মেজর জিয়াউর রহমান আর্মির মানুষ ছিলেন। তবে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানকে কোনোভাবেই কেউ খাটো করতে পারবে না। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ‘উই রিভোল্ট’ এর মতো কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করে গোটা জাতিকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। সারা দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের দিকে ধাবিত করেছিলেন। সেই ইতিহাস তৈরি করার ক্রেডিটটা তাকে দিতেই হবে। তিনি এ ঘোষণায় শুধু নিজের নাম বলতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন মেজর জিয়া। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধের মুক্তিবাহিনীর প্রথম সামরিক ব্রিগেড জেড ফোর্সে গঠন করা হয়। বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান সেই ব্রিগেডের কমান্ডার হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।
বাংলা আউটলুককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্র নায়ক জিয়াউর রহমানকে এভাবেই মূল্যায়ন করেছেন বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আকবর খান রনো। ২০১২ সালে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি অসুস্থ। তবে এর মধ্যেও সময় দিয়েছেন তিনি।
জিয়াউর রহমান সম্পর্কে হায়দার আকবর খান রনো আরো বলেন, আমরা বুঝে শুনেই বঙ্গবন্ধুর বাকশাল করার বিযয়টার বিরোধিতা করেছিলাম। সেখানে আর্মির ব্যারাক থেকে আসা জিয়া দেশে বহু দলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেছিলেন। বিষয়টা আওয়ামী লীগ কেন এ দেশের প্রতিটা জনগণের অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই। তবে দেশে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি এলাও করা এবং সংবিধানে ’বিসমিল্লাহ’ নিয়ে আসাকে আমি সমর্থন করি না।
বাংলা আউটলুক : বাংলাদেশের জানুয়ারি মাসের জাতীয় নির্বাচন এবং ভারতের নির্বাচন আর দেশে ‘ভারত খেদাও’ আন্দোলনের নিয়ে কিছু বলবেন?
হায়দার আকবর খান রনো: দেখছেন তো আমার শারীরক অবস্থা। যেহেতু আমি কোনো ধরনের অ্যাক্টিভ পলিটিক্সে নাই। ফলে আমার পার্টির যা বলবে আমারও সেই সিদ্বান্ত । আমি বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টিতে আছি। এ বিষয়ে পার্টির বক্তব্যই আমার মতামত। একটা দেশের নির্বাচন নিয়ে বিশেষ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের নির্বাচন নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না। তবে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি একটা হাইলি রিএকশানারি দল। তারা যেনতেনভাবে কয়েকবার ভারতের সরকার গঠন করেছে। অন্যদিকে একটা সময় আমার সঙ্গে সিপিআইএমের সৌহাদ্যপূর্ণ সর্ম্পক ছিল। এখন তো আর থাকার কথা না। আর ‘ভারত খেদাও’ আন্দোলনের বিষয়ে আমার পাটির বক্তব্য আছে। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না ।
বাংলা আউটলুক : এখন আপনার শারীরিক অবস্থা কেমন?
হায়দার আকবর খান রনো : দেশে মহামারি সময়ে আমারো করোনা হয়েছিল। আমি ১৩ দিন হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলাম। আমার পাশের বেডের দুই জন মানুষ মারা গেল। সেভেন ডেতে ডাক্তার বলে দিয়েছিল আমি আর বাঁচবো না। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ব্রিগেডিয়ার নাসিম আমার অসাধারণ কেয়ার নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার খোঁজ নিয়েছেন। এক ঝুঁড়ি আম এবং এক ঝুঁড়ি লিচু পাঠিয়েছিলেন। অসুস্থ থাকার কারণে আমি অবশ্যই এসব কিছুই খেতে পারিনি।
বাংলা আউট লুক: কলকাতার শৈশব স্মৃতি নিয়ে কিছু বলেন?
