উন্নত প্রশাসনিক ব্যবস্থার একটি নিদর্শন বিকেন্দ্রীকরণ। পৃথিবীর যেসব রাষ্ট্র প্রশাসনকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে, তাদের সফলতা তত বেশি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও ক্ষমতাসীনদের প্রবণতা বরং কেন্দ্রীকরণ। সব ক্ষমতা নিজেদের হাতে থাকা চাই। সামরিক বাহিনীর রাজনীতি যেহেতু গতানুগতিক নয়, তাই হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো কখনো কখনো তারা ভালো কিছুও করে থাকে। বাংলাদেশের নিন্দিত সামরিক শাসক এরশাদের উপজেলা ব্যবস্থা একটি নন্দিত কার্যক্রম। ১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা পুনর্গঠন) অধ্যাদেশ ১৯৮২ বলে প্রথমে উন্নীত থানা পরিষদ গঠন করা হয় এবং থানা পর্যায়ে বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। পরবর্তীকালে উন্নীত থানা পরিষদকে উপজেলা পরিষদে রূপান্তরিত করা হয়। এ সময়ে বাংলাদেশের প্রায় সব উপজেলাকে পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক কেন্দ্রে রূপ দেয়া হয়।
এই অধ্যাদেশটি ১৯৯১ সালে বাতিল করা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৯৮ সালে জাতীয় সংসদে উপজেলা অধ্যাদেশ ১৯৯৮ পাস করে পুনরায় উপজেলা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়। কার্যালয় আদেশের মাধ্যমে ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ থেকে এই অধ্যাদেশ কার্যকর হয়। সর্বশেষ ২০০৯ সালে উপজেলা পরিষদ আইন সংশোধন হয়। বাংলাদেশের দুই শাসকদল- বিএনপি ও আওয়ামী লীগের টানাপড়েনে উপজেলা ব্যবস্থা সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে এরশাদের সখ্যতায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে উপজেলা ব্যবস্থা টিকে যায়। টিকে যায় এর নিজস্ব গুণপনায়। প্রবণতা যেখানে শতভাগ নিয়ন্ত্রণের, সেখানে উপজেলা ব্যবস্থা খানিকটা ব্যতিক্রম বটে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্থানীয় সরকার বলে একটি ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। সব দেশে সব কালে এই ব্যবস্থা বহাল ছিল। এই ভূ-খণ্ডেও স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। দিনে দিনে এর ক্ষমতা ও ব্যাপ্তি বেড়েছে। উপজেলা ব্যবস্থা বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। জেলা পরিষদ অকার্যকর থাকায় এবং ইউনিয়ন পরিষদ উপজেলার নিকটবর্তী হওয়ায় এর উপযোগিতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার প্রবণতা থেকে উপজেলা ব্যবস্থা মুক্ত নয়। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সবসময়ই ক্ষমতাকে সার্বিকভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তাই তারা অতীতের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতাকে ম্লান করে দিয়ে স্থানীয় সরকারের সব স্তরে দলীয়করণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৫ সালে আইন সংশোধন করে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্ত নেয় বর্তমান সরকার। বর্তমানে সব স্তরের স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হচ্ছিল সে অনুযায়ীই।
স্থানীয় সরকার কাঠামোর মূল ভিত্তি হচ্ছে এর নির্বাচিত প্রতিনিধিরা হবেন সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও সম্মানিত ব্যক্তি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির রাজনৈতিক পরিচয় এবং যোগ্যতা তার দায়িত্ব পালনের সাথে সাংঘর্ষিক হচ্ছে। শুধু সাংঘর্ষিকই নয়, ‘ভিলেজ পলিটিক্স’ বলতে যে জটিলতা ও কুটিলতার কথা বুঝানো হয়, তা এখন স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে অকার্যকর করে তুলেছে। রবীন্দ্রনাথের ‘ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়, ছোট ছোট গ্রামগুলো’ এখন বড় বড় ঝগড়ার জায়গায় পরিণত হয়েছে। ‘আম গাছ, জাম গাছ, বাঁশ ঝাড় যেন, মিলে-মিশে আছে ওরা, আত্মীয় হেন’। সেই আত্মীয়তা এখন আওয়ামী লীগের সৌজন্যে শত্রুতায় পরিণত হয়েছে। চলমান উপজেলা নির্বাচন প্রত্যক্ষ করলেই এর প্রমাণ মিলবে।
নীতি-নৈতিকতার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অবস্থান সবসময়ই তলানিতে ছিল। যখন যেমন, তখন তেমন। আইন-কানুন, রীতি-রেওয়াজ, ভদ্রতা-সভ্যতার ধার ধারে না তারা। যে আওয়ামী লীগ ২০১৫ সালে রাজনীতির ঝগড়া গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছিয়েছে, এখন তারা উল্টো কথা বলছে। ইতোমধ্যেই আপনারা জেনেছেন, এই উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী দিচ্ছে না। অথচ ২০১৫ সালে প্রণীত আইনটির এক অক্ষরও পরিবর্তন করেনি তারা। আইনে এক আর আচরণে আরেক। সবসময় সুবিধাজনক ব্যাসার্ধ নেয় তারা। এ বছরের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ডামি নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের পক্ষে ঘর সামলানো বেকায়দা হয়ে গেছে। ৬২ জন ডামি প্রার্থী যারা মূলত আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী, তারা জয়লাভ করেছেন। তাদের জন্য এটি ভয়ঙ্কর বিপদসঙ্কেত। যদি সত্যি সত্যিই ডামি প্রার্থীর পরিবর্তে আসল প্রার্থী হতো তাহলে কী পরিণতি হতো তাদের? সে সময় দেশ ও বিদেশে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা, বহু প্রার্থিতা প্রদর্শনের জন্য ডামি আমদানি হয়েছিল। সেই বিভেদের রেশ যেতে না যেতেই উপজেলা নির্বাচন ঘোষিত হলো। জাতীয় নির্বাচনে যে বিভেদ, বিতর্ক ও বিদ্বেষ জমা হয়েছে এখন তা উপজেলা নির্বাচন উপলক্ষে প্রকাশ্য হয়ে পড়ছে। নির্বাচিত এমপি, আধামন্ত্রী ও মন্ত্রীরা কেউই নিজেদের রাজত্ব হারাতে চান না। সবাই চান, তার নিজের লোক- একান্তই বশংবদ ব্যক্তিরা নির্বাচিত হোক।
বিরোধী দলগুলো এই উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার কারণে আওয়ামী লীগের ক, খ, গ, ঘ, ঙ প্রার্থীরা সবাই ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চান। এই কলামে একবার বলা হয়েছিল- ডামি প্রার্থী একসময় আওয়ামী লীগের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে, হয়েছেও তাই। নিজেদের কামড়া-কামড়ি, মারামারি, হানাহানি, কাটাকাটি, ফাটাফাটি সামাল দিতে বেসামাল আওয়ামী লীগ। তারা এখন ফতোয়া দিচ্ছে- মন্ত্রী ও এমপিদের আত্মীয়স্বজন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। মূল লক্ষ্য ছিল- বিএনপি-জামায়াতবিহীন উপজেলা নির্বাচন সংসদ সদস্যদের প্রভাবমুক্ত রাখা। এ ছাড়া তৃণমূলের যেসব নেতা সংসদ সদস্য কিংবা মন্ত্রী হওয়ার উপযুক্ত নন, তাদের উপজেলা চেয়ারম্যান পদে সুযোগ দেয়া। কিন্তু এখন এমন কোনো নির্বাচনী এলাকা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে এমপি-মন্ত্রীরা ‘মাই ম্যান’ ঘোষণা করেননি। আর মাই ম্যানরা বলছেন, ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত’। ভোট দেয়া হোক বা না হোক, তিনিই চেয়ারম্যান। এর ফলে সরকারের বহুমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে দলকে সংহতকরণের প্রক্রিয়া পরিত্যক্ত হতে চলেছে। এমপি-মন্ত্রীরা দলকে পাত্তা দিচ্ছেন না। তাদের মামু-ভাগ্নেরা, ভাই-ভাতিজারা, চাচা-খালুরা অবাধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ভাবখানা এই- ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই’। এর ফলে দলীয় প্রতীকে যা হওয়ার কথা ছিল, প্রতীকবিহীনভাবে তাই হবে। এমনিতেই এই সমাজে ভালো মানুষের ভাত নেই। কোনো কোনো উপজেলায় ভালো মানুষেরা একটু-আধটু এগিয়ে এসেছিলেন। এখন সেই আওয়ামী দলীয় প্রার্থীরা তাদের হামলা-মামলা দিয়ে বিতাড়ন করতে চাচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
আওয়ামী লীগের লোকেরা কী যে বেসামাল অবস্থায় আছে তা একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, দলীয় সিদ্ধান্ত মানেননি আওয়ামী লীগের অনেক নেতা। প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশনার পরও নির্বাচনী মাঠ থেকে সরেননি স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীর পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা। ২২ এপ্রিল প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনেও তারা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। উল্টো নানা যুক্তি দেখিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন। নোয়াখালী-৬ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) মোহাম্মদ আলীর ছেলে এবং মুন্সীগঞ্জ-৩ এর এমপি মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লবের চাচাসহ চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে বেশ কয়েকজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। প্রথম ধাপে ১৫০ উপজেলায় সোমবার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এ ধাপের নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হচ্ছে। আগামী ৮ মে প্রথম ধাপের নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, দলীয় নির্দেশনার পরও যেসব এমপি-মন্ত্রীর আত্মীয়স্বজন নিজেদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি, তাদের নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার সময় কিন্তু এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আমরা বিশ্বাস করি, দলীয় নির্দেশনা মেনে তারা নিজেদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেবেন। তবে কেউ যদি শেষ পর্যন্ত দলীয় নির্দেশনা না মানেন তাহলে অবশ্যই দল তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। দলের নিয়মনীতি ও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এটিই আওয়ামী লীগের দলীয় সিদ্ধান্ত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশনার পরও ধনবাড়ী উপজেলা পরিষদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াননি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক এমপির খালাতো ভাই এবং মামাতো ভাই। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও মাদারীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য শাজাহান খানের বড় ছেলে মো: আসিবুর রহমান খান। তিনি মাদারীপুর জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য। তিনি এবারের মাদারীপুর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। নোয়াখালী-৪ (সদর-সুবর্ণচর) আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর একমাত্র ছেলে আতাহার ইসরাক শাবাব চৌধুরী সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। এ বিষয়ে এমপিপুত্র আতাহার ইসরাক শাবাব চৌধুরী বলেন, এমপিপুত্র ছাড়াও আমি এ দেশের নাগরিক। এলাকার নাগরিক হিসেবে ভোট করার অধিকার আমার রয়েছে। মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মাঠে শেষ পর্যন্ত থাকার ঘোষণা দিয়েছেন মানিকগঞ্জ-৩ (মানিকগঞ্জ সদর ও সাটুরিয়া উপজেলা) আসনের এমপি এবং সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের আপন ফুপাতো ভাই মো: ইসরাফিল হোসেন। কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া সদর আসনের সংসদ সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতা। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাচনে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলী আজগর টগরের ছোট ভাই উপজেলা চেয়ারম্যান আলী মুনসুর বাবু মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোড়াশাল পৌরসভার সাবেক মেয়র আলহাজ শরীফুল হক। সম্পর্কে তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপের স্ত্রীর বড় ভাই। ঠাকুরগাঁও-২ আসনের এমপি মাজহারুল ইসলাম সুজনের দুই চাচা ও চাচাতো ভাই বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মাঠে রয়েছেন। অপর দিকে, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি দ্রোপদী দেবী আগরওয়ালার পুত্রবধূ প্রিয়া আগরওয়ালা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। তবে এসব বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যারা নির্বাচিত হবেন, তারা নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, দল তাদের ভবিষ্যতে প্রয়োজনে লুফে নেবে। কারণ ক্ষমতা এবং ক্ষমতাই তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ইতঃপূর্বে গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মতো ডাকসাইটে ব্যক্তিত্বকে দু’বার বহিষ্কার করা হয়েছে। দু’বারই জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে পার্টির প্রয়োজনে