ইসলামী ব্যাংক যেভাবে এস আলম গ্রুপের পকেটস্থ

বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংক সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় চট্টগ্রাম-ভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর বেহাল দশায় পড়েছে।

Illustration by Netra News on Islami Bank and S. Alam Group
২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তর (ডিজিএফআই) সদর দপ্তর থেকে ফোন করা হয় ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও একজন ভাইস চেয়ারম্যানকে। এরপর তাদেরকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থিত গোয়েন্দা সংস্থাটির দপ্তরে। সেখানে আগে থেকেই প্রস্তুত করা ছিল তাদের পদত্যাগপত্র। এতে তাদেরকে স্বাক্ষর করতে বলা হলে তিনজনই সঙ্গে সঙ্গে সেই নির্দেশ পালন করেন।

কয়েক ঘণ্টা পর সামরিক বাহিনীর মালিকানাধীন পাঁচ তারকা হোটেল র‍্যাডিসনে ডিজিএফআই কর্মকর্তাদের তত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক। ওই বৈঠকেই পরিচালকরা তাদের স্থলে নতুন পরিচালক “নির্বাচন” করেন।

এই কায়দায় ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ পরিবর্তনকে “নীরব অভ্যুত্থান” হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয় ব্রিটেনের খ্যাতনামা সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্টে

এই রদবদলের আগে আগে ব্যাংকটির শেয়ার কিনে রাখে চট্টগ্রাম-ভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান এস. আলম গ্রুপ। ডিজিএফআইয়ের সরাসরি হস্তক্ষেপে যেসব নতুন পরিচালক ব্যাংকটির দায়িত্ব পান, তারা ছিলেন এস. আলম গ্রুপের বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি।

ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ বদলের পর এই ছয় বছরে দেশের এক নম্বর এই ব্যাংকটি পাহাড়সম অনিয়মের চাপে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। ব্যাংকটির বিপুল অংকের আমানতকে রীতিমতো নিজস্ব ব্যাবসায়িক তহবিলে রূপান্তরিত করেছে এস. আলম গ্রুপ। ফলে  একেবারে মৌলিক সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা করতেও ব্যাংকটিকে হিমশিম অবস্থায় পড়তে হয়েছে।

ব্যাংকেরই ডজন খানেক কর্মকর্তা, যাদের অনেকে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখার সঙ্গে কোনো না কোনো সময় সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাদের সহায়তায় ব্যাংকটি করায়ত্ত করেছে এস. আলম গ্রুপ। একেবারে মাঠ পর্যায় থেকে তুলে এনে নাটকীয় গতিতে পদোন্নতি দিয়ে এই কর্মকর্তাদের বসানো হয়েছে ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে। নিয়ন্ত্রণ পাকাপোক্ত করতে হাজার হাজার নতুন কর্মী ও কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাদের সিংহভাগের বাড়ি গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলমের জেলা চট্টগ্রামে। নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রশ্নসাপেক্ষ। ক্ষেত্রবিশেষে নিয়োগের আগে কোনো ধরণের পরীক্ষা বা মূল্যায়ন পর্যন্ত করা হয়নি।

এই পুরো সময়টায় নিষ্ক্রিয় থেকেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো ধরণের কার্যকরি হস্তক্ষেপ, নিয়ন্ত্রণ বা রেশ টেনে ধরার লেশমাত্র প্রচেষ্টা ছিল না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে।

আর এসব অনিয়মের আঁচ লেগেছে গ্রাহক পর্যায়েও। ফলশ্রুতিতে ব্যাংকের মোট আমানতের আকার ক্রমশই কমছে। এমনকি ব্যাংকে নগদ অর্থের পরিমাণ  —  বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষায় — “নাজুক” অবস্থায় পৌঁছেছে। জরুরী অবস্থা সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিশেষ ব্যবস্থায় আট হাজার কোটি টাকা জোগান দিতে হয়েছে। তারপরও ফেব্রুয়ারিতে অতিরিক্ত আরও আট হাজার কোটি টাকার বিশেষ ঋণ চেয়েছে ইসলামী ব্যাংক! কিন্তু তীব্র তারল্য সংকটের মধ্যেই এই ডিসেম্বরেও অস্তিত্বহীন কোম্পানিকে হাজার কোটি টাকার নতুন ঋণ দিয়ে গেছে ব্যাংকটি, যেন তাদের পূর্বের বিপুল অংকের ঋণ খেলাপি না হয়ে যায়। এরপর নতুন ঋণ নেয়ার মতো পরিস্থিতি না থাকায় হাত দেওয়া হয়েছে ব্যাংকের কর্পোরেট সামাজিক তহবিলেও।

ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা বদলের ছয় বছর পর ব্যাংকটির এই বেহাল দশার চিত্র উঠে এসেছে নেত্র নিউজের এক দীর্ঘ অনুসন্ধানে। এই প্রতিবেদন প্রস্তুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের প্রায় কয়েক শ’ পৃষ্ঠার অভ্যন্তরীণ নথিপত্র যাচাই-বাছাই করেছে নেত্র নিউজ। এই নথিপত্রের মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন সংক্রান্ত একাধিক প্রতিবেদন, ইসলামী ব্যাংককে পাঠানো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক চিঠি, ব্যাংকের পরিস্থিতি বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব মূল্যায়ন, এস. আলম গ্রুপ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কোম্পানি গঠন সংক্রান্ত নথি, ইসলামী ব্যাংকের বৃহৎ ঋণ-প্রদান সংক্রান্ত নথিপত্র, ব্যাংকের সিএসআর সংক্রান্ত অভ্যন্তরীণ নথি, ব্যাংকটির ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন, ইসলামী ব্যাংকের ২০,০০০ হাজার কর্মকর্তা ও কর্মীর বিস্তারিত বিবরণ, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের জীবন বৃত্তান্ত, মানবসম্পদ ও পদোন্নতি নীতিমালা, ইত্যাদি।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা পৃথক পৃথকভাবে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

