকি আরো প্রকট হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজস্ব আয় বাড়াতে না পারলে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে নেয়া ঋণ এক সময় বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের বিপদের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। ঋণ-জিডিপি অনুপাত এখনো সহনীয় অবস্থানে থাকলেও এখানে ঋণ-রাজস্ব অনুপাত সমজাতীয় অর্থনীতিগুলোর তুলনায় অনেক বেশি।
অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত অর্থবছরে ঋণের পরিমাণ বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা যদি আমরা বজায় রাখতে না পারি তাহলে এটি আমাদের জন্য বিশাল বোঝা হয়ে যাবে। প্রতি বছর যদি আমাদের ঋণ বাড়তে থাকে তাহলে ঋণের চাপে আমাদের রাজস্ব হারিয়ে যাবে। যে পরিমাণ ঋণ বেড়েছে, সেটি আমাদের রাজস্ব আয়ের প্রায় সমপরিমাণ। এ বিষয়টি আমাদের ঝুঁকি কতটুকু সেটি নির্দেশ করে। আমাদের রাজস্ব অবিশ্বাস্য রকমের কম। আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে আমাদের ঋণ-রাজস্ব অনুপাত ৩৫০ থেকে ৪০০ শতাংশ হয়ে গেছে। এর মানে হচ্ছে আমাদের ঋণ সাড়ে তিন থেকে চার বছরের রাজস্বের সমান, যা অনেক বেশি। ভারতের ঋণ-জিডিপি ৯০ শতাংশ, কিন্তু তাদের ঋণ-রাজস্ব অনুপাত আমাদের চেয়ে কম। যুক্তরাষ্ট্রে ঋণ-জিডিপির অনুপাত ১১০ শতাংশ এবং ঋণ-রাজস্ব অনুপাত ৩০০ শতাংশ। আমাদের রাজস্বের অর্থ দিয়েই ঋণ শোধ করতে হবে, জিডিপি দিয়ে নয়।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে স্থানীয় উৎস থেকে নেয়া ঋণের স্থিতি ছিল ৮ লাখ ৪৭ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা, যা ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায়। একই সময়ের মধ্যে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ৯৫ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায়। গত অর্থবছরে স্থানীয় ঋণের বিপরীতে ৮৩ হাজার ৮৬ কোটি টাকা ও বিদেশী ঋণের বিপরীতে ৯ হাজার ৪৫২ কোটি টাকার সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে সরকারকে।
ঋণের স্থানীয় উৎসগুলোর মধ্যে ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত—উভয় খাত থেকেই গত অর্থবছরে ঋণ বেড়েছে সরকারের। এর মধ্যে ব্যাংক খাতে বেড়েছে ৮৮ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা। এ খাতে ট্রেজারি বিল এবং ট্রেজারি বন্ড ও এসপিটিবির মাধ্যমে সংগৃহীত ঋণের স্থিতি বেড়েছে। অপরিবর্তিত ছিল সুকুকের মাধ্যমে সংগৃহীত ঋণ। অন্যদিকে ব্যাংকবহির্ভূত খাতের মধ্যে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে নেয়া ঋণের পরিমাণ কিছুটা কমলেও অন্যান্য (জিপিএফ) উৎস থেকে নেয়া ঋণ বেড়েছে।
সক্ষমতার তুলনায় বেশি ঋণ নিয়ে অতীতে সাব-সাহারা অঞ্চলের দেশগুলোর বিপদে পড়ার নজির রয়েছে। এমনকি গত শতকের শেষ দিকে এশীয় অর্থনৈতিক সংকটের মূলেও ছিল অবাধে ঋণগ্রহণের প্রবণতা। বড় অংকের ঋণ বাংলাদেশের জন্যও ফাঁদ হিসেবে দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করছেন বিশ্লেষকরা। এজন্য সরকারকে আয়ের অনুপাতে ব্যয়ের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
সরকারের সাবেক সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাব-সাহারা অঞ্চলের দেশগুলো আশি-নব্বই দশকে এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছিল। এ দেশগুলোর সম্পদের পরিমাণ ছিল অনেক কম। তারা এত বেশি পরিমাণ বিদেশী ঋণ নিয়েছিল যে এক পর্যায়ে গিয়ে ঋণ নিয়ে ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হয়েছিল। সে সময় তারা কঠিন শর্তের ঋণ দিয়ে সহজ শর্তের ঋণের অর্থ পরিশোধে বাধ্য হয়েছে। বলাবাহুল্য বাংলাদেশও এ ধরনের ঋণফাঁদে পড়তে যাচ্ছে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সহজ শর্তের ঋণ পেয়েছে। কিন্তু এর পর থেকেই সরকার বৈদেশিক মুদ্রার বড় রিজার্ভ গড়ে তোলে এবং সেটিকে সক্ষমতা হিসেবে কাজে লাগিয়ে কঠিন শর্তের বিদেশী ঋণ নিতে শুরু করে। আরেকটি দিক হচ্ছে সরকার মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করে। এ অবস্থায় ঋণদাতারা সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার আগ্রহ হারায়।’