আবার ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীর আলম একক উদাহরণ নয়। সারা দেশে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব বড় বিপাকে আছে। এ দেশে নির্বাচন একটি মুলোর মতো। মুলোর গন্ধে টগবগিয়ে এগিয়ে চলে তারা। বিএনপির কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৪৯ জন চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। নির্বাচন বর্জনের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৩৮ জন। এর মধ্যে বিএনপির পদধারী নেতা ১৮ জন। বাকিরা বিএনপি নেতাদের আত্মীয়স্বজন ৯ জন ও দল থেকে বহিষ্কৃত নেতা। এ ছাড়া ১১ জন চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিলেও তারা প্রত্যাহার করেছেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না বিএনপি। এটি দলীয় সিদ্ধান্ত। সে জন্য উপজেলা পরিষদ নির্বাচনও বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কাজেই দলের দায়িত্বশীল যারাই উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হবেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার পক্ষে যেমন যুক্তি আছে, করার পক্ষেও যুক্তি রয়েছে।
পক্ষের লোকেরা যুক্তি দিচ্ছেন- উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের মধ্যে গতি সঞ্চারিত হতে পারত। নির্বাচনের সফলতা পার্টিগুলোর জন্য ইতিবাচক হতো। এর মাধ্যমে নীতি ও আদর্শের প্রচার-প্রসারও কিছুটা হতে পারত। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে অবৈধ নির্বাচনকে বৈধতা দেয়া হতো সেটিও নিরেট সত্য কথা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মেরিটস-ডিমেরিটস রয়েছে। পার্টিগুলো যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নেতাকর্মীদের তা মেনে নেয়াই সঙ্গত। এদিকে জামায়াতে ইসলামীও প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে ২২ জন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু দলের নীতি-নির্ধারণী মজলিশ-ই-শূরা নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। সুশৃঙ্খল ও আনুগত্যশীল দল হিসেবে পরিচিত জামায়াতের সব প্রার্থীই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। উপজেলা নির্বাচনে আদর্শিক উদ্দেশ্যে অংশগ্রহণের ব্যাপারে তারা কিছুটা নমনীয় ছিল বলে জানা যায়। চরমোনাইয়ের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনও নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, অর্জিত ত্রি-দলীয় ঐক্যের স্বার্থে জামায়াত এই সিদ্ধান্ত নেয়।
আগেই বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় উপজেলা পরিষদ এখন ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’-এর মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করেছে। অবারিত ও উদার অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই প্রাথমিক প্রতিষ্ঠানকে আরো শক্তপোক্ত করা প্রয়োজন। এ জন্য আইনগত ও সাংবিধানিক পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন প্রয়োজন। উপজেলা ব্যবস্থায় যদি সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব আসীন হয় এবং গণতন্ত্রের তথা নির্বাচন ব্যবস্থাটি যদি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয়- তার প্রভাব জাতীয় জীবনে অনুভূত হতে পারে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের এমপি ও মন্ত্রীরা তা হতে দেবেন বলে আশা করা দুুরাশা। বিস্ময়ের ব্যাপার, মন্ত্রী-আধামন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের আত্মীয়স্বজনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ যতটা কঠিন ও কঠোরতা দেখাচ্ছে, এমপিদের ‘মাই ম্যান’ ক্ষেত্রে সেরকম কঠোরতা লক্ষণীয় নয়। সুদৃঢ়ভাবে যদি দলনিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে জাতি উপজেলা ব্যবস্থার মাধ্যমে অনেক কাঠিন্যের মধ্যেও সীমিত কল্যাণ লাভ করতে পারে। যেকোনো নির্বাচন সম্পর্কে সাধারণ প্রত্যাশা- নির্বাচনটি হোক ‘চাষাদের, মুটেদের, মজুরের, গরিবের, নিঃস্বের, ফকিরের- সব মানুষের।’
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]