দেশে ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী ও করখেলাপিরা সবাই প্রভাবশালী হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। পাশাপাশি অর্থনীতিতে চলমান সংকট কাটাতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে সংকট ঘনীভূত হবে।
গতকাল সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) সরকারকে এই পরামর্শ দিয়েছে। সংস্থাটি মোটাদাগে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হারের অস্থিরতা ও খেলাপি ঋণ কমানোর পরামর্শ দেয়। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে সরকারের পক্ষ থেকে অর্থনীতিবিদ, গবেষক, সাবেক গভর্নরসহ অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে।
তারই অংশ হিসেবে গতকাল সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান ও গবেষণা পরিচালক সায়মা হক বিদিশা বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে তাঁদের পরামর্শগুলো দেন। বৈঠকে সরকারের পক্ষে অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, চার ডেপুটি গভর্নরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থনীতির নানা সূচক, নীতি উদ্যোগ ও তার প্রভাব নিয়ে একটি উপস্থাপনা দেন নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান। সংকট কাটাতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলোও উপস্থাপনায় তুলে ধরা হয়।
জানা গেছে, সানেম মনে করে যে দেশের অর্থনীতিতে এখন প্রধান সমস্যা মূল্যস্ফীতি। এটা শুধু বৈশ্বিক কারণে হয়নি, এ জন্য অভ্যন্তরীণ কারণও দায়ী। সময়মতো নীতি না নেওয়ায়, আবার ভুল নীতি নেওয়ার কারণেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। দীর্ঘদিন সুদহার ৯ শতাংশে আটকে রাখা হয়েছে। মুদ্রা বিনিময় হারও কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হয়। যখন চাপ পড়েছে, তখন ডলারের দাম দাম বাড়ানো হয়েছে। সামনে সুদহার আরও বাড়াতে হবে। ডলারের দাম আরও বাজারভিত্তিক করতে হবে।
এর জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একার পক্ষে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এতে রাজস্ব খাতের ভূমিকা প্রয়োজন। পাশাপাশি বাজারের সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে। সামনে ব্যাংকঋণের সুদহার আরও বাড়বে।
মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ে সানেম বলেছে, যেকোনো উপায়ে হুন্ডি বন্ধ করতে হবে। যেকোনো উপায়ে অর্থ পাচার রোধ করতে হবে। পাশাপাশি মুদ্রার বিনিময় হার আরও বাজারভিত্তিক করতে হবে।
এর জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, এই মুহূর্তে বিনিময় হার তেমন বাড়ানো সম্ভব নয়। নির্বাচনের পর একটা পদ্ধতি চালু করা হবে। তাতে নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত ডলারের দাম ওঠানামা করতে পারবে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে।
সানেম বলেছে, খেলাপি ঋণ কমাতে শক্ত হাতে পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশে প্রকৃত খেলাপি ঋণ এখন প্রায় চার লাখ কোটি টাকা। ঋণ আদায়ে কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থাও জোরদার করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণের পুরো ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে দিতে হবে। ব্যাংক খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে হবে।
সার্বিক আর্থিক খাত নিয়ে সানেমের দুই অর্থনীতিবিদ বলেন, ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী ও করখেলাপিরা সবাই প্রভাবশালী। তাঁদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
এর জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, নির্বাচনের পর আর্থিক খাতে সংস্কার করা হবে। তখন সানেমের অর্থনীতিবিদেরা জানতে চান, নির্বাচনের পর সংস্কারে রাজনৈতিক অঙ্গীকার আছে কি না। এর জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, তারা আশা করে যে নির্বাচনের পর আর্থিক খাতের সংস্কারে সরকার রাজি হবে।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আলোচনা করে মনে হয়েছে অর্থনীতি যে সংকটময় অবস্থায় আছে, এটা সরকারও স্বীকার করছে। এই সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে সংকট আরও বাড়বে। তাই আমরা বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছি। নির্বাচনের পরে এসব বাস্তবায়নের আশা করছেন সরকারের প্রতিনিধিরা।’
সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন প্রতি সপ্তাহে এই পরামর্শ সভা করছে। চলতি সপ্তাহে আরও পরামর্শ সভার সূচি রয়েছে।
প্রথম আলো