হায়দার আকবর খান রনো :কলকাতায় আমার অনেক স্মৃতি আছে । শৈশবে অনেক ভাল এবং বড় ধরনের দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে আমার জীবনে। আমার জন্ম হয়েছে ১৯৪২ । তবে ১৯৪৬ সালের ১৬ ই আগাষ্টে মুসলিম লীগের প্রধান জিন্নাহ, মোহাম্মদ আলী সাহেব ডিক্লিয়ার করেছিলেন ’ডাইরেক্ট অ্যাকশন” । তখন আমার মাত্র চার বছর বয়স ।প্রথম যে বাড়িটি আক্রান্ত হয়েছিল সেইটি কলকাতার আহমেদ স্ট্রিটের পাশে ৬৬ বৈঠক খানা রোডের আমাদের বাড়ি ।কলকাতায় কোন হিন্দু উগ্রপন্থীরা আমাদের বাড়ি অ্যাটাক করেনি । মুসলিমরা আমাদের বাড়ি অ্যাটাক করেছিল । পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের আদর্শিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে আমাদের বাড়ি অ্যাটাক করা হয়েছিল । সেই সময় ঘটনাক্রমে আমার বাবা আবার আমেরিকা ছিলেন । উচ্চতর শিক্ষার জন্য ব্রিটিশ ভারত সরকার তাকে আমেরিকা পাঠিয়েছিলেন । উনি ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন সরকারি চাকরিও করতেন ।পুলিশ না আসলে আমাদের পরিবারের সবাই বোধ মারা পড়তাম । মুসলিমরা আমাদের বাড়ি আক্রমণ করেছিল কারণ আমার নানা কংগ্রেস করতেন। তিনি পাকিস্তান জন্মের বিরুদ্ধে ছিলেন। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা ওপারে কয়েকটা ছেলে আমাদের বাসায় অ্যাটাকের বিষয়টি পুলিশের জানিয়েছিল । তখন পরিবারটিকে রক্ষার জন্য পুলিশ আমাদেরকে থানায় নিয়ে যায়। এক সময় দেখলাম হিন্দুরাও আমাদের বাড়ি আক্রমণ করতে পারে। দূর থেকে দেখলাম কলকাতা বড় বাজারের হিন্দুরা আগুন লাগাছে এবং রাম দা ছুরি আর তলোয়ার নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছি। বাবা আমেরিকা থেকে এসে বললো ’চল বরিশাল যাই’। কিন্তু তখন ওখানে হিন্দু মুসলমান ভয়াবহ রায়াট হয়েছে । ওখানে মুসলামরা হিন্দুদেরকে হত্যা করেছে ।
বাংলা আউট লুক : আরো কোন স্মৃতি আছে কলকাতায় ?
হায়দার আকবর খান রনো : আমার তখন হাফপ্যান্ট পড়ার বয়স ।আমি আমাদের বৈঠকখানা রোড়ের বাসায় কমরেড মোজাফ্ফর আহমেদ এবং তার মেয়ে দেখেছি, জ্যাতি বসু দেখেছি । পরবর্তী কালে তাদের আমি অন্যভাবে দেখেছি । আমার ’শতাব্দী পেরিয়ে’ বইতে আমি এসব লিখেছি । ১৯৪৬ সালের রায়েটের চেয়ে ১৯৫০ সালের রায়েট অনেক বড় হয়েছে । ১৯৪৬ সালে হিন্দু মুসলাম রায়াট নিয়ে জয়া চ্যাটার্জির একটা বই আছে । দেবেশ রায়ের বরিশালের রায়াট নিয়ে উপন্যাস আছে। নাম ’বরিশালের যোগেন মন্ডল’।
বাংলা আউটলুক : রাশেদ খান মেনন সম্পর্কে কিছু বলবেন
হায়দার আকবর খান রনো : রাশেদ খান মেনন সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৫২ সালের যশোর জেলা স্কুলে ক্লাশ ফাইভে । আমরা পারি দিয়েছি দীর্ঘ পথ । দুর্যোগের রাত পাশাপাশি হাত ধরে হেঁটেছি । ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব তো এখন আছে । কিন্তু ২০০৮ সালের আওয়ামী লীগ জোট সরকার যে নির্বাচনে ক্ষমতায় এসেছিল,সেই নির্বাচনের আমাদের রাজনৈতিক মত পার্থক্য হয়ে গেল । ওয়ার্কাস পাটি হচ্ছে কমিউনিস্ট পাটি । আমাদের মার্কা ছেড়ে দিয়ে কেমন ভাবে মেননরা নৌকা নিয়ে নির্বাচন করতে চেয়েছিল । আমি তার বিরোধিতা করেছি । এটা আমি কোনোভাবে মেনে নিতে পারিনি । নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচন করবে সেটা ওয়ার্কাস পাটির সিদ্ধান্তের বাইরে ছিল । আগে সেন্ট্রাল কমিটির সিদ্বান্ত ছিল আওয়ামী লীগের সাথে জোট করতে পারি কিন্তু নিজস্ব মার্কা করবো । সে যখন বিষয়টি মানলো না, কি আর করা আমি বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলাম ।
বাংলা আউটলুক : রাশেদ খান মেননের স্বৈরশাসক সরকারের এমপি হিসেবে এখন তার অবস্থান সর্ম্পকে কিছু বললেন ?
হায়দার আকবর খান রনো : হাসতে হাসতে এ বিষয়ে আমি কিছু বলবো না । আমার সাথে মেননের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব আছে , তার রাজনীতি তার আর আমার রাজনীতি আমার । আমার বইতে রাশেদ খান মেননের কথা আছে ।
বাংলা আউটলুক : স্বৈরশাসকের আসল রূপ নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে জোর করে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আছে এ বিষয় আপনি কিছু বলবেন কি না ?
