বিদ্যুৎ খাতে অব্যাহত লোকসান ও ভর্তুকি কমাতে দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা সরকারের। এজন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় অনেক আগ থেকেই কাজ করছে। তবে সামনে রমজান। এ সময় বিদ্যুতের দাম বাড়ালে তার প্রভাব পড়বে পণ্য ও সেবায়, যা বিদ্যমান ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দেবে। এ কারণে বর্তমান মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে রোজার পর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এবারের দাম বাড়ানোর হার আগের তিন দফা দামের মতোই হবে কিনা সে বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, এবারের মূল্যবৃদ্ধি ৫-১০ শতাংশের মধ্যেই থাকবে। সেই সঙ্গে একবারে দাম না বাড়িয়ে কয়েকটি ফর্মুলা করা হয়েছে, যা নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ নানা ধরনের হিসাবনিকাশ করছে। দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে যাতে ভোক্তার ওপর বড় ধরনের প্রভাব না পড়ে সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হচ্ছে।
বর্তমানে বিদ্যুতে যে পরিমাণ ভর্তুকি রয়েছে, তাতে একেবারে উঠিয়ে দিলে দাম সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। তবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, জীবনযাত্রার ব্যয় এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ মেনেই ভর্তুকি থেকে পর্যায়ক্রমে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। বিদ্যুতের দামে অর্থ বিভাগ ভর্তুকি সহায়তা দেয়। ফলে ঠিক কী পরিমাণ ভর্তুকি সরকার দিতে পারবে সে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎ বিভাগ। ভর্তুকি পাওয়ার পর ঠিক কী পরিমাণ দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে সেটিও দেখভাল করছে তারা।
বিদ্যুতের অব্যাহত লোকসানের চাপ সামাল দিতে না পেরে গত বছর তিন দফা খুচরা পর্যায়ে মোট ১৫ শতাংশের কিছু বেশি দাম বাড়ানো হয়। এর মধ্যে গত বছরের ১২ ও ৩১ জানুয়ারি এবং তৃতীয় দফায় বিদ্যুতের খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি। এছাড়া ২০২২ সালের নভেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় মোট ২৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
এর পরও বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ ক্রমে বেড়ে চলেছে। এক সময়ের ১২ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি এখন ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোর কাছে বিপুল পরিমাণ দেনা বাড়ছে সরকারের। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সম্প্রতি বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির বিপরীতে এ খাতে অর্থায়নকারী ব্যাংকগুলোর অনুকূলে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে অন্তত চার ধরনের খরচ রয়েছে। এসব খরচ হিসাব করলে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার হয় (গত অর্থবছরের হিসেবে) ১২ টাকা ১১ পয়সা। অন্যদিকে বিদ্যুতের পাইকারি দাম রয়েছে ৬ টাকা ৭০ পয়সা। প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতে ভর্তুকি প্রায় ৫ টাকা ৪১ পয়সা। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিক্রি পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ এ ভর্তুকির কারণে বিপিডিবির দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। এ পরিস্থিতি থেকে এখন বের হতে চায় সরকার। বিশেষ করে বিদ্যুতের লোকসান থেকে বের হতে দাম বাড়ানো অনিবার্য হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা সংস্থা পাওয়ার সেল।
সংস্থাটির মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘লোকসান ও ভর্তুকির বৃত্ত থেকে বের হতে হলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এটা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোও দামসংক্রান্ত বিষয়টি নিয়ে ভুগছে। তবে সরকারের পরিকল্পনা হলো এমন একটা প্রাইস, যেখানে ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দেয়া না হয়। আগের বৃদ্ধির মতো একটা সহনীয় পর্যায়ে দাম বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে।’
আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংস্থা আইএমএফের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের ভর্তুকি কমিয়ে আনার চাপ রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে সরকারও বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করতে চায়। দাম বাড়ানো হলেও সরকার চাইছে সেটি যেন মানুষের জন্য সহনীয় পর্যায়ে থাকে।
বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে অনেকদিন ধরেই গাণিতিক হিসাবনিকাশ করা হচ্ছে। শিগগিরই দাম বাড়বে কিনা সেটি আমার জানা নেই। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে রোজার পরে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে।’
Bonikbarta