ইসি গঠনে প্রতারণা ও প্রস্তাবনা


খুব শিগগিরই শেষ হতে যাচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ। আগামী ফেব্রুয়ারি নাগাদ অবশ্যই একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। এরকমই আইনগত বাধ্যবাধকতা। সঙ্গত কারণেই ইসি গঠন নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ কিছুটা জমে উঠেছে। সরকার আগের মতোই সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে চায়। আর বিরোধী দল নির্বাচন কমিশন নিয়ে যতটা আগ্রহী হওয়ার কথা, ততটা আগ্রহী নয়। আর সিভিল সোসাইটির লোকেরা দিচ্ছেন নানা প্রস্তাবনা। সবারই লক্ষ্য আগামী নির্বাচন।

 

আইন করলে যাকে ইচ্ছা তাকে তো নিয়োগ দেয়া যায় না। সংবিধানের আলোকে প্রত্যাশিত আইন না থাকার কারণে প্রতিবারই জটিলতা দেখা দেয়। এবারো এই জটিলতা অবসানে নানা প্রস্তাবনা পেশ করছে সুশীলসমাজ। স¤প্রতি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে আইনপ্রণয়নের আহ্বান জানিয়ে এবং এ বিষয়ে আইনের কাঠামোগত সহায়তা দিয়ে সরকারকে সাহায্য করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা। এদের মধ্যে রয়েছেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান, রাশেদা কে চৌধুরী, বিচারপতি আবদুল মতিন এবং আকবর আলি খান। বিবৃতিতে তারা বলেন, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হবে আইন প্রণয়ন করা।

 

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন অভিযোগ করেন, এ টি এম সামশুল হুদা কমিশন নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ২০১১ সালে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইনের একটি খসড়া মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিলেন। তারপর এটি আর আলোর মুখ দেখেনি। তিনি আরো অভিযোগ করেন, বড় কোনো দল এই আইনপ্রণয়ন নিয়ে সচেষ্ট, এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বর্তমান কমিশনের মেয়াদ আছে আর মাত্র চার মাস। যদিও সঙ্কীর্ণ সময়, তবুও সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এই সময়ের মধ্যেও আইন প্রণয়ন সম্ভব। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব অবশ্য অন্য কথা বলেন। তিনি নির্বাচন কমিশন নিয়োগের চেয়ে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। জনাব মজুমদার বলেন, এককেন্দ্রিক সরকার যেভাবে চায় সেভাবেই নির্বাচন হবে। এখানে পরিবর্তন না হলে অতীতে যেভাবে নির্বাচন হয়েছে সামনেও তা-ই হবে। তিনি আরো বলেন, অতীতের সার্চ কমিটিতে যারা ছিলেন তারা অযোগ্য ছিলেন না। কিন্তু সরকার যাদের চায় প্রকারান্তরে তারাই নিয়োগপ্রাপ্ত হন। উল্লেখ্য, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন কেমন হতে পারে, তার একটি প্রাথমিক খসড়া তৈরি করেছে সুজন। ওই আলোচনায় খসড়াটি তুলে ধরা হয়। খসড়ায় নির্বাচন কমিশন নিয়োগের লক্ষ্যে সাবেক জ্যেষ্ঠতম প্রধান বিচারপতিকে আহ্বায়ক করে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। এতে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য কিছু যোগ্যতা নির্দেশ করা হয়েছে। সুজনের প্রস্তাব কমিটি নাগরিকদের কাছ থেকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নাম আহ্বান করবে। এখান থেকে পাওয়া নামগুলো যাচাই-বাছাই করে কমিটি অন্তত পাঁচজন নারীসহ ২০ জনের একটি তালিকা এবং তাদের যোগ্যতা সম্পর্কে একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে।

বিচারপতি এম এ মতিন আলোচনায় অংশগ্রহণ করে বলেন, অনুসন্ধান কমিটিতে যে নামগুলো আসে তার বাইরে যাওয়া যায় না। তিনি বিচারপতিদের অনুসন্ধান কমিটিতে রাখার বিরোধিতা করেন। কারণ নিয়োগ দেয়ার পর কমিশন না হলে বিচারপতিদের নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে। তাদের এই বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখাই ভালো। গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সংবিধান বদলানো যাবে না এমনটা নয়। সংবিধান বদলানো যায়। তিনি মন্তব্য করেন, তিন মাসের জন্য আসা একটি সরকার তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না। এ জন্য দরকার একটি জাতীয় সরকার। আলোচনায় সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংবিধান মানতে হলে নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে। তবে এ আইন যথেষ্ট নয়। এই আইন অবশ্যই হতে হবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে জনগণের স্বার্থে। তিনি বলেন, যে প্রক্রিয়ায় সার্চ কমিটি তা দলনিরপেক্ষ মানুষ দিয়ে হয় না। সর্বশেষ দু’টি নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। সার্চ কমিটির নামে প্রতারণার একটি প্রক্রিয়া চালু হয়েছে বলে মন্তব্য করেন শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, সরকারের ইচ্ছাতেই এটি করা হচ্ছে। কারা এর সদস্য হবেন সেটিও সরকারের ইচ্ছাতেই নির্ধারিত হয়।

ইসি গঠনে আইন দরকার হলেও বাস্তবতা বিবেচনায় নেয়ার কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি প্রশ্ন রাখেন, বর্তমান সরকার এবং পুলিশ প্রশাসন একই থাকলে সাখাওয়াত হোসেন, বদিউল আলম মজুমদারকে নিয়েও যদি কমিশন হয় সেই কমিশনও কি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে? একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো কিন্তু তারা কাজ করতে পারল না। তাহলে লাভ কী? নির্বাচনের সময়ে পুলিশ প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল করতে হয়। বিদ্যমান কাঠামোতে সেটি কি সম্ভব। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়েও কথা বলতে হবে। সেটি হতে পারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, জাতীয় সরকার বা অন্য কিছু।

এ দিকে একটি সংবাদপত্রের সাথে কথা বলতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদিন সার্চ কমিটি গঠনকে বেআইনি বলে মন্তব্য করেন। সংবিধানে সার্চ কমিটির কোনো বিধান নেই। তিনি আরো বলেন, নির্বাচন কমিশন যদি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে করা যায় তাহলে নির্বাচনকালীন সরকারও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গঠন করা সম্ভব। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের সম্ভাব্যতা নাকচ করেছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এটি ধোঁকাবাজি ছাড়া কিছু নয়। ২০১৮ মালে সার্চ কমিটির মাধ্যমে কে এম নুরুল হুদার যে কমিশন গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিশন পুরোভাগে সরকারের চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে আগ বাড়িয়ে দলীয় ভূমিকা পালন করেছে। এই সার্চ কমিটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না।

স্মরণ করা যেতে পারে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার নাম সরকারি দলের প্রস্তাবনায় ছিল না। এটি ছিল সরকারের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের একটি অংশ। এই প্রতারণার দ্বারা সরকার প্রমাণ করতে পারল যে, তাদের দলের প্রস্তাবিত কাউকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করা হয়নি। সরকারি দলের বলে অভিযোগ দেয়ার কোনো সুযোগও থাকল না। বিরোধী দল প্রাথমিক পর্যায়ে এই বলে তার বিরোধিতা করতে বিরত থাকে যে, ‘বৃক্ষত ফলত পরিচয়ত’। মানুষের এই আস্থাকে নষ্ট করে দিয়ে হুদা কমিশন যা করেছেন, তা বিগত ৫০ বছরের মধ্যে রেকর্ডই বলতে হবে। তবে সবাইকে বিস্মিত করে জনাব হুদা স¤প্রতি রাজনেতিক মতৈক্যের ভিত্তিতে কমিশন গঠনের কথা বলেছেন।

এসব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় কমিশন গঠনের ব্যাপারে সরকারের কঠোর মনোভাবের পরিচয় পাওয়া গেছে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, অবশ্যই সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে যোগদানের পর দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে একই প্রস্তাবের পুনরুল্লেখ করেছেন। এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, আসলে নির্বাচন কমিশন শক্তপোক্ত হলেও কোনো লাভ নেই, যদি তাদের নির্বাচন ব্যবস্থাকে পরিচালনার সার্বিক ক্ষমতা না থাকে। আমাদের দেশে প্রতিবেশী ভারতের মতো একটি স্বাধীন ও ব্যাপক ক্ষমতাপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশন নেই। ভারতে গুজব এরকম যে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার যদি জাঁদরেল হয় তাহলে সরকারি দলেরও ঘুম হারাম হয়ে যায়। বাংলাদেশে আইনগতভাবে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকালীন সময়ে চূড়ান্ত ক্ষমতার মালিক নয়। তাদের অর্থ ও প্রশাসনিক দায়-দায়িত্বের জন্য নির্ভর করতে হয় ক্ষমতাসীন সরকারের ওপর। তখন তাদের অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে। তা ছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচারে ন্যায্যতা, নিরপেক্ষতার মতো শব্দাবলি বিদায় নিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন যে, বিরোধী দল যেমন সরকারকে বিশ্বাস করে না, তেমনি সরকারও বিরোধী দলকে বিশ্বাস করে না। তার ফলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিষ্ঠা। এটি দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছে, রক্ত ঝরিয়েছে, তারাই ক্ষমতায় গিয়ে সেই ব্যবস্থাটি বাতিল করেছে। এর চেয়ে রাজনৈতিক ডিগবাজি আর কী হতে পারে!

এই দেশে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য যে নির্বাচনটি হয়েছিল ১৯৯১ সালে, আওয়ামী লীগ তা অগ্রাহ্য করেছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যখন হেরে যায় তখন সেই নির্বাচনী ফলাফল বাতিলের জন্য তারা আবদার করেছিল বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের কাছে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তা না করায় তাকে কুৎসিত ভাষায় গালি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। অবশেষে কোনো এক পর্যায়ে সাহাবুদ্দীন সাহেব সে দুঃখ কষ্টের কথা জনসম্মুখে বলেছিলেন। একই ধারায় আওয়ামী লীগের আত্মীয় বলে কথিত সাবেক সচিব এম এ সাঈদের নিরপেক্ষতায় বিএনপি যখন ক্ষমতাসীন হয়, তখন আওয়ামী লীগ তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করেছিল। প্রথম পরাজয়কে আওয়ামী লীগ বলেছিল সূক্ষ্ম কারচুপি। পরবর্তী পরাজয়কে বিএনপি বলেছিল স্থূল কারচুপি। আওয়ামী লীগ এক যুগ ১২ বছরে অর্থাৎ ২০১৪, ২০১৮ সালে নির্বাচনী ভোজবাজি দেখিয়েছে এখন তাদের অধীনে আর কেউ নির্বাচন করাকে বাস্তবসম্মত বলে না। ২০২৩ সালের সম্ভাব্য নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ যে কারচুপি প্রকৌশল বানাচ্ছে- তাতে সবাই শঙ্কিত।

তাই নাগরিক সাধারণ, সুশীলসমাজ, সব রাজনৈতিক দলের এই মুহূর্তের দাবি- একটি নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা। কৌশলগত কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার না বলে কেউ কেউ নির্বাচনকালীন সরকার কথাটি বলছেন। জনমত ও রাজনীতি বিজ্ঞানের সব প্রতিনিধিত্ব দাবি করে একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। বর্তমান শীর্ষনেতাদের একটি গুণ অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, তারা জনমতকে ধারণ করতে জানেন। কোটা আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন তার প্রমাণ। আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলনের সেই পথ ধরে যদি সব মত ও পথের লোকেরা শুধু এই দাবিতে ঐকমত্য গড়ে তুলতে পারে এবং প্রবল গণ-আন্দোলনের দ্বারা তা যদি সমর্থিত হয়, তাহলে জনগণ বিশ্বাস করে- শীর্ষ নেতৃত্ব সেই গণদাবিকে মেনে নেবে। বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্র একটি অসাধারণ ভুল থেকে সাধারণ সত্যে উপনীত হবে- এটাই নাগরিকদের বিশ্বাস।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]