হায়দার আকবর খান রনো : এ বিষয়ে আমার পার্টির মতামতই আমরা বক্তব্যই । হাসতে হাসতে বুঝতে পেরেছি রাজনৈতিক বক্তব্য না দেওয়া ফলে আপনার প্রশ্ন গুলো কমে গেছে ।
বাংলা আউটলুক : বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটিতে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতে শুনা গেছে এ বিষয় আপনার কি মত ?
হায়দান আকবর খান রনো : বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি ছিল অসাধারণ প্রতিভাদীপ্ত বিষয় । তখন তিনি পাকিস্তানের ইলেকশন করে জিতে এসেছিলেন।তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন তাই তাকে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতেই হবে। সুতরাং পাকিস্তান জিন্দাবাদ ছাড়া অন্য কিছু তার মাথা থাকার কথা না । এখন দেখছি সেই ভাষণটাতে কাটছাঁট করে জয় বাংলাদেশ ঢুকানো হয়েছে। এর কোনো দরকারই ছিল না ।
বাংলা আউটলুক : মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল?
হায়দার আকবর খান রনো : আমি, মেনন, ও কাজি জাফর ইন্ডিয়ায় জিয়াউর রহমান,খালেদ মোশাররফ এবং শফিউল্লাহ সাথে দেখা হয়েছিল। তখন এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের রণ কৌশল নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল। এরাই আমাদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। এখন অনেকেই বলেন জিয়া সন্মখ সমরে যুদ্ধ করেনি এ কথা কোনোভাবেই ঠিক নয়। তবে আমরা বেশি ভাগ অস্ত্র জোগাড় করেছি যুদ্ধ করে অথবা পাকিস্তানের আর্মির ফেলে দেওয়া অস্ত্র। আমরা মোট ২৩ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম এবং এর মধ্যে দেশের জন্য ১০০ জন শহীদ হয়েছিলেন। আমরা সারা বাংলাদেশের ১৪ টি জায়গায় যুদ্ধ করেছিলাম। এর মধ্যে রয়েছে চিটাগং, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ,টাঙ্গাইল ও বরিশাল।
বাংলা আউটলুক : আপনি বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের মানুষ ছিলেন ?
হায়দার আকবর খান রনো : আমি কখনই বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের ছিলাম না । আমি কখনও তার দল করিনি । সেটা আলাদা কথা । কিন্তু উনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন ।বঙ্গবন্ধু প্রধানত একজন জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন । জাতীয়তাবাদী নেতাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সহজে তারা নতি স্বীকার করে না । এ বিষয়টি সত্য যে কোন জাতীয়তাবাদ নেতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ , মিসরের নাসের জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন । তিনি কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে না বললে স্বাধীনতার পর ভারতীয় সেনা বাহিনী ঢাকা ছেড়ে যেত না । তবে তিনি দেশে বাকশালের রাজস্ব কায়েম করেছিলেন তা আমি সমর্থন করি না । তাকে অনেকে বলে তিনি প্র- ইন্ডিয়া । বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে সত্য ।
বাংলা আউটলুক : বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী ?
হায়দার আকবর খান রনো : দেখেন এই মুহূর্তে আমাদের ভবিষ্যৎ খুবই খারাপ । সারা পৃথিবীতে সঙ্গে বাংলাদেশেও আমরা ভাল অবস্থানে নেই । সারা পৃথিবীতে মৌলবাদ এবং স্বৈরশাসনের দাপট চলছে । এই মুহূর্তে পৃথিবীর কোথায় সোসালিজম নাই । রাশিয়ায় অফিসিয়ালি সোসালিজম নাই, চায়না সোসালিজমের কথা বলেও তার ছিঁটে ফোঁটাও নেই সেখানে ।কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসের শেষ এখনো ঘোষিত হয়নি। আমি আশাবাদী । রবীন্দ্রনাথ তার যে শেষ বক্তৃতায় ’সভ্যতার সংকটে’ বলেছেন মানুষের প্রতি বিশ^াস হারানো পাপ । আমিও সেটা বিশ্বাস করি। হেমিং ওয়ের স্প্যানিশ গৃহযুদ্বের ওপর লেখা বইয়ের কথা বললো ’সান অলসো রাইজেস’ কথা বললো সান সেট বাট সান আসলো রাইজেস । আমিও তাই মনে করি । ফলে আমি মানুষ ওপর আস্থাশীল । আমেরিকার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার বলেছিলেন দ্য এন্ড অফ হিস্ট্রি । সুকিয়ামা বলছেন তা এন্ড অফ দা হিস্টরি । সুকিয়ামা তো আমেরিকার একজন ডাচ কর্মচারী । উঁচুমাপের আমলা ।
বাংলা আউটলুক : এতো শারীরিক অসুস্থতার মধ্যে বাংলা আউট লুককে সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই ।
হায়দার আকবর খান রনো : আপনাকে ধন্যবাদ ।
bangla outlook