তিনি আরো বলেন, ‘১৯৯৭ সালে এশীয় অর্থনৈতিক সংকটের পেছনেও মাত্রাতিরিক্ত ঋণের প্রভাব ছিল। সে সময় ঋণের টাকায় জাপান, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো আবাসন খাতে বিপুল অংকের অর্থ বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি কাঙ্ক্ষিত হারে না হওয়ায় ব্যাংকগুলো বিপদে পড়ে। এ অবস্থায় সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ দিয়ে ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করা হয়েছিল। অবশ্য দেশগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য ভালো হওয়ার কারণে এ সহায়তা করা সম্ভব হয়েছিল। যেহেতু আমাদের এখানে কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আয় হচ্ছে না, সেহেতু বড় অংকের ঋণ নিয়ে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা কতুটুকু যুক্তিসংগত হচ্ছে; সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আমাদের যতটুকু আয় হচ্ছে সেটির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই ব্যয় করা সমীচীন হবে।’
সরকারের ঋণ স্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ঋণ বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে ঋণ বেড়েছিল ১ লাখ ৪ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এ সময়ে স্থানীয় উৎস থেকে নেয়া ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং বিদেশী ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা।
যদিও সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, ঋণের ক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকলেও তা সবকিছু হিসাব করেই নেয়া হয়েছে। এজন্য এখন রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স আহরণের পরিমাণ বাড়ানোর দিকে জোর দিচ্ছে সরকার। তাছাড়া অবকাঠামো উন্নয়ন থেকেও রিটার্ন বাড়তে যাচ্ছে। এতে ঋণ পরিশোধের বিষয়টি ভবিষ্যতে দেশের জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে না।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঝুঁকি তো অবশ্যই আছে, ঝুঁকিবিহীন কোনো দেশ নেই পৃথিবীতে। তবে ঝুঁকি যদি হিসাব করে নেয়া হয়ে থাকে, তাহলে ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমরা আশা করি, সামনে শুধু ঋণ নয়; আয়ও বাড়বে। অর্থনীতি আরো প্রসারিত হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আয়ের পরিমাণও বাড়বে। ঝুঁকি না নিলে উন্নয়ন করা সম্ভব হতো না। সবকিছু স্থবির হয়ে থাকত। আমরা অবকাঠামো খাতে অনেক বিনিয়োগ করেছি এবং সেখান থেকে অনেক রিটার্ন আসবে বলে প্রত্যাশা করি। কিছু আসছেও। তবে একটি বিষয় আমরা ঋণ করছি ডলারে, কিন্তু আয় করছি টাকায়। এখন আমাদের ডলারে আয় বাড়াতে হবে। তার মানে হচ্ছে রফতানির ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার মাধ্যমে আয় আরো বাড়াতে হবে। পাশাপাশি রেমিট্যান্সের পরিমাণও আরো বাড়াতে হবে।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে শুধু সরকারের নেয়া ঋণের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নেয়া ঋণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সেটি যোগ করা হলে সরকারের ঋণের পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর গৃহীত ঋণের তথ্য যুক্ত করে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশী ঋণের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন শেষে সরকারের বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৬৬৭ কোটি ৮৪ লাখ ৩০ হাজার ডলার বা ৮ লাখ ২৮ হাজার ১২৭ কোটি টাকা (প্রতি ডলার সমান ১০৮ টাকা ধরে)। সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে এ সময়ে বাংলাদেশের মোট বিদেশী ঋণ ছিল ৯ হাজার ৮৯৩ কোটি ৫৪ লাখ ৭০ হাজার ডলার বা ১০ লাখ ৬৮ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা। এ বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের বিদেশী ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি ডলার (১০০ বিলিয়ন) ছাড়িয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের জুন শেষে প্রতি ডলারের দর ছিল ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা। এ বছরের জুন শেষে এটি দাঁড়িয়েছে ১০৮ টাকায়। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার প্রতি ডলারের দর ছিল ১১১ টাকা।
বনিক বার্তা