উপসাগরীয় যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করার সিদ্ধান্ত

logo

নয়া দিগন্ত ডেস্ক
মুদ্রিত সংস্করণ
কাতারের ভূখণ্ডে ইসরাইলি হামলা নিয়ে আলোচনার জন্য জরুরি আরব-ইসলামিক নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা
কাতারের ভূখণ্ডে ইসরাইলি হামলা নিয়ে আলোচনার জন্য জরুরি আরব-ইসলামিক নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা |গালফ নিউজ

ইসরাইলের সাম্প্রতিক হামলার প্রতিক্রিয়ায় উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (জিসিসি) তাদের যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত সোমবার কাতারের রাজধানী দোহায় অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে জিসিসি নেতারা এ ঘোষণা দেন। গত সপ্তাহে দোহায় হামাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে ইসরাইলি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে কাতার ‘ঐক্যবদ্ধ’ পদক্ষেপের আহ্বান জানানোর পরই এ সিদ্ধান্ত এলো। মিডল ইস্ট আই।

দোহা সম্মেলনে মুসলিম ও আরব বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হাম্মাদ আলে-সানি তার উদ্বোধনী ভাষণে ইসরাইলি হামলাকে ‘প্রকাশ্য, বিশ্বাসঘাতক ও কাপুরুষোচিত’ আখ্যা দিয়ে এর তীব্র নিন্দা জানান। তিনি ইসরাইল সরকারের ‘ক্ষমতা, অহঙ্কার ও রক্তপিপাসু উন্মাদনার’ বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ; নেয়ার জন্য তার সমকক্ষদের প্রতি আহ্বান জানান।

জিসিসি এক বিবৃতিতে কাতারের বিরুদ্ধে ইসরাইলের ‘বর্বর আগ্রাসন’-এর নিন্দা জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই হামলা ‘যৌথ উপসাগরীয় নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সরাসরি হুমকি’। জিসিসির ছয় সদস্যরাষ্ট্র সর্বসম্মতিক্রমে জয়েন্ট ডিফেন্স কাউন্সিল এবং উচ্চ সামরিক কমিটির একটি জরুরি বৈঠক ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কমিটিগুলো ‘সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিরক্ষা অবস্থান এবং ইসরাইলি আগ্রাসনের আলোকে হুমকির উৎস মূল্যায়ন করবে,’ এবং ‘যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং উপসাগরীয় প্রতিরোধের সক্ষমতা সক্রিয় করবে’ বলে বিবৃতিতে জানানো হয়।

২০০০ সালে স্বাক্ষরিত জিসিসির যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি অনুযায়ী, এক সদস্যের ওপর হামলা সবার ওপর হামলা হিসেবে বিবেচিত হবে। জিসিসি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তারা ‘বন্ধুরাষ্ট্র কাতারকে সমর্থন করতে এবং তার নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্বকে যেকোনো হুমকি থেকে রক্ষা করার জন্য সব সক্ষমতা কাজে লাগাতে’ প্রস্তুত।

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, জিসিসির এই আত্মরক্ষার প্রতিশ্রুতি ন্যাটোর মতো সামরিক জোটের মতো সুসংহত নয়। জিসিসির কোনো কেন্দ্রীয় সামরিক কমান্ড কাঠামো নেই। অতীতে ইয়েমেনের হাউছিদের সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওপর হামলার ঘটনায়ও জিসিসি সম্মিলিতভাবে কোনো প্রতিরক্ষা প্রচেষ্টা চালায়নি।

উপসাগরীয় নেতারা লেবানন, সিরিয়া ও ইরানে ইসরাইলি আগ্রাসনে এমনিতেই উদ্বিগ্ন ছিলেন। এ ছাড়া গাজায় ইসরাইলি হামলায় ৬৪ হাজার ৯ শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ায় তাদের জনগণও ক্ষোভে ফুঁসছে। ইসরাইলের এ ধরনের আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আপাত উদাসীনতাও উপসাগরীয় দেশগুলোকে হতবাক করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন : সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই গত সপ্তাহে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কাতারে ইসরাইলি হামলার জন্য ‘সবুজ সঙ্কেত’ দিয়েছিলেন। সোমবার অ্যাক্সিওস নিউজ সাইটও ট্রাম্পের পূর্ব জ্ঞান ও সম্মতির বিষয়ে মিডল ইস্ট আইর রিপোর্ট নিশ্চিত করেছে। হামলার সময় দোহায় মার্কিন অপারেশন সেন্টারের সাথে সাধারণত যোগাযোগ রাখা কিছু মার্কিন কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে জানিয়েছেন যে তারা রেডিও নীরবতা লক্ষ করেছেন, যা ইঙ্গিত দেয় যে অপারেশনটি সহজ করার জন্য যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়েছিল।

উপসাগরের ধনী রাজতান্ত্রিক দেশগুলো দীর্ঘকাল ধরে তাদের নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি অবস্থিত, এবং ইসরাইলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি দোহায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসভবন থেকে মাত্র অল্প দূরে ছিল। বিশ্লেষকরা মিডল ইস্ট আইকে বলেছেন যে ইসরাইলের নিকটতম আরব অংশীদার সংযুক্ত আরব আমিরাতের অভ্যন্তরে কাতারে ইসরাইলি হামলার প্রতিক্রিয়ায় কিছু অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ রয়েছে। গত সপ্তাহে হারেৎজ রিপোর্ট করেছে যে কাতার সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ইসরাইলে তার দূতাবাস বন্ধ করতে অনুরোধ করেছিল।

দোহা সম্মেলনের পাশাপাশি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সোমবার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে দেখা করেছেন। রুবিওর সাথে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহু হামাস সদস্যদের থাকা দেশগুলোতে আরো হামলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি। মিসর, তুরস্ক ও কাতার বিভিন্ন সময়ে হামাসের কর্মকর্তাদের আশ্রয় দিয়ে থাকে। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য।

রুবিও ইসরাইলি হামলার সরাসরি নিন্দা করেননি। এ দিকে ট্রাম্প তার এক বক্তব্যে ইসরাইলি হামলায় মার্কিন জড়িত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এবং ভবিষ্যতে আরো ইসরাইলি হামলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি। ‘কাতার যুক্তরাষ্ট্রের একজন মহান মিত্র। অনেকে এটি জানেন না, এবং এর আমির একজন চমৎকার ব্যক্তি। আমি নেতানিয়াহুকেও বলেছিলাম যে যখন আমরা অন্যদের আক্রমণ করি, তখন আমাদের সতর্ক থাকতে হবে,’ ট্রাম্প বলেন।

কাতার ও মিসর যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে মধ্যস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিল। দোহায় ইসরাইলি হামলার পর, কিছু বিশ্লেষক এবং কূটনীতিক কাতারের মধ্যস্থতা প্রচেষ্টা বন্ধ করার সম্ভাবনার কথা বলেছেন। তবে সোমবার রুবিও মধ্যস্থতাকে অপ্রাসঙ্গিক বলে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন যে, হামাস ‘একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, একটি বর্বর গোষ্ঠী- যার ঘোষিত লক্ষ্য ইহুদি রাষ্ট্রের ধ্বংস। সুতরাং আমরা তার ওপর (যুদ্ধবিরতি) ভরসা করছি না।’

ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার আহ্বান : তাছাড়া ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন আরব ও মুসলিম দেশগুলোর শীর্ষ নেতারা। কাতারে হামাস নেতাদের ওপর ইসরাইলের হামলার পর সোমবার দেশটির রাজধানী দোহায় আরব ও মুসলিম দেশগুলোর শীর্ষ নেতারা এক জরুরি শীর্ষ সম্মেলনে এই আহ্বান জানান।

গত ৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত নতুন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব নিয়ে দোহায় হামাস নেতাদের বৈঠক চলাকালে বিমান ও ড্রোন হামলা চালায় ইসরাইল। আরব লীগ ও ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) এই যৌথ বৈঠকে প্রায় ৬০টি দেশ অংশ নেয়। হামাস জানিয়েছে, হামলায় তাদের পাঁচ সদস্য ও কাতারের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। কিন্তু ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনটির শীর্ষ কোনো নেতা নিহত হননি। এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় সোমবার জরুরি সম্মেলনটির আহ্বান করেছিল কাতার।

সম্মেলন শেষে এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরাইলের চলমান কার্যক্রম রোধে সব ধরনের আইনি ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে (বৈঠকে অংশগ্রহণকারী) সব দেশের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে।’ এসব কার্যক্রম হতে পারে, ‘ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করা এবং দেশটির বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা।’

কাতারের সাথে ঘনিষ্ঠ উপসাগরীয় দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও বাহরাইনসহ জর্দান, মিসর এবং মরক্কো এরই মধ্যে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এসব দেশও সম্মেলনে অংশ নিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে ইউএই, বাহরাইন এবং মরক্কোর শীর্ষ নেতারা সম্মেলনে অংশ নেননি।

এই পাঁচটি দেশের মধ্যে মিসর ও জর্দান আগেই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। বাকি তিনটি দেশ পাঁচ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া ‘আব্রাহাম চুক্তি’র মাধ্যমে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। সোমবারের সম্মেলনে এসব দেশের নেতারা অংশ না নিয়ে ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধি পাঠিয়েছে।

বিবৃতিতে জাতিসঙ্ঘের সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়, তারা যেন সংস্থাটির সদস্যপদ স্থগিত করতে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়। দোহায় ইসরাইলের হামলার পর উপসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদের সাথে ওয়াশিংটনের টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। এতে ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অঞ্চলটিতে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা রয়েছে। অঞ্চলটির বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি অবস্থিত কাতারে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ভাষ্যমতে, গত সপ্তাহের হামলার পর রুবিও কাতারে গিয়ে দেশটির নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করবেন। সোমবারের সম্মেলনে সৌদি আরবের ডি-ফ্যাক্টো (কার্যত) শাসক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান, ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানি, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান এবং ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস প্রমুখ অংশ নেন। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেন, ‘আগামীকাল যে কোনো আরব বা ইসলামী রাজধানী শহরকেও একইভাবে নিশানা করা হতে পারে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here