দেশের ব্যাংক খাতে শ্লথ হয়ে এসেছে আমানতের প্রবৃদ্ধি। বাড়ছে না ব্যাপক মুদ্রার (ব্রড মানি) জোগান। ৮ শতাংশের ঘরে আটকে আছে ব্রড মানির প্রবৃদ্ধি। গোটা ব্যাংক খাতে রিজার্ভ মানির প্রবৃদ্ধিও ঋণাত্মক। যদিও বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে ব্যাংকের অর্থ লেনদেনে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ব্যাংকগুলোয় লেনদেন বেড়েছে ১৫ শতাংশের বেশি। এ সময়ে চেক ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন কিছুটা কমলেও বেড়েছে ডিজিটাল সব মাধ্যমে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় ডলারের দর বেড়েছে। এ কারণে একই পরিমাণ ডলার ক্রয়-বিক্রয়ে আগের চেয়ে বেশি অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতি বা জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের আগের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। একই পরিমাণ পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে টাকার প্রয়োজন হচ্ছে বেশি। এসব কারণে ব্যাংক খাতে আমানতের বড় প্রবৃদ্ধি না হলেও অর্থ লেনদেন বাড়ছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে জানান, গ্রাহকরা চেকের চেয়ে এখন আরটিজিএস, ইএফটি, ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মতো ডিজিটাল মাধ্যমগুলোয় লেনদেনে বেশি আগ্রহী। এ কারণে চেকে লেনদেন কমে যাচ্ছে। লেনদেন বাড়লেও ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি কম। আমানত সংগ্রহে অনেক ব্যাংক এখন ১০ শতাংশের বেশি সুদ দেয়ার প্রস্তাবও করছে। তার পরও কাঙ্ক্ষিত আমানত মিলছে না। সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার এখন প্রায় ১২ শতাংশ। এ কারণে করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও বড় আমানতকারীরা এখন ব্যাংকে আমানত না রেখে সরকারি বিল-বন্ড কিনছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুলাইয়ের শুরুতে দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৯৩ টাকা। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে এসে ডলারের বিনিময় হার ১০৮ টাকায় উঠে যায়। নভেম্বরে এসে বিনিময় হার দাঁড়ায় প্রায় ১১১ টাকায়। এ তথ্য আমলে নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবেই এ সময়ে টাকার মান ১৯ শতাংশের বেশি কমেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত দরে ব্যাংক কিংবা কার্ব মার্কেটে ডলার মিলছে না। আমদানি কিংবা নগদ কেনার ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের জন্য ১২০ টাকার বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে।
প্রায় দুই বছর ধরেই দেশে মূল্যস্ফীতির হার উচ্চ। চলতি অর্থবছরে এসে এটি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। ২০২২ সালের জুনে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ দেখানো হয়েছে। ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় অনেক বেড়েছে। একই পণ্য বা সেবা কিনতে আগের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
প্রায় দুই বছর ধরেই দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি শ্লথ। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ব্রড মানির প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। ব্রড মানি বা ব্যাপক মুদ্রা হলো ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থ ও ব্যাংক খাতের আমানতের যোগফল। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের রিজার্ভ মানির প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক ২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি কমাতে এ সময়ে ব্যাংক খাতে অর্থপ্রবাহের লাগামও টেনে ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য নীতি সুদহার ৫ শতাংশ থেকে কয়েক দফায় বাড়িয়ে ৮ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। নেতিবাচক এসব চিত্রের মধ্যেও ব্যাংকে অর্থ লেনদেন বেড়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমানের বক্তব্য হলো ‘দেশে মানি ইনকাম ভেলোসিটি বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে মানি মাল্টিপ্লায়ারের প্রভাব। অর্থাৎ একই অর্থ দ্রুততার সঙ্গে বেশিবার হাতবদল হচ্ছে। এ দুইয়ের প্রভাবে ব্যাংকে লেনদেন বেড়ে যাতে পারে।’
বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতের রিজার্ভ মানির প্রবৃদ্ধি এখন ঋণাত্মক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমরা মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যে কাজ করছি। এজন্য ব্যাংক খাতে অর্থের প্রবাহ হ্রাস করা হয়েছে। একই সঙ্গে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। তবে ব্যাংকগুলোর তারল্যের চাহিদা পূরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিতই ধার দিচ্ছে।’
দেশের মোট ব্যাংক লেনদেনের প্রায় অর্ধেক এখনো চেকনির্ভর। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চেকের মাধ্যমে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে লেনদেন হয়েছে ১০ লাখ ২৫ হাজার ১০২ কোটি টাকার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে চেকে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৮১ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরে চেকের মাধ্যমে লেনদেন কমেছে ৫৬ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে লেনদেন কমেছে ৫ দশমিক ২১ শতাংশ।
দেশে ডিজিটাল লেনদেনের অন্যতম বড় মাধ্যম রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্টেও (আরটিজিএস) লেনদেন বেড়েছে। গত অর্থবছরে আরটিজিএসের মাধ্যমে প্রতি মাসে গড় লেনদেন ছিল ৪ লাখ ৭৮ হাজার ৪০১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের নভেম্বরে এ মাধ্যমে ৪ লাখ ৯৫ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। অক্টোবরে আরটিজিএসের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল ৫ লাখ ১৮ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ১ লাখ টাকার বেশি অর্থ আরটিজিএসের মাধ্যমে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের হিসাবে তাৎক্ষণিকভাবে পাঠানো যায়। চেকের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে বিলম্ব হওয়ায় গ্রাহকরা এখন আরটিজিএসে ঝুঁকছেন বলে ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ইএফটির মাধ্যমে লেনদেন বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ইএফটির মাধ্যমে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৩৯১ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ লেনদেন দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ২৩ হাজার ৮৪ কোটি টাকায়। সে হিসাবে ইএফটির মাধ্যমে লেনদেন বেড়েছে ৭৪ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা।
লেনদেন বেড়েছে ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মতো ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থায়ও। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ডেবিট কার্ডে লেনদেন ৭ দশমিক শূন্য ৯ এবং ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ বেড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল ১ লাখ ২৯ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ লেনদেন বেড়ে ৩ লাখ ৮ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন বেড়েছে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা।
দেশে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এখন প্রতি মাসে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন ছিল ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এ লেনদেন বেড়ে ৫ লাখ ৫৬ হাজার ৫০৬ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এক্ষেত্রে লেনদেনে প্রবৃদ্ধির হার ২৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য চালু করা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের লেনদেনও বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এজেন্টদের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন হয়েছে ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে এ মাধ্যমে ২ লাখ ৯৪ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল।