ইসি ‘রাতের ভোট’ থেকে কী পাঠ নিচ্ছে

 

নির্বাচন কীভাবে হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধ যখন তুঙ্গে, তখন আমাদের নির্বাচন কমিশন (ইসি) অরাজনৈতিক মতবিনিময়ে বেশ মনোযোগী হয়েছে। আজও সে রকম একটি আলোচনার আয়োজন হয়েছে গণমাধ্যমের প্রত্যাশা ও ভূমিকা নিয়ে। মাত্র মাসখানেক আগেও এ রকম আরেকটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টভাবে কয়েকবার সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিয়েছেন।

১৩ সেপ্টেম্বরের ওই সভায় তাঁর বক্তব্যে মনে হয়, তিনি এ আশ্বাসে খুব নিশ্চিন্তবোধ করছেন। সম্ভবত সে কারণেই তিনি বলেছেন, ‘এর আগে কোনো সরকার কখনো এমন প্রতিশ্রুতি দেয়নি। এই প্রথমবার সরকারপ্রধান এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ জন্য আমি বলব, আস্থা রাখতে চাই।’

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কবে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তা আমাদের জানা নেই। অন্তত সংবাদমাধ্যমে কোনো খবর চোখে পড়েনি। নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলগুলোর আপত্তি ও অবিশ্বাসের কারণগুলো নিয়ে কমিশন কি সত্যিই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোনো আলোচনা করেছে, নাকি প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক বক্তব্যেই তাঁদের আস্থা? তাহলে যারা দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না বলে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে, তাদের বক্তব্যের কি কোনো গুরুত্ব নেই বা তা সরকারবিরোধীদের বলে উপেক্ষণীয়?

বর্তমান সরকারের আমলে সব নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে, এ দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর থেকে মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সব সময়েই বলে এসেছেন। বিভিন্ন সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং সংসদীয় উপনির্বাচনের কথা উল্লেখ করে তাঁরা দাবি করেন, ‘আমরা প্রমাণ করেছি যে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন নির্বাচন অবাধ হতে পারে এবং এর বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করতে পারে না।’

২০১৮ সালের রাতের ভোটকেও অস্বীকার করে বলা হয়েছে, নির্বাচনটি যথাযথভাবে হয়েছে। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা এবং বিএনপির নেতৃত্বহীনতা, কথিত মনোনয়ন–বাণিজ্য ও নির্বাচনী প্রচারে সমন্বয়হীনতার কারণে বিরোধীরা সুবিধা করতে পারেনি। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সুষ্ঠু, অবাধ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিতে শুরু করায় তাদের চাপ মোকাবিলায় ক্ষমতাসীনেরা তাঁদের কথা আরও জোরেশোরে প্রচারের জন্য নেমে পড়েছেন।

গত এক দশকে নির্বাচনব্যবস্থার হাল আসলে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা নির্বাচন কমিশন কার্যত অস্বীকার করছে বলেই মনে হচ্ছে। বর্তমান কমিশনের অধীন যেসব নির্বাচন হয়েছে, তার কটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল? কেন সেগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়নি? যেগুলোতে সামান্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা গেছে, দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে সেগুলোর সবই যে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াই, তা কি তাঁদের নজরে পড়েনি? ক্ষমতাসীন দলের আনুষ্ঠানিক মনোনয়নই যে শেষ কথা, ভোটারদের পছন্দের অধিকার যে এখন মূল্যহীন হয়ে পড়েছে, তা কি কমিশন অনুধাবন করতে অক্ষম?

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনাররা স্মরণ করতে না চাইলেও পরপর দুটি নির্বাচনে ভোট দিতে না পারা ভোটাররা তাঁদের অভিজ্ঞতা কীভাবে ভুলবেন? আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে ক্ষমতাসীনেরা ছাড়া অন্য দলগুলোর কাজকর্ম খুব নিয়ম মেনে হয় না। ফলে সবকিছুর তথ্য হাতের নাগালে থাকে না, চাইলেও পাওয়া যায় না। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন কীভাবে হয়েছে, তার বিবরণ নথিভুক্ত করে কেউ তা প্রকাশ করেছেন বলে শুনিনি। কোনো গবেষকও স্ব-উদ্যোগে কোনো কিছু প্রকাশ করেছেন বলে চোখে পড়েনি। সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে তাই অতি সহজেই বিকল্প ভাষ্য হিসেবে নিজেদের ‘স্ট্রং ম্যান্ডেট’ পাওয়ার দাবি প্রচার করা সম্ভব হচ্ছে।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন তৎকালীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ২০১৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে এবং সিপিবিসহ বাম দলগুলোর জোট তার আগে ১১ জানুয়ারি আলাদাভাবে দুটি গণশুনানির আয়োজন করেছিল। ঐক্যফ্রন্টের শুনানিতে প্রায় দেড় শ প্রার্থী উপস্থিত ছিলেন এবং কয়েক ডজন প্রার্থী তাঁদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। বাম জোটের গণশুনানিতে তাদের ১৪৭ প্রার্থীর মধ্যে ৮০ জন তাঁদের আসনে ভোট কেমন হয়েছিল, তা তুলে ধরেন। আমরা শুধু আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তির কথা শুনি, কিন্তু বাম জোট যাকে ‘ভোট ডাকাতি, জবরদখল ও অনিয়মের চিত্র’ নাম দিয়ে শুনানি করেছে, সেই ডাকাতি ও জবরদখলের কথা আলোচনা করতে দেখি না

প্রয়াত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার তাঁর নির্বাচননামা বইয়ে অনেক অজানা তথ্য দিয়ে লিখেছেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের ভোটচিত্র বলে দেয়, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। অনিয়মের দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ১০৩টি আসনের ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। ১ হাজার ২০৫টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ। এগুলো অবাস্তব বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।

নির্বাচনে বিএনপির জোট ঐক্যফ্রন্টকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে শুধু যে তাদের ওপরেই নানা ধরনের হয়রানি, হামলা, ভোট দিতে না দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে, তা-ই নয়। বামফ্রন্টের প্রার্থীদেরও ন্যূনতম অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়নি। বরিশালের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী আব্দুস সাত্তার ভোটের দিনে সকাল ১০টায় তাঁর এজেন্টদের তুলে নিয়ে গিয়ে বিকেল চারটা পর্যন্ত অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখার কথা বলেছেন।

রাজশাহীর বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের প্রার্থী আলফাজ হোসেন বলেছেন, নির্বাচনী প্রচারের সময়ে ২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয়ে তাঁকে কালো গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে পরদিন দুপুরে একই জায়গায় এনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে এ রকম নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য প্রতিপক্ষকে উঠিয়ে নেওয়া এবং আটকে রাখার ঘটনা এরপর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও শোনা গেছে। এসব সাময়িক গুমের ঘটনায় কমিশন নির্বিকার থেকেছে এবং প্রশাসনও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

উভয় শুনানিতে মোটামুটি অধিকাংশের অভিন্ন অভিযোগ ছিল—প্রশাসন ও পুলিশ আগের রাতে ব্যালট বাক্সে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ ভোট ভরে রেখেছে, ভোটের দিন অন্য প্রার্থীর এজেন্টদের ঢুকতে দেয়নি, কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের কর্মীরাই অন্য প্রার্থীর এজেন্টের পরিচয়ে ব্যাজ নিয়ে কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণের কাজ করেছেন, নির্বাচনী কর্মকর্তারা কোথাও ভিন্ন দলের প্রার্থীদের অভিযোগ আমলে নেননি। বিরোধী দলের প্রার্থীদের অভিযোগের বেলায় প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকা কী, তার অবশ্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য আছে নির্বাচননামা বইয়ে। কমিশনের ভেতরেও আইন ও নীতিনৈতিকতা অনুসরণে যে কী ধরনের বাধার মুখোমুখি তিনি হয়েছেন, সে কথাও বইটিতে আছে।

বাম জোটের শুনানিতে নরসিংদী-৪ আসনে কাস্তে মার্কার প্রার্থী সিপিবির কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন জানান, তাঁর নির্বাচনী এলাকায় একটি ভোটকেন্দ্রের এক প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নির্বাচনের আগের দিন তাঁর কাছে স্বীকার করেন, প্রশাসনের নির্দেশ আছে, ৩৫ শতাংশ ভোটের সিল যেন নির্বাচনের আগের রাতেই দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের চাপে পড়ে তা ৪৫ শতাংশ হয়ে গেছে। সাতক্ষীরার সিপিবির প্রার্থী আজিজুর রহমান তাঁর প্রচারে আওয়ামী লীগের হামলার পাশাপাশি অভিযোগ করেন যে পুলিশ তাঁকে জানিয়ে দেয়, সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না।

এ রকম হামলার ঘটনা অসংখ্য এবং এগুলো বেশি ঘটেছে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। দুদিন আগে আওয়ামী লীগের সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবু সাইয়িদ একটি পত্রিকায় লিখেছেন, পুলিশের সামনে তাঁর দুটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। তাঁর ওপর হামলা হয়েছে কমপক্ষে ১৮ বার।

প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের দলীয়করণের কারণে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে এবং ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা উপেক্ষা করে সরকারের রাজনৈতিক আশ্বাসে কমিশনের আগাম আস্থা প্রকাশ বরং তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ বাড়িয়ে দেয়।

  • কামাল আহমেদ সাংবাদিক

সূত্র : প্রথম আলো