১৮ এপ্রিল ২০২৩
মাহমুদুর রহমান
বাংলাদেশে চলমান ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন একটি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই পরিণতিতে জনগণের মুক্তি মিলবে নাকি ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদ টিকে যাবে তার ভবিষ্যৎবাণী করা আজকের সম্পাদকীয় লেখার উদ্দেশ্য নয়। তাছাড়া, আমাদের কাজ কেবল নিজ জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করা, ভবিষ্যৎ একমাত্র “আলিমুল গায়িব” জানেন। অতীত ঘেটে দেখা গেছে বাঙ্গালী মুসলমানের লড়াই-সংগ্রামে মীরজাফরদের অভাব কোন কালেই হয় নাই। ২০২৩ সালে নবাব সিরাজের সেই বর্ষীয়ান, বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি মীরজাফররাই নাম বদলে জয়িফ উকিল সাত্তার হয়ে গেছে। এরা বৃদ্ধ কিংবা মাঝ বয়সী কিংবা তরুন, সব বয়সের হতে পারে। এদের একটাই চরিত্র। অবিশ্বস্ত, বিষাক্ত, আস্তিনের সাপ। ফ্যাসিস্ট হাসিনার মালিকানাধীন বাংলাদেশে আসন্ন পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনী তামাশা প্রসঙ্গেই এদের নিয়ে আলোচনা আবশ্যক।
২০১৬ সালের নভেম্বরে দুই দফায় প্রায় পাঁচ বছর কারাভোগের পর বাংলাদেশ নামক বৃহত্তর কারাগারে বের হয়ে বিএনপির নীতিতে আমি দুটি পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলাম। এক, তাদের মধ্যে ধারনা জন্মেছিল যে, মোদি হয়ত কংগ্রেসের মত অন্ধভাবে শেখ পরিবার এবং আওয়ামী লীগকে সমর্থনের নীতিতে পরিবর্তন আনবেন। সেক্ষেত্রে বিএনপিও দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আধিপত্যবাদ এবং সেদেশে মুসলমান নিগ্রহ নিয়ে নিরব থাকবে। আর দুই, ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল এবং পরবর্তী নির্বাচনে শেখ হাসিনার অধীনে অংশ নিয়েই রাজনীতিতে টিকে থাকতে হবে। বলাই বাহুল্য, কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া পর্যন্ত আমার সকল বক্তব্যে আমি উভয় মতের বিরোধিতা করে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের বিরাগভাজন হয়েছিলাম। যেহেতু, আমি সর্বদা ব্যক্তি ও সম্পাদকের অবস্থান থেকে আমার মতামত ব্যক্ত করেছি, কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই আনুষ্ঠানিক কোন সংশ্রব রাখি নাই, কাজেই এই বিরাগ-অনুরাগ আমাকে বিব্রত করে না।
উপরোক্ত চিন্তার প্রেক্ষিতেই ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেগম খালেদা জিয়াকে সম্পূর্ণ ভুয়া মামলায় আওয়ামী আদালত সাজা দিলেও তার প্রতিবাদে কোন কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলার পরিবর্তে বিএনপি ডিসেম্বরের নির্বাচনকেই অগ্রাধিকার দেয়। সেই সুযোগে ভারতের এজেন্টরা বিএনপির আশেপাশে কেবল ভিড়ই জমায় নাই, বিস্ময়করভাবে এক সময় ড: কামাল দলটির নেতৃত্ব দখল করে ফেলেন। দেখা গেল নিজেরই প্রতিষ্ঠিত দলে অবিশ্বাস্যভাবে স্বয়ং শহীদ জিয়াই অপাঙ্তেয় হয়ে গেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবির মধ্যেও আড়ষ্টতা বিদ্যমান। কেবল তাই নয়, নির্বাচনের প্রাক্কালে ড: কামালের নেতৃত্বে গণভবনে অবৈধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আলোচনার নামে তার ফ্যাসিস্ট শাসনকে এক প্রকার বৈধতাও প্রদান করা হয়। নিশিরাতে পুলিশ দিয়ে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলার সেই হাসিনা মডেল নির্বাচন জাতীয়তাবাদী দলের মূল নেতৃত্বের সম্বিত ফেরাতে সমর্থ হলেও আস্তিনের সাপেরা তাদের বিষাক্ত ফনা তখন থেকেই একটু একটু করে বের করতে আরম্ভ করে।
পাঠকদের হয়ত স্মরণে আছে যে, গণতান্ত্রিক বিশ্বে প্রত্যাখ্যাত নির্বাচনের ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব সঠিক ও সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফলাফল প্রত্যাখ্যান এবং সাজানো সংসদে যোগ না দেওয়ার ঘোষণা প্রদান করেছিলেন। শেখ হাসিনা দেশবাসী ও বিশ্ব জনমতকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিএনপিকে যে সাতটি আসনে বিজয়ী ঘোষণা করবার নাটক করেছিলেন তার মধ্যে বগুড়ায় শহীদ জিয়ার জন্মভূমির আসনটিও ছিল। সেই আসনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা আলমগীরকে বিজয়ী ঘোষণা করা হলেও তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। অথচ, ধানের শীষের বাকী যে কয়জনকে শেখ হাসিনা কৃপা করে সংসদ সদস্য বানিয়েছিলেন তারা কেউ সেই লটারিপ্রাপ্ত সুযোগসুবিধা ত্যাগ করতে সেদিন সম্মত হন নাই। দলের উপর নানা প্রকারে চাপ প্রয়োগ করে তারা সেদিন ড: কামালের দুই চেলা, সুলতান মনসুর এবং মোকাব্বির খানের হাত ধরে ভুয়া সংসদে প্রবেশ করেছিলেন। উকিল আবদুস সাত্তার এদের অন্যতম ছিলেন। সেই আস্তিনের সাপের খেলা আমরা সর্বশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তথাকথিত উপনির্বাচন পর্যন্ত দেখেছি।
আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে বিএনপির মধ্যকার আরো কয়েকটি আস্তিনের সাপের ক্রমশ: উদ্যত ফনার কথা বাংলাদেশের সরকারি বিভিন্ন এজেন্সি নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন আরো তীব্র রূপ পরিগ্রহণের বেশ আগে এদেরকে চিনে নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরী। খানিকটা বিলম্বে হলেও ২০২২ সাল থেকে বিএনপি নেতৃত্ব সঠিক রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছে বলেই আমরা মনে করি। শেখ হাসিনার অধীনে কোন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করবার সুস্পষ্ট ও আগাম ঘোষণা বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট শাসনের মূল ভিত্তি কাঁপিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে। গণতান্ত্রিক বিশ্বও বিএনপির এই গণতান্ত্রিক ও যৌক্তিক অবস্থানের প্রতি দৃশ্যত: সহানুভূতিশীল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং সকল দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে বধ্যপরিকর। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রির সাথে সাম্প্রতিক আনুষ্ঠানিক বৈঠকে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট নির্বাচনের উপর জোর দিলেও তার জবাবে আবদুল মোমেনকে একটি শব্দ উচ্চারণ করতেও শোনা যায় নাই। কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গিয়েই নির্বাচন নিয়ে কথা বলার মত কোন আইনগত অথবা নৈতিক অবস্থান বাংলাদেশের অবৈধ, ফ্যাসিস্ট সরকারের কোন মন্ত্রির নাই। অতএব বিদেশে নীরব থাকা ছাড়া এদের আর কোন উপায় নাই। দেশে ফিরে তারা অবশ্য বৈঠকের বিষয়বস্তু নিয়ে মিথ্যার ফুলঝুড়ি ছোটাতে এক মুহূর্ত বিলম্ব করেন না। অপরদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাইডেন প্রশাসনের মত একেবারে পরিষ্কার অবস্থান এখন পর্যন্ত না নিলেও, এই পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে যে তারা ঘোষণা দিয়েছে, বিএনপি নির্বাচনে না এলে কেউ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। অর্থাৎ ২০১৪ কিংবা ২০১৮ মার্কা নির্বাচনকে কোনরকম বৈধতা দেওয়া হবে না।
উপরোক্ত ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি শেখ হাসিনার সরকার পতনের এক দফা দাবি নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে গণ আন্দোলনের ডাক দিলে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি ত্বরান্বিত হতে পারে। তবে তার আগে দলের অভ্যন্তরের আস্তিনের সাপদের সনাক্ত করে তাদের অনতিবিলম্বে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়াটা জরুরী। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যে ব্যক্তি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে যে কোন পর্যায়ে নির্বাচনে আগ্রহ প্রকাশ করবে সে নিশ্চিতভাবেই ফ্যাসিবাদের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। এরা দলের জন্য কেবল বোঝা নয়, উপরন্তু, চূড়ান্ত আন্দোলনের সময় তাদের বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার আশংকা রয়েছে। বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীকে শেখ হাসিনা হত্যা করেছে, লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী এক একজন শত শত ভুয়া, রাজনৈতিক মামলা নিয়ে ফেরারী, অভূক্ত ও অনিশ্চিত জীবন যাপন করছে, অথচ দলে ঘাপটি মেরে থাকা উকিল সাত্তার গং এই দলের প্রতি অনুগত এই তৃণমূলের কর্মীদের ব্যবহার করে হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আবারও লটারিপ্রাপ্তির স্বপ্ন দেখছে।
শোনা যাচ্ছে, খুলনা, সিলেট এবং গাজিপুরের বিএনপির কোন কোন নেতা এ বিষয়ে রহস্যজনক আচরণ করছেন। তাদেরকে আর সময় দিলে এরা দলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার সুযোগ পাবে। বিশ্বাসঘাতকদের পিছনে রেখে কোন যুদ্ধেই জয়লাভ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের জনগণের অধিকার এবং রাষ্ট্রের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের যুদ্ধে বিএনপি সফল নেতৃত্ব দিতে চাইলে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বকে এদের বিষয়ে সময়ক্ষেপন ব্যতিরেকে এখনই কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। কেউ কেউ যুক্তি তুলতে পারেন যে, স্থানীয় প্রভাবশালী এই সকল নেতাদের দল থেকে বের করে দিলে সরকারবিরোধী আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। কিন্তু, একবার যারা একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের এজেন্সি দ্বারা পরিচালিত হয়, তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে কোন আন্দোলনই সফল হতে পারে না। এরা সর্বদা ফ্যাসিবাদের ট্রয়ের ঘোড়া হিসেবেই তাদের ভূমিকা পালন করবে। উকিল সাত্তার সেটা দেশবাসীকে দেখিয়ে ফেলেছেন। শেখ হাসিনার পতন ব্যতিরেকে কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করবার সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব অবিচল থাকবেন বলেই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ
১৮/০৪/২০২৩