পেপে এসকোবার : হামাসের ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’-এর পরিকল্পনা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে করা হয়েছিল। ইসরায়েলে তাদের এই আক্রমণের তারিখ যুক্ত ছিল দুটি বিষয়ের সঙ্গে। প্রথমত, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তাঁর ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’ মানচিত্র তুলে ধরেছিলেন। সেখানে তিনি ফিলিস্তিনকে সম্পূর্ণরূপে বাদ দেন এবং এ বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিটি প্রস্তাবকে উপহাস করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, জেরুজালেমের পবিত্র আল-আকসা মসজিদে ধারাবাহিক উস্কানি। এর মধ্যে সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি হলো, ‘আল-আকসা ফ্লাড’-এর দু’দিন আগে অর্থাৎ ৫ অক্টোবর অন্তত ৮০০ ইসরায়েলি সেটলার মসজিদটির চারপাশে আক্রমণ শুরু করে; সেখানে আসা মানুষদের মারধর করে; ফিলিস্তিনি দোকান ধ্বংস করে। এগুলো হয়েছে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর চোখের সামনেই। কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন প্রত্যেকেই জানেন, আল-আকসা সংবেদনশীল জায়গা। এটি ফিলিস্তিনিদের জন্য যেমন আবেগের স্থান, তেমনি সব আরব ও মুসলিম বিশ্বের জন্যও।
ইসরায়েলিরা যেভাবে ‘পার্ল হারবার’ কৌশল গ্রহণ করেছে, তার পরিণতি খারাপই বয়ে আনছে। পার্ল হারবার ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের আমেরিকান অজুহাত। এর পর তারা জাপান আক্রমণ করেছিল। এবার গাজায় গণহত্যা শুরু করার জন্য ইসরায়েল হয়তো সেই ‘পার্ল হারবার’-এর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করছে।
পশ্চিমারা জাতিগত নির্মূলকে সাধুবাদ জানাচ্ছে। এর মধ্যে জায়নবাদীরা নিজেদের ‘বিশ্লেষক’ হিসেবে বলছে, ১৯৪৮ সালে ‘জনসংখ্যা স্থানান্তর’-এর যে কাজ শুরু হয়েছে, তা ‘সম্পূর্ণ করতে হবে’। তারা বিশ্বাস করে, অস্ত্রের ব্যবহার ও ব্যাপক মিডিয়া কাভারেজের মাধ্যমে বিষয়টার ওপর জনদৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে। তাদের কৌশল ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ ভেঙে দেওয়া এবং হিজবুল্লাহ ও ইরানের মতো হামাসের মিত্রদের দুর্বল করে দেওয়া। তাদের ইউক্রেন প্রকল্প পথ হারিয়েছে। এ যুদ্ধের কারণে পুরো ইউরোপীয় অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে। তবুও একটি দরজা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি খোলা: মিত্র ইউক্রেন থেকে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়াচ্ছে এবং প্রতিপক্ষ রাশিয়ার পরিবর্তে ইরানের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে। শুরু হয়েছে ‘ওয়ার অন টেরর’-এর নতুন খেলা।
প্রোপাগান্ডা চলছে ব্যাপকভাবে। তেল আবিবে নেতানিয়াহুর কাছে হামাস হলো আইএসআইএস। কিয়েভে ভলোদিমির জেলেনস্কির জন্য হামাস হলো রাশিয়া। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ শেষে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমা মূলধারার মিডিয়া যেন ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পূর্ণভাবে ভুলে গেছে। ব্র্যান্ডেনবার্গ গেট, আইফেল টাওয়ার, ব্রাজিলিয়ান সিনেট– সবাই এখন ইসরায়েলমুখী। মিসরীয় গোয়েন্দারা দাবি করেছে, তারা হামাসের আক্রমণ সম্পর্কে তেল আবিবকে সতর্ক করেছিল। ইসরায়েলিরা তা উপেক্ষা করে। তারা হামাসের প্রশিক্ষণ অনুশীলনও দেখেছিল। কিন্তু তারা খুব নির্ভার ছিল এ চিন্তায় যে, ফিলিস্তিনিরা কখনোই মুক্তি অভিযান শুরুর সাহস পাবে না। এর পরই শুরু হামাসের অপারেশন ‘আল-আকসা ফ্লাড’। তারা শক্তিশালী ইসরায়েলি গোয়েন্দা ও প্রতিরক্ষার যে মিথ ছিল, তা ভেঙে দেয়। সাহাল, মোসাদ, শিন বেট, মেরকাভা ট্যাঙ্ক, আয়রন ডোম, ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী– কেউই হামাসের হামলার আগাম তথ্য জানাতে পারেনি। হামাসের আল-আকসা ফ্লাডের পর ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালেন্ট ঘোষণা করেন, ‘গাজা সম্পূর্ণ অবরোধ করা হবে। সেখানে বিদ্যুৎ, খাদ্য, জ্বালানি, সবকিছু বন্ধ করা হবে। আমরা মানবপশুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি এবং সেভাবেই আচরণ করব।’ ইসরায়েলিরা আনন্দ নিয়েই সম্মিলিত অপরাধ সংঘটিত করতে পারে। কারণ তাদের পক্ষে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের তিনটি ভেটো শক্তি রয়েছে। ইসরায়েলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্র হারেৎজ সরাসরি স্বীকার করেছে, ‘আসলে ফিলিস্তিনিদের অধিকার না দেওয়ার জন্য যা ঘটেছে (আল-আকসা ফ্লাড), তার জন্য ইসরায়েল সরকারই দায়ী।’
