Daily Naya Diganta
চট্টগ্রামে ইসকনের এক জনসমাবেশ হয়েছে। প্রথম আলোর রিপোর্ট অনুসারে এ সমাবেশের আয়োজকদের সম্পর্কে লেখা হয়েছে- ‘বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রামের নন্দনকানন চত্বরে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটি আয়োজিত এক সমাবেশ হয়েছে।’
‘ইসকন’ ১৯৬৬ সালে আমেরিকায় রেজিস্টার্ড এক হিন্দুধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যা ‘কৃষ্ণনামের এক বিশেষ ব্যাখ্যা’ প্রচারের সংগঠন হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু তা সত্তে¡ও এই শতকে এসে আমেরিকার সংসদে ও সিনেটে ভারত সরকারের পক্ষে আমেরিকান নীতি পলিসিকে প্রভাবিত বা লবি করতে ভারত আমেরিকায় যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির মিলিত এক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল, ক্রমেই ইসকনও তার অংশ হয়ে যায়। এর নিট ফলাফল হলো ইসকন আর নেহায়েতই ধর্মপ্রচারের সংগঠন থাকেনি। এর ফোকাস বদলে যায়।
আমেরিকা হলো এমন সমাজ যেখানে বহু বছর আগে থেকেই মানুষের জীবনে থিওলজির আর প্রয়োজন নেই; মানুষের থিওলজিক্যাল নিড আর নেই- এমন মনে করা বা ঘোষণা করা এক সমাজ। এই অনুমান-ধারণাটা যে ভিত্তিহীন এবং যথেষ্ট ভেবেচিন্তা