এই প্রতিবেদনের জন্য বক্তব্য চেয়ে এস. আলম গ্রুপ ও গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম, ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেত্র নিউজ। এদের মধ্যে কেবল ইসলামী ব্যাংক প্রত্যুত্তর পাঠিয়েছে।

“বাংলাদেশ ব্যাংক এস. আলম গ্রুপের ব্যাংকগুলোকে এক চোখে ও অন্য ব্যাংকগুলোকে অন্য চোখে দেখেছে। ফলে এই গ্রুপের ব্যাংকগুলো বিভিন্ন নামে টাকা বের করার সুযোগ পেয়েছে। এ জন্য এই গ্রুপের ব্যাংকগুলোর ওপর আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়েছে, আমানত কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়বে পুরো অর্থনীতিতে। এস. আলম গ্রুপ এত শক্তিশালী যে, বাংলাদেশ ব্যাংক চুপ থাকতে বাধ্য হয়েছে।”

এস. আলম গ্রুপ-সংশ্লিষ্ট ঋণের উল্লফন

 

ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের আগে থেকেই ব্যাংকের চট্টগ্রামস্থ খাতুনগঞ্জ শাখার গ্রাহক ছিল এস. আলম গ্রুপ। তবে মালিকানা পরিবর্তনের পর এই ঋণ গ্রহণের মাত্রা বাড়তে থাকে নাটকীয়ভাবে। তাদের নামি-বেনামি ঋণ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী ও রাজধানীর বাইরের উত্তরবঙ্গের শাখাতেও।

ইসলামী ব্যাংকের ২০১৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালের শেষ নাগাদ এস. আলম গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান ছিল ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণগ্রহীতার তালিকায়। এই তিনটি প্রতিষ্ঠান হলো এস. আলম স্টিলস অ্যান্ড রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ, এস. আলম ভেজিটেবলস ওয়েল  এবং এস. আলম সুপার এডিবল ওয়েল। ওই সময় এই তিন প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণ ছিল ৩,১০৮ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ — অর্থাৎ মালিকানা পরিবর্তনের ঠিক আগে এই ঋণ কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৩,০০৮ কোটি টাকায়।

কিন্তু মালিকানা পরিবর্তনের পর হু হু করে বাড়তে থাকে এই ঋণের অংক।

২০২০ সালের শেষ নাগাদ এস. আলম গ্রুপ-সংশ্লিষ্ট দুইটি নতুন প্রতিষ্ঠান শীর্ষ ঋণগ্রহীতাদের তালিকায় যুক্ত হয়। আর ২০২১ সালের শেষ নাগাদ যুক্ত হয় নতুন আরও চারটি প্রতিষ্ঠান। এভাবে ২০২১ সালের শীর্ষ ঋণগ্রহীতাদের তালিকায় এস. আলম গ্রুপ ও গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলমের আত্মীয়দের মোট নয়টি প্রতিষ্ঠান জায়গা করে নেয়।

২০২১ সালে এস. আলম স্টিলের ঋণ ছিল ৩,২২৪ কোটি টাকা, এস. আলম ভেজিটেবলের ৩,৮৫০ কোটি টাকা, এস. আলম সুপার এডিবেল ওয়েলের ৪,১৫৩ কোটি টাকা এবং এস. আলম কোল্ড রোল স্টিলের ১,৪৭৬ কোটি টাকা। এস. আলম গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান শেমন ইস্পাত লি.-এর ঋণ ছিল ১,৪৪০ কোটি টাকা।

আর গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলমের মালিকানাধীন ইনফিনিয়া সিআর স্ট্রিপসের ঋণ ছিল ১,৪১৮ কোটি টাকা। সাইফুল আলমের মেয়ের জামাই বেলাল আহমেদের নিয়ন্ত্রণাধীন ইউনিটেক্স এলপি গ্যাসের ঋণ ছিল ১,০১৫ কোটি টাকা। সাইফুল আলমের ভাগনে মোস্তান বিল্লাহ আদিলের আদিল করপোরেশনের ঋণ ছিল ১,০৬৭ কোটি টাকা। আদিলের স্ত্রী সাদিয়া জামিলের সাদিয়া ট্রেডার্সের ঋণ ছিল ১,০৭২ কোটি টাকা। মোস্তান বিল্লাহ আদিল আবার এস. আলম গ্রুপের মালিকানাধীন গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক ও আহসানুল আলমের ইনফিনিয়া স্পিনিং মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

এই নয় প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে ইসলামী ব্যাংকে এস. আলম গ্রুপের ঋণ বেড়েছে ছয় গুনেরও বেশি। ওই বছর অবধি ইসলামী ব্যাংকের মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৯ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ১৬.৫৫% ঋণই নিয়েছিল এস. আলম গ্রুপ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।

ইসলামী ব্যাংকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন এখনও প্রস্তুত হয়নি। তবে ইসলামী ব্যাংকের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নেত্র নিউজকে জানিয়েছেন, ইসলামী ব্যাংক থেকে এস. আলম গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ঋণের আকার এক বছরেই অন্তত দ্বিগুণ বেড়েছে।

একই আঁচ মিলেছে অন্য সূত্রগুলো থেকেও। বাংলাদেশের নিউ এইজ ও নিউ নেশন পত্রিকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষকদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, ইসলামী ব্যাংক থেকে এস. আলম গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ঋণের পরিমাণ হবে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক নতুন ঋণ বিতরণ করেছে ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ, আগের পাঁচ বছর গড়ে ব্যাংকটি মাত্র ৬ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করেছে।

এই নতুন দেওয়া ঋণের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি কাগুজে বা অস্তিত্বহীন কোম্পানিকে দেওয়া ঋণ। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর কেউ কেউ কোম্পানি গঠনের কয়েক দিন বা কয়েক মাসের মাথাতেই হাজার কোটি টাকার ঋণ পেয়ে গেছে। কারও কারও ঋণ প্রস্তাব আবেদনের দুই দিনের মধ্যেই অনুমোদন হয়ে গেছে। আর বিশেষ শরিয়া-ভিত্তিক ঋণ হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে নেওয়া হয়নি জামানতও।

নেত্র নিউজকে পাঠানো জবাবে এস. আলম গ্রুপের ঋণ বৃদ্ধির বিষয়টি অস্বীকার করেনি ইসলামী ব্যাংক। তবে ব্যাংকটি যুক্তি দিয়ে বলেছে, তাদের সঙ্গে এস. আলম গ্রুপের  “প্রায় ৪০ বছরের ব্যবসায়িক সম্পর্কে এ প্রতিষ্ঠানগুলো কখনোই খেলাপি হয়নি।”

এস. আলম গ্রুপের অকস্মাৎ ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, “ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্ক ও যৌক্তিক চাহিদার আলোকে ব্যবসায়িক লেনদেন ও পরিধি পর্যালোচনা করে […] বিনিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। যা ব্যাংকিং নিয়মাচার পরিপালন সম্পন্ন করেই হয়েছে। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে স্বাভাবিকভাবেই গ্রাহকদের উচ্চ মূল্যে পণ্য আমদানি করতে হয়েছে।  যে কারণে গ্রাহককে পূর্বের চেয়ে বেশি পরিমাণ বিনিয়োগ দিতে হয়েছে।”

তবে “আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির” প্রভাব ব্যস্তানুপাতিক হারে কেন এস. আলম গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে পড়েছে, সেই বিষয়ে জবাবে কিছু বলা হয়নি। পাশাপাশি, ব্যাংক থেকে ব্যাংকেরই শীর্ষ শেয়ারধারী ও তার আত্মীয় স্বজনের প্রতিষ্ঠানের বিপুল অংকের ঋণ গ্রহণের মধ্যে সম্ভাব্য দুর্নীতি ও স্বার্থের দ্বন্দ্বের উপস্থিতি সম্পর্কেও কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

ইসলামী ব্যাংকে এস. আলম গ্রুপের ঋণ বৃদ্ধি নিয়ে সতর্কতার কথা উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব এক প্রতিবেদনেই। নেত্র নিউজের হাতে আসা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, “২০২২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এস. আলম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ১৭ হাজার ৯৭ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। ফলে একক গ্রাহকের ঋণ সীমার অতিরিক্ত ১৫ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের ঋণ রয়েছে, যা এস. আলম গ্ৰুপের না হলেও প্রকৃত সুবিধাভোগী এস. আলম গ্রুপ। সীমা লঙ্ঘন করে দেওয়া এসব ঋণ ব্যাংকের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যা ব্যাংকের শৃখলা ও আমানতকারীদের স্বার্থ পরিপন্থী। যা সুষ্ঠ ব্যাংকিং নিয়মের পরিপন্থী। এক্ষেত্রে দায়ীদের চিহ্নিত করা ও প্রশাসনিক ব্যাবস্থা নেওয়া হয় নি। আবার ঋণের পরিমাণ কমিয়ে সীমার মধ্যে আনারও কোন প্রচেষ্টা দেখা যায় নি। ব্যাংকটি একজন গ্রাহককে সর্বোচ্চ ১,৪৭২ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারে, যা একক গ্রাহক ঋণ সীমা হিসেবে পরিচিত।”

এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংক বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছে, “প্রতিবেদনে একক ফান্ডেড বিনিয়োগ সীমা বিষয়ে যে তথ্য পরিবেশিত হয়েছে তা সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। […] বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন ও ব্যাংকের নিজস্ব বিনিয়োগ নীতিমালার আলোকে নির্দেশনা মেনে ব্যাংক ও গ্রাহক সম্পর্ক বিবেচনা করেই বিনিয়োগ প্রদান করা হয়েছে।”

ঘনীভূত হচ্ছে সংকট, আমানত কমছে, সিএসআর তহবিলে হাত

 

ইসলামী ব্যাংকে মালিকানা পরিবর্তনের পরই বিনিয়োগকারী ও আমানতধারীদের আস্থায় চিড় ধরে। ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা সরকারকে চিঠি লিখে তাদের অসন্তোষের কথা জানান। সৌদি আরব ভিত্তিক ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহারেরও আগ্রহ প্রকাশ করে। পরবর্তীতে তারা তাদের প্রায় সকল শেয়ার বিক্রি করে দেন। অন্যান্য বিদেশী বিনিয়োগকারীও তাদের শেয়ার গুটিয়ে আনেন।

মালিকানা পরিবর্তনের ১৫ মাসের মধ্যেই প্রথম সংকটে পড়ে ব্যাংকটি। ওই সময় বাংলাদেশের প্রথম আলো পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মালিকপক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্বে পদত্যাগ করেন নতুন চেয়ারম্যান আরাস্তু খান, ভাইস চেয়ারম্যান আহসানুল আলম। একইসঙ্গে পদত্যাগ করেন ৫ জন শীর্ষস্থানীয় নির্বাহী ব্যবস্থাপক।

আর এই সংকটের ধাক্কা লাগে ব্যাংকের সার্বিক পরিচালনায়। প্রথমবারের মতো টাকার অভাবে নিজেদের ঋণ কার্যক্রম কমিয়ে আনে ইসলামী ব্যাংক। আমানতের জন্য ব্যাংকের হন্যদশার চিত্রও উঠে আসে ওই প্রতিবেদনে। ওই সময় নগদ টাকার জন্য সরকারি বন্ড থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে ব্যাংকটি।

বিনিয়োগযোগ্য অর্থ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে আমানতের চেয়েও বেশি ঋণ প্রদানই ছিল দায়ী। ২০১৮ সালের এপ্রিল নাগাদ ব্যাংকটির কাছে নতুন আমানত এসেছিল ১ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। অথচ, ব্যাংকটি নতুন ঋণ দিয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরোপ করা সীমা অতিক্রম করে ব্যাংকে থাকা মোট আমানতের ৯২% ঋণ দিয়ে ফেলে প্রতিষ্ঠানটি।

একই ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে এখনও — তবে আকারে ও মাত্রায় বহুগুণ বড়।

গত বছরের নভেম্বরে ইসলামী ব্যাংকে একাধিক ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম আলোদ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ও নিউ এইজে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। গ্রাহকদের মধ্যে এসব প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়া হয় বেশ তীব্র। অনেকে তুলে নিতে থাকেন আমানত।

নেত্র নিউজের হাতে আসা নথিপত্র অনুযায়ী, গত অক্টোবর শেষে ইসলামী ব্যাংকে আমানত ছিল ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। ১৫ নভেম্বর যা কমে হয় ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। গত ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত কোনো দিন আমানত বাড়ে, আবার কখনও কমে। তবে ২৮ নভেম্বর থেকে প্রতিদিনই আমানত কমছে। গত ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত যা কমে হয় ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা।

এই পরিস্থিতিতে নতুন ঋণ প্রদানের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে ইসলামী ব্যাংক। আর ওদিকে ঋণের টাকা শেষ হয়ে যাওয়ার পর ব্যাংকের সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) তহবিল থেকে ১২০ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে — ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেছেন ওই অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে ব্যাংকের মালিকপক্ষের নির্দেশে।

ব্যাংকে আমানত হ্রাস পাওয়ার কথা স্বীকার করে নিয়েছে ইসলামী ব্যাংকও। তবে এজন্য “কতিপয় পত্রিকার প্রতিবেদন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব”কে দায়ী করেছে ব্যাংকটি।

প্রতিষ্ঠানটির আরও দাবি, ইসলামী ব্যাংকের মতো অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকেও এই “অস্থিরতার” প্রভাব পড়েছে। “ইতোমধ্যে  এই গুজব মানুষের নিকট মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ফলে মানুষ আবার ব্যাংকমূখী হয়েছে এবং ইসলামী ব্যাংকেও এর ইতিবাচক সাড়া লক্ষ্যণীয়। যেসব গ্রাহক গুজবে টাকা তুলে নিয়েছিলেন তাদের অনেকেই আবার টাকা জমা শুরু করেছেন।”

কিন্তু অন্যান্য কোন বাণিজ্যিক ব্যাংককে নগদ তারল্যের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হয়নি। শুধু তাই নয়, “মানুষ আবার টাকা জমা শুরু করেছেন” — এই দাবি নেত্র নিউজকে পাঠানোর এক দিন পরই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আরও ৮ হাজার কোটি টাকা অগ্রিম ঋণ চেয়েছে ইসলামী ব্যাংক।

যেভাবে এস. আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা

 

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ইসলামি শরিয়া-ভিত্তিক ব্যাংক হিসেবে ১৯৮৩ সালে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে গতানুগতিক সুদ-ভিত্তিক ব্যাংকিং-এর বিপরীতে শরিয়া-ভিত্তিক বিকল্প হিসেবে ব্যাংকটি পরিচিতি পেতে থাকে। আর এভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান-অধ্যুষিত বাংলাদেশে ব্যাংকটি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে। ইসলামী ব্যাংকের সাফল্যের পর একে একে আরও দশটি এই ঘরানার ব্যাংক বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়।

ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তাদের অনেকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এই কারণে বিতর্ক কখনও পিছু ছাড়েনি ব্যাংকটির। বাংলাদেশের শাসক দল আওয়ামী লীগ ও সমমনা অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের মধ্যে এ নিয়ে শঙ্কা ছিল। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে অর্থায়ন থেকে শুরু করে জঙ্গিবাদে অর্থায়নের বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগ ব্যাংকটির বিরুদ্ধে ছিল। তবে বিভিন্ন পর্যবেক্ষক ব্যাংকটির রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করলেও, বাংলাদেশের আইনি কাঠামোতে ব্যাংকটিকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। বরং, ব্যাংকটির মালিকানা পরিবর্তনে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে উঠে সরকার।

এ নিয়ে প্রথম দৃশ্যমান সরকারি পদক্ষেপ দেখা যায় ২০১০ সালে। ওই সময় পরিচালক পদমর্দাযায় একজন সরকারি কর্মকর্তাকে ব্যাংকটিকে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর এই উদ্যোগ গতি পায়।

আর ঠিক এক বছর পরই ব্যাংকটিতে বিনিয়োগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে চিঠি পাঠায় সৌদি আরব-ভিত্তিক বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু এসব উদ্বেগকে উপেক্ষা করে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে ব্যাংকটিকে পরিবর্তন আনা হয়। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয় এস. আলম গ্রুপের।

কিন্তু ব্যাংকে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলেও এস. আলম গ্রুপের কেউই সরাসরি পরিচালনা পর্ষদে বসেনি। ব্যাংকের শেয়ার সরাসরি এস. আলম গ্রুপের নামে কেনা হয়নি। কেনা হয়েছে অনানুষ্ঠানিক অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। যেমন, আরমাডা স্পিনিং মিল এখন ইসলামী ব্যাংকের অন্যতম বৃহৎ শেয়ারধারী। এই কোম্পানিটি সরাসরি এস. আলম গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়; কিন্তু এই বেনামি কোম্পানিটির ঠিকানা হলো রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকায় অবস্থিত এস. আলম গ্রুপের সম্পত্তিতে।

২০১৭ সালে মালিকানা পরিবর্তনের পর থেকে আরমাডা স্পিনিং মিলের প্রতিনিধিই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ নাজমুল হাসান।

এস. আলম গ্রুপের বদলে গ্রুপটির অনানুষ্ঠানিক অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে সাবেক পেশাজীবীরা পর্ষদের সদস্য হন। এদের মধ্যে ছিলেন সাবেক সচিব আরাস্তু খান, যিনি হয়েছিলেন চেয়ারম্যান।

কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যাংকটির পর্ষদে ছিলেন সাবেক বিচারক, দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক সদস্য ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন।

এছাড়াও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার জেনারেল আবদুল মতিন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সহ অনেকে পর্ষদে আছেন।

ব্যাংকের অভ্যন্তরে গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করতে কর্পোরেট ব্যবস্থাপনাকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলা হয়েছে। ২০১৭ সালের পর থেকে ব্যাংকটি থেকে অবাধে ঋণ নেয়ার পাশাপাশি নতুন নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। গত ছয় বছরে ব্যাংকটিতে আট হাজার নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অথচ, প্রাথমিক স্তরের কর্মকর্তা নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে মাত্র একবার, যখন নিয়োগ হয়েছিলেন ২০০ জন। বাকি সবার নিয়োগ অনানুষ্ঠানিকভাবে।

ইসলামী ব্যাংকের সকল শাখায় কর্মরত মোট ২০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারির তালিকা, যোগদানের তারিখ, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অন্যান্য বিস্তারিত তথ্য-সমেত একটি অভ্যন্তরীণ নথি নেত্র নিউজের হাতে এসেছে। কয়েকশ’ পৃষ্ঠার ওই নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে ব্যাংকটিতে মোট কর্মীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজার। সেখান থেকে ছয় বছরেই লোকবলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৬ শতাংশ — অর্থাৎ ৮ হাজার। কর্মকর্তা পর্যায়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৬২০০ জনের মতো; যাদের মধ্যে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা থেকেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৫৯০০ জনকে।

তবে ইসলামী ব্যাংক দাবি করেছে, “ইসলামী ব্যাংক নিয়োগ নীতিমালার আলোকে যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ দিয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের বিধিবদ্ধ নিয়মের কোন ব্যত্যয় ঘটেনি।”

নতুন করে কর্মকর্তা-কর্মচারি নিয়োগ প্রদানের ব্যাখ্যা দিয়ে ব্যাংকটি বলেছে, “২০১৬ সালে ইসলামী ব্যাংকের অপারেশন ইউনিট ছিলো ৮৩৮টি। ২০২৩ সালে ইসলামী ব্যাংকের অপারেশন ইউনিটের সংখ্যা ৬ হাজারের বেশি। ২০১৬ সালে ব্যাংকের শাখা ছিলো ৩১৮ টি যা ২০২৩ সালে দাঁড়িয়েছে ৩৯৪টি। ২০১৬ সালে এটিএম ছিলো ৫২০ যা এখন ২৫০০ এর বেশি। ২০১৬ সালে ব্যাংকের উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট ছিলো না। পক্ষান্তরে ২০২৩ সালে ব্যাংকের উপশাখা ২২৮ টি ও এজেন্ট আউটলেটের সংখ্যা ২৭০০ টি। যার বিপরীতে যে সংখ্যক কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় বরং অপ্রতুল।”

নেত্র নিউজের বিশ্লেষণে দেখা যায়, নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে কোনো সনদ ছাড়াই নিয়োগ হয়েছে এক হাজার জনের বেশি। ন্যুনতম স্নাতক পর্যায়ের যোগ্যতা ছাড়াই শ’ শ’ কর্মকর্তা-পর্যায়ের লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। স্নাতক ডিগ্রি যাদের আছে, তাদের মধ্যে ৫৫% হলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। ব্যাংকের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকের নিয়োগ হয়েছে কোনো ধরণের পরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই ছাড়াই। গণহারে নিয়োগ দিতে চট্টগ্রামের পটিয়াতে সাইফুল আলমের বাড়িতে ও এস. আলম গ্রুপের চট্টগ্রামের কার্যালয়ে বক্স বসিয়ে চাকরিপ্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করা হয়।

এক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক বলেছে, “ইসলামী ব্যাংক যথাযথ নিয়ম পরিপালন করেই যোগ্য প্রার্থীদের মধ্য থেকে নিয়োগ প্রদান করে। ব্যাংকের নিয়োগ বিধিমালা অনুসরণ করেই নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। নিয়ম বহির্ভূত কোন নিয়োগের ঘটনা ইসলামী ব্যাংকে ঘটেনি। সনদ ছাড়া নিয়োগের ঘটনা ইসলামী ব্যাংকের কখনোই ছিলো না এবং নেই।”

নতুন নিয়োগে চট্টগ্রাম-ভিত্তিক প্রার্থীদের প্রাধান্য থাকার বিষয়ে কোন মন্তব্য করা হয়নি।

নেত্র নিউজের বিশ্লেষণ ও কর্মকর্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি নিয়ন্ত্রণ নিয়েই ব্যাংকটিতে নাটকীয় কিছু পরিবর্তন আনে এস. আলম গ্রুপ। নির্দিষ্ট কিছু কর্মকর্তা ওই দিনই পদোন্নতি পেয়ে যান — এরপর দফায় দফায় পদোন্নতি পেয়ে উঠে যান শীর্ষ পর্যায়ে। এদের অনেকেই কোনো না কোনোভাবে ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এই খাতুনগঞ্জ শাখার সঙ্গে এস. আলম গ্রুপের আগে থেকেই দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল।

যেমন, চট্টগ্রামের বাঁশখালী এলাকার মিফতাহ উদ্দিন। ২০০১ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ২০০৬ সালের মে মাসে ইসলামী ব্যাংকে অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ২০১৭ সালে ৫ জানুয়ারি ব্যাংকটির মালিকানা পরিবর্তনের সময় তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখায় কর্মকর্তা। ওই দিনই সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে পদোন্নতি পান তিনি। এরপর দেড় বছরের মধ্যে তিনি আরও চারটি পদোন্নতি পান। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে হয়ে যান নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট। এবং এই পুরোটা সময় তিনি খাতুনগঞ্জ শাখার দায়িত্বেই ছিলেন।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি আরেক দফা পদোন্নতি পেয়ে হয়ে যান সিনিয়র নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট। তাকে বানানো হয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের করপোরেট ইনভেস্টমেন্ট উইং-১-এর প্রধান।

প্রধান কার্যালয়ের করপোরেট ইনভেস্টমেন্ট উইং-১-এর দায়িত্ব হলো ৫০০ কোটি টাকার বেশি অংকের ঋণ প্রস্তাব তৈরি, মতামত ও কিছু ক্ষেত্রে অনুমোদন দেওয়া। তাই ৫০০ কোটি টাকার বেশি যেসব ঋণ দেওয়া হয়, সব ক্ষেত্রেই মিফতাহ উদ্দিনের স্বাক্ষর রয়েছে। মাত্র দুই দিনের মধ্যে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের শ’ শ’ কোটি টাকার ঋণ প্রস্তাব তিনি অনুমোদন করেছেন।

ইসলামী ব্যাংকের মানবসম্পদ নীতিমালা অনুযায়ী, জ্যেষ্ঠ নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট হতে হলে ন্যুনতম ১৮ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অথচ, ওই পদোন্নতির সময় তার চাকরির মোট বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর।

জ্যেষ্ঠ নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে বর্তমানে ব্যাংকে ১৩ জন কর্মরত আছেন। বলাই বাহুল্য, এদের মধ্যে মিফতাহ উদ্দিনের কর্মজীবনের মেয়াদ সবচেয়ে কম। তার পরের অবস্থানে কর্মকর্তা ব্যাংকে চাকরি করছেন ২৪ বছর ধরে। বাকিদের মধ্যে চার জন ২৭ বছর, ছয় জন ৩০ আর এক জন ৩৩ বছর ধরে চাকরি করেছেন।

২০০৬ সালের ৬ মে মিফতাহ উদ্দিনের সঙ্গে যোগদান করা ১৪১ জন কর্মকর্তা এখনও ইসলামী ব্যাংকে কাজ করছেন। এদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতার কাতারে তার অব্যবহিত পরের অবস্থানে থাকা চার জন কর্মকর্তা গত বছরের জুলাইয়ে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন — অর্থাৎ মিফতাহ উদ্দিনের কাতারে যেতে হলে তাদেরকে ৫টি পদোন্নতি পেতে হবে!

তৃতীয় কাতারে থাকা ৩৪ জন কর্মকর্তা এখন ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট। বাকি ১০৩ জন কর্মকর্তা এখনও নির্বাহীই হতে পারেননি। তারা আছেন কর্মকর্তা পদে।

এমন আরেকজন কর্মকর্তা হলেন মোহাম্মদ সাব্বির। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষে ২০০১ সালে ইসলামী ব্যাংকে কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। ১৩ বছর চাকরি করার পর তিনি নির্বাহী হিসেবে সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হন ২০১৪ সালে। মালিকানা পরিবর্তনের দিনই তাকে পদোন্নতি দিয়ে বানানো হয় ভাইস প্রেসিডেন্ট। এরপর থেকে প্রায় প্রতি বছর পদোন্নতি পেয়েছেন তিনি। ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার ১০ দিন পরই তাকে চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় শাখা থেকে গুরুত্বপূর্ণ খাতুনগঞ্জ শাখায় বদলি করা হয়। এক বছর পর তিনি হন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। এরপর দফায় দফায় পদোন্নতি পেয়ে গত বছরের আগস্টে তিনি হন ব্যাংকের উপ-ব্যাবস্থাপনা পরিচালক। এই পদে থেকে তিনি ব্যাংকের ঋণ প্রস্তাব থেকে ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। তার আগে তিনি ছিলেন প্রধান কার্যালয়ের করপোরেট ইনভেস্টমেন্ট উইং-১-এর প্রধান, যার দায়িত্বে এখন রয়েছেন মিফতাহ উদ্দিন।

মিফতাহ উদ্দিনের মতো তাকেও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ব্যাংকের নিজস্ব নীতিমালা লঙ্ঘন করে। উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) পদে তার অন্তত ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকার কথা ছিল। কিন্তু তিনি ডিএমডি হয়েছেন ১৭ বছরে।

২০০১ সালের ১৫ নভেম্বর মোহাম্মদ সাব্বিরের সঙ্গে যারা ইসলামী ব্যাংকে যোগ দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ১৩০ জন এখনও ব্যাংকটিতে কর্মরত আছেন। এদের মধ্যে মাত্র ৭ জন এখন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট — সাব্বিরের পর্যায়ে যেতে হলে তাদের পেতে হবে আরও ৩টি পদোন্নতি। বাকি ১২২ জন আছেন আরও নিচের পদে।

চট্টগ্রামের পটিয়ার মোহাম্মদ এহসানুল ইসলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষে ২০০৪ সালে ইসলামী ব্যাংকে প্রবেশন অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে প্রধান কার্যালয় থেকে খাতুনগঞ্জ কর্পোরেট শাখার ঋণ বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর প্রতি বছরে পদোন্নতি পেয়েছেন। ২০২০ সালে মার্চে তাকে সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ডিসেম্বরে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ২০২২ সালের জুলাইয়ে করা হয় সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। এখন তিনি খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক। ১৮ বছর আগে তার সঙ্গে একই দিন যোগদান করা ৭২ জন কর্মকর্তার মধ্যে তিনিই এখন সর্বোচ্চ পদে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ৭ জন কর্মকর্তা তার চেয়ে দুই ধাপ পিছিয়ে।

গাজীপুরের মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা শেষে ২০০৭ সালে সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে ব্যাংকে যোগ দেন। মালিকানা পরিবর্তনের দিন তাকে পদোন্নতি দিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হয়। এরপর ২০১৯ সালে একটি পদোন্নতি পেলেও ২০২০ সালের মার্চে ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ডিসেম্বরে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হয়। আর গত বছরের জুলাইয়ে এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তিনি মূলত ব্যাংকটির আন্তর্জাতিক সেবা দেখভাল করে থাকেন।

কক্সবাজারের মহেশখালীর এ এম শহীদুল আমরান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি অর্থনীতিতে শিক্ষা শেষে ২০০৫ সালে ব্যাংকটিতে অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ২০১৭,২০১৯ ও ২০২০ ও ২০২২ সালে তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এখন তিনি ব্যাংকটির এমডির কার্যালয়ের কর্মকর্তা। ইসলামী ব্যাংকের সূত্রগুলো বলছে, তিনি অনেকটা এস. আলম গ্রুপ ও ইসলামী ব্যাংকের মধ্যে লিয়াঁজো হিসেবে কাজ করেন। তার মাধ্যমে আসা বার্তা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।

ব্যাংকটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ কায়সার আলী কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে ১৯৯২ সালে প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে ব্যাংকে যোগদান করেন। ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ব্যাংকটির মালিকানা পরিবর্তনের সময় তিনি ছিলেন খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক। সেদিনই তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও একই বছরের ২২ অক্টোবর সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হয়। এক বছর পর করা হয় উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি)। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে তাকে অতিরিক্ত এমডি হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তাকে এস. আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন আরও ৬টি ব্যাংকের একটির এমডি করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়। তবে তিনি এখনও ইসলামী ব্যাংকেই আছেন।

ইসলামী ব্যাংক এক্ষেত্রে দাবি করেছে, “পদোন্নতির সকল নিয়ম মেনেই ইসলামী ব্যাংক সময় সময় পদোন্নতি দেয়। বিশেষ পারফরমেন্সের ভিত্তিতে ব্যাংক তার কর্মীদের এক্সিলারেটেড প্রমোশন দিয়ে থাকে। আপনাদের উল্লেখিত নির্বাহীর পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যাংকের প্রচলিত সকল নিয়ম পরিপালন করা হয়েছে।  এছাড়া ইসলামী ব্যাংকে একক ব্যক্তির সিদ্ধান্তে কোন বিনিয়োগ অনুমোদনের সুযোগ নেই। বরং অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করেই বিনিয়োগ অনুমোদন করা হয়।

“শিশুতুল্য” বাংলাদেশ ব্যাংক

 

ইসলামী ব্যাংকের এই পরিস্থিতি একেবারেই ব্যাতিক্রম কিছু নয়।

বর্তমানে এস. আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দেশের ৭টি ব্যাংক। এগুলোর প্রত্যেকটিতেই কোনো না কোনো ধরণের সংকট চলছে। এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও শীর্ষ পদগুলোতে রয়েছেন সাইফুল আলমের আত্মীয়স্বজন ও এস. আলম গ্রুপের সাবেক কর্মকর্তারা।

ঋণ অনিয়মের খবর সংবাদমাধ্যমে আসার পর শরিয়াভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংককে দশ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ ও আদায়ের তথ্য প্রতিদিন জমা দিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক পাঁচটি হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। এই সবগুলো ব্যাংকই এস. আলম গ্রুপের মালিকানাধীন। ঢাকার ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসলামী ঘরানার এই সবগুলো ব্যাংক থেকেই গ্রাহকরা সম্প্রতি অর্থ তুলে নিয়েছেন

ইসলামী ব্যাংকের মতো এই ব্যাংকগুলোতেও নতুন করে ঋণ দেওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিদর্শনে ধরা পড়ে, এস. আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ইউনিয়ন ব্যাংকের বিতরণকৃত ৯৫% ও এসআইবিএলের ২৩% ঋণই খেলাপিযোগ্য। একইভাবে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ঋণেও বড় অনিয়ম হয়। ব্যাংকটির সিংহভাগ ঋণ খেলাপিযোগ্য।

গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে ব্যাংকে পর্যবেক্ষক দল পরিদর্শন শুরু করেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা নেত্র নিউজের এক প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, পরিদর্শক দলের কার্যক্রম অত্যন্ত সীমিত। এখন পর্যন্ত ব্যাংকটির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ধরণের ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো বিশেষ ঋণ ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃত্তিমভাবে টিকে থাকতে শরিয়া-ভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে — যেগুলোর মালিক এস. আলম গ্রুপ — টাকা ধার দিতে চালু করেছে বিশেষ ঋণ ব্যবস্থা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংক নিয়ম অনুযায়ী যত টাকা নগদ হিসেবে সংরক্ষণ করার কথা ছিল, তাতে ঘাটতি ছিল পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এই নাজুক পরিস্থিতি কাটাতে আট হাজার কোটি টাকা ধার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কিন্তু এমন তীব্র তারল্য সংকটের মধ্যেও চট্টগ্রাম-ভিত্তিক তিনটি প্রতিষ্ঠানকে গত বছরের ডিসেম্বরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয় ইসলামী ব্যাংক। সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড, ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্স ও মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজ নামে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ঋণে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি বলে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক।

ইসলামী ব্যাংক এ বিষয়ে দাবি করেছে, “… মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজ, ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্স ও সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড দীর্ঘদিন যাবত আমদানী ও ট্রেডিং ব্যবসা পরিচালনার অভিজ্ঞতা নিয়ে ইসলামী ব্যাংকের সাথে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ব্যাংকের বিনিয়োগ নীতিমালা ও স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই এ ধরণের বিনিয়োগ প্রতি বছর পূনরায় নবায়ন করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বিতরণকৃত উল্লেখিত বিনিয়োগগুলো ২০২২ সালে পুনরায় নবায়ন করা হয়।”

কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নথিতে জানানো হয়, “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল চট্রগ্রামে গিয়ে এসব গ্রাহকের ঠিকানায় গিয়ে কোম্পানি খুঁজে পায়নি। এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের পূর্বের ঋণকে খেলাপি হিসেবে শ্রেণীকরণ যেন করতে না হয়, সেজন্য নতুন করে ঋণ দেওয়া হয় বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে আসে। এসব ঋণকে খেলাপী হিসেবে চিহ্নিত করে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইসলামী ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।”

তবে ইসলামী ব্যাংক দাবি করেছে, “২০২১ সালের বিতরণকৃত বিনিয়োগসমূহ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগেই মুনাফাসহ পরিশোধিত হয়। যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে তিনটি বিনিয়োগ গ্রাহকই তাদের দায় পরিশোধ করেছে সেক্ষেত্রে তাদের বিনিয়োগ মেয়াদোত্তীর্ণ বা খেলাপী হয়নি। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ইসলামী ব্যাংকে সময় সময় যে সব পত্র ও নির্দেশনা দেয়া হয় তা যথাযথভাবে জবাব দেয়া হয়।”

অতিসম্প্রতি ১১টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ইসলামী ব্যাংকের ৯,০০০ কোটি টাকার ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংক বাতিল করতে বলেছে, যদিও এই ঋণ ইতিমধ্যেই বিতরণ হয়ে গেছে।

তাই এসব পদক্ষেপকে অপর্যাপ্ত বলছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

নেত্র নিউজের একজন প্রতিবেদককে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো জবাবদিহি নেই। আগের গভর্নরকে ধরে এনে জিজ্ঞাসা করা উচিত, উনি কার নির্দেশ এসব ব্যাংকের মালিককে এভাবে টাকা নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নেতৃত্বও একই পথে হাঁটছে। এখন প্রকৃত নিরীক্ষা করে বের করতে হবে আমানতকারীদের কি পরিমাণ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এরপর শাস্তি হওয়া দরকার।”

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষকরা এই ব্যাংকের মালিকের কাছে শিশুতুল্য। তাই পর্যবেক্ষক বসিয়ে কোনোভাবে সুশাসন ফিরবে না। আমানতকারীদের জমা টাকারও সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে না।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক এস. আলম গ্রুপের ব্যাংকগুলোকে এক চোখে ও অন্য ব্যাংকগুলোকে অন্য চোখে দেখেছে। ফলে এই গ্রুপের ব্যাংকগুলো বিভিন্ন নামে টাকা বের করার সুযোগ পেয়েছে। এ জন্য এই গ্রুপের ব্যাংকগুলোর ওপর আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়েছে, আমানত কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়বে পুরো অর্থনীতিতে। এস. আলম গ্রুপ এত শক্তিশালী যে, বাংলাদেশ ব্যাংক চুপ থাকতে বাধ্য হয়েছে।”●