পেছনে ফেরা যাক। ২০০৭ সালে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দাপ্রধান আমোস ইয়াদলিন বলেছিলেন, ‘হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নিলে ইসরায়েল খুশিই হবে। কারণ এতে ইসরায়েলি বাহিনী গাজার সঙ্গে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে আচরণ করতে পারবে।’ গত সপ্তাহের অভিযানের মধ্য দিয়ে বিচক্ষণ হামাস ফিলিস্তিনের জন্য যে কোনো সমঝোতায় জেতার দারুণ শক্তি জুগিয়েছে, গত কয়েক দশকে যা ফিলিস্তিনিরা পায়নি। এর আগে চীন, রাশিয়া, তুরস্ক, সৌদি আরব ও মিসর শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু তেল আবিব তা অগ্রাহ্য করেছে। নেতানিয়াহু গাজাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চান। তেমনটি যদি ঘটে, তাহলে একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধ প্রায় অনিবার্য।
তাৎক্ষণিক আল-আকসা ফ্লাডের সুফল এই যে, ইসরায়েল ও আরব বিশ্বের মধ্যে সম্পর্ক ‘স্বাভাবিকীকরণ’-এর যে স্বপ্ন ওয়াশিংটন দেখেছিল, দীর্ঘ যুদ্ধ হলে তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে। প্রকৃতপক্ষে আরব বিশ্বের বৃহৎ অংশ ইতোমধ্যে তেহরানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে। সদ্য সম্প্রসারিত ব্রিকস ১১-এর পাশাপাশি সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও), ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন (ইএইইউ) ও চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রতিনিধিত্ব করা একটি বহুমুখী বিশ্বের দিকে যাত্রা শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে ইউরেশীয় ও গ্লোবাল সাউথের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এখানে এক জাতিকেন্দ্রিক বর্ণবাদী রাষ্ট্রের স্থান নেই।
এ বছর আফ্রিকান ইউনিয়নের শীর্ষ সম্মেলন থেকে ইসরায়েলি প্রতিনিধি দলকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। গত মাসে জাতিসংঘের অধিবেশনে এক ইসরায়েলি কূটনীতিক ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির বক্তৃতায় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কোনো পশ্চিমা মিত্র তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি এবং তাঁকেও সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০২২ সালের ডিসেম্বরে গুরুত্ব দিয়ে বলেন, বেইজিং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। ১৯৬৭ সালের সীমানার ওপর ভিত্তি করে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে তার পূর্ণ সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিচ্ছে। চীন জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য হওয়ার জন্য ফিলিস্তিনকে সমর্থন করছে।
তেহরানের কৌশল আরেককাঠি সরেস। তারা লেভান্ত থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত পশ্চিম এশীয় প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোকে কৌশলগত পরামর্শ দেয়। এগুলো হলো– হিজবুল্লাহ, আনসারুল্লাহ, হাশদ আল-শাবি, কাতাইব হিজবুল্লাহ, হামাস, ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ এবং অন্য অনেক সংগঠন। তারা যেন সবাই গ্র্যান্ডমাস্টার ইরানের তত্ত্বাবধানে নতুন বড় দাবা বোর্ডের অংশ। হামাসের অপারেশন ‘আল-আকসা ফ্লাড’-এর ভূরাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাশিয়া, চীন ও ইরানের ভূ-অর্থনৈতিক এবং লজিস্টিক সংযোগ, প্রভাবশালী রাষ্ট্র এবং এর ঘাঁটিগুলো পাশ কাটিয়ে আরও শক্তিশালী হবে। তাদের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি ও ক্রমাগত কার্গো চলাচলসহ সব ব্যবসা চলমান থাকবে। সমান শর্তে পারস্পরিক শ্রদ্ধার সঙ্গে সবাই সুবিধা ভোগ করবে।
পেপে এসকোবার: ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক; দ্য ক্রেডল থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
সমকাল