- জাকির আবু জাফর
- ২৯ আগস্ট ২০২৩, ০৬:৫০
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় উন্নয়ন বেশ জনপ্রিয় একটি শব্দ। শব্দটি উচ্চারণ করলে মনের আকাশে উড়তে থাকে সুখপাখি! বড় কর্মঠ মনে হয়। একটি বাহাদুরি ভাব চাগিয়ে ওঠে মনে। উন্নয়ন আশান্বিত করে জীবনকে। নতুন স্বপ্ন দেখার প্ররোচনা দেয়। এগিয়ে যাওয়ার কৌতূহল সৃষ্টি করে। কোনো জাতি যখন উন্নয়ন দেখে, তাদের স্বপ্নগুলো জড়ো হতে থাকে। স্বপ্নের সাথে স্বপ্নের জোড়া লাগে। স্বপ্ন দীর্ঘ হয়ে ওঠে। জেগে ওঠে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।
একজন আধুনিক শাসকের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যও এই উন্নয়ন। উন্নয়নের অগ্রযাত্রা একজন শাসককে মহিমান্বিত করে। বিশেষ করে রাষ্ট্র পরিচালনায় বিপুল জনসমর্থন পেতে সহায়তা করে। বর্তমান বিশ্বরাজনীতিতে শব্দটি বহুল উচ্চারিত একটি শব্দ। উন্নয়নের সাথে উন্নতি শব্দটিও জড়াজড়ি করে থাকে। এ উন্নতি জীবনের এবং জীবনের সঙ্গে জড়ানো সব কিছুর।
উন্নয়ন বা উন্নতি কী? এমারসনের একটি উক্তি এখানে গ্রহণযোগ্য খুব। তিনি বলেছেন, উন্নতি হচ্ছে বর্তমানের কাজ এবং ভবিষ্যতের দৃঢপ্রত্যয়। বর্তমানের কাজ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ- ভবিষ্যতের প্রত্যয়। সহজ কথায় বোঝার বিষয় হলো- বর্তমানে এমন উন্নতি করো যা ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করে।
কিন্তু ভবিষ্যৎকে অস্বীকার করে উন্নয়ন হয় না। আজকের প্রতিটি পদক্ষেপ আগামীর উপযোগী হতে হবে। হতে হবে পরের প্রজন্মের জন্য। তবে উন্নতি করতে হলে মানুষকে নির্মোহ হতে হয়। ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে হয়। ব্যক্তিগত লোভ-লোকসান, হিংসাবিদ্বেষ, প্রতিশোধ পরায়ণতা এবং পরিবারতন্ত্রের ঊর্ধ্বে উঠতে হয়। তখনই দেখা মেলে উন্নয়নের। কেবল তখনই ঘটে জাতীয় উন্নতি।
উন্নতির জন্য সবার আগে প্রয়োজন ধৈর্যের। কোনো মেজাজি, সংযমহীন এবং অসহিষ্ণু মানুষ উন্নতির ট্র্যাকে উঠতে পারে না। উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারে না।
উন্নতির জন্য দূরদর্শিতা এবং বুদ্ধিও দরকার। যুগোপযোগী এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হয়। অদূরদর্শী বা আত্মকেন্দ্রিক কোনো মানুষ দিয়ে সমাজের বা রাষ্ট্রের কোনো উন্নতি সম্ভব হয় না।
উন্নতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মূর্খরা লাভ করে উন্নতি, আর যোগ্য ব্যক্তিরা লাভ করে গৌরব।’ এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের আরো একটি মূল্যবান বাণী স্মরণযোগ্য। বলেছেন, ‘আমরা উন্নতির পালে একটুখানি ফুঁ দিতেছি, যতখানি গাল ফুলিতেছে, ততখানি পাল ফুলিতেছে না।’ ব্যাখ্যা ছাড়াই এ বাণীর মূল বিষয়টি বোঝা যায়। আমাদের সমাজে এমন গাল ফুলিয়ে ফুঁ তোলার উন্নয়ন প্রচারকারীর অভাব নেই। তিলকে তাল কিংবা পুকুরকে নদী নয়, সমুদ্র বানিয়ে তোলার লোকও কম নেই। কিন্তু সত্যিকারের উন্নয়ন এবং উন্নতির পালে হাওয়া লাগানোর মানুষ কমই আছে।
উন্নতি কোনো হঠাৎ বিষয় নয়। আকস্মিক কোনো বিষয়ও নয় এটি। বরং উন্নতির জন্য লক্ষ্য স্থির করতে হয়। বুদ্ধি খাটাতে হয়। তারপর নিজেদের একটি অর্থবহ পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেতে হয় উন্নয়নের পথে। সবচেয়ে বড় কথা- উন্নয়ন একটি সামগ্রিক বিষয়ের বাস্তব রূপ। ব্যক্তি জীবন বা রাষ্ট্রীয় জীবনে কোনো একটি দিকের উন্নয়ন, সামগ্রিক উন্নয়নের প্রতিনিধি নয়!
এবার আসা যাক জীবনের কাছে। একটি ফরাসি প্রবাদ আছে, ‘জীবন হলো পেঁয়াজের মতো, কাঁদতে কাঁদতে মানুষ এর খোসা ছাড়ায়।’ প্রবহমান কোনো সত্য ঘিরে প্রবাদ গড়ে ওঠে। জীবন সম্পর্কে এ প্রবাদটির অর্থ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, জীবনে মানুষ যা না সুখ ভোগ করে; তার চেয়ে বেশি ভোগ করে দুঃখ। জীবনে হাসির চেয়ে কান্না অনেক বেশি। এ কান্নার হয়তো সবসময় অশ্রু থাকে না। সবসময় অশ্রু ঝরে না। কিন্তু অশ্রুহীন কান্না আরো কষ্টের। আরো বেশি বেদনার। যাকে বলে বুকের ভেতর গুমরে ওঠা।
সক্রেটিস তাই বলেছিলেন, মৃত্যুর চেয়ে কঠিন হচ্ছে জীবন! কেননা দুঃখ কষ্ট, বিপদ-মুসিবত কেবল জীবনেই ভোগ করতে হয়!’ আব্রাহাম কাওলির ভাষ্য অনুযায়ী, ‘জীবন এক দুরারোগ্য অসুখ।’ অর্থাৎ জীবন এমনই এক অসুখ যার কোনো আরোগ্য নেই। যার কোনো চিকিৎসা নেই।
মানুষের জীবন একটি সাদা খাতা। কিংবা একটি খোলা ডায়েরি; যাতে ইচ্ছের সুখ দুঃখ আনন্দ ও বেদনার রঙ আঁকেন। কখনো মনে হয়, জীবন একটি বিশাল মানচিত্র। এই মানচিত্রের জায়গায় জায়গায় আঁকা আছে সুখের আশা। দুঃখের দহন। আঁকা আছে লালসার ভয়াবহতা! হিংসাবিদ্বেষের ভয়ঙ্কর সব দাঁত! আছে প্রতিশোধ নেয়ার এক অসুন্দর চিত্র!
প্রতিশোধ! বড় ভয়ঙ্কর বিষয়! এর অভিধান বড় নির্মম! যিনি প্রতিশোধ নিতে যান তার পরিণতি কখনো শুভ হয় না। একটি প্রবাদ স্মরণ করা যেতে পারে প্রতিশোধ নিয়ে। প্রবাদটি হলো- তুমি যদি কারো ওপর প্রতিশোধ নিতে চাও, তবে দুটো কবর খনন করো। একটি তোমার নিজের জন্য! এর অর্থ- যার জন্য প্রতিশোধ নেবে তার জন্য তো খুঁড়বে। সঙ্গে তোমার জন্যও খুঁড়ে রেখো। প্রতিশোধ নিতে গেলে তুমি নিজেও তার শিকার হবে।
একটি ছোট জীবনে বৃহৎ আশা বেঁধে রাখে মানুষ! জীবন হলো মৃত্যুর সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু! ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। জীবন হচ্ছে মৃত্যুর সবচেয়ে নিশ্চিত সাক্ষাৎপ্রার্থী!
একটি জীবন পৃথিবীতে এসে প্রথমে নিশ্চিত করে মৃত্যু! মৃত্যুর সাথে জীবনের মোলাকাতই জীবনের নিশ্চিত সত্য। জীবনের জন্য মৃত্যুর চেয়ে সত্য কিছু নেই। যে জীবন বিশ্বাসের তার কাছে মৃত্যুও দামি। কারণ মৃত্যুর ভেতর দিয়ে সে তার প্রিয় আবাসস্থলের সন্ধান পায়। তার প্রিয় রবের সান্নিধ্য অর্জন করে। চির সাধনার জান্নাত পেয়ে যায়।
আর অবিশ্বাসী জীবনে মৃত্যুর চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু নেই। কেননা, মৃত্যুর ভেতর দিয়ে সে চিরকালের দুঃসহ দুর্গতির সাক্ষাৎ পেয়ে যায়। মাত্র ক’দিনের বিলাসী জীবন অনন্ত দুঃখের গহবরে প্রবেশ করে। মানুষ ধরে নেয়, জীবন মানে পৃথিবীর উঠোনে কিছুটা দিন গড়াগড়ি দেয়া। কিংবা যে ক’দিন পারা যায়, খেলাধুলা করে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে হারিয়ে যাওয়া। তাই যা খুশি তা-ই করো। অন্যকে মারো ধরো, উৎখাত করো। প্রয়োজনে নিঃশেষ করো। কিচ্ছু যায় আসে না। শক্তি আছে তো ব্যবহার করো। ক্ষমতা আছে তো প্রয়োগ করো।
জীবন কী চায় মানুষ কি তা জানে? জানলে কতটুকু জানে? যেটুকু জানে তার কতটুকু মানে? যেটুকু মানে তা কি আন্তরিকতার সাথে মানে? সততার সাথে মানে? যদি তা আন্তরিক না হয়; সৎ না হয়; তবে কী দাঁড়ায় তার পরিণতি?
একজন মানুষ যা করে তার নিজের জন্যই করে। যা দেখে তার নিজের জন্য দেখে। যা অনুভব করে তাও তার নিজের জন্যই। কাজটি ভালো হলে পরিণতি ভালো। মন্দ হলে ফল মন্দই হয়। যে ভালো করল সে ভালো ফল পেল। যে মন্দ করবে, সে মন্দ কাজের ভার বহন করবে। এটিই মহান স্রষ্টার প্রতিশ্রুতি।
কোনো মানুষ যখন কোনো কাজ করে সে কাজের দায়ভার তার। হোক তা ব্যক্তিগত। হোক সামষ্টিক। হোক সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয়। অথবা হোক আন্তর্জাতিক। কাজটি যিনি বা যারা করবেন, কাজের সব দায়দায়িত্ব তার বা তাদের। মানুষ যেখানে যখন যা কিছু করে, সব শুধু নিজের জন্য করে। সব কাজের দায়দায়িত্ব কেবল যে করে তার ওপর বর্তায়। তবে তাকে যদি কেউ প্ররোচিত করে তার কথা আলাদা। প্ররোচিত করলে, যে প্ররোচিত করলো এবং প্ররোচনায় আকর্ষিত হয়ে কাজ করলে দু’জনে সমান অপরাধী।
এখন অঙ্কটি মেলানো যাক। উন্নয়ন, উন্নতি জীবনের জন্য যদি হয়, তবে তা জীবনকে আনন্দিত করবে। জীবনকে করবে গৌরবান্বিত। আর উন্নয়ন যদি জীবনের অঙ্গীকারের বাইরের হয়; সে উন্নয়ন জীবনকে মহিমান্বিত করে না। সম্মানের জায়গায় পৌঁছায় না। আসল কথা হলো- উন্নয়নে জীবনের প্রতি থাকতে হবে দৃঢ় অঙ্গীকার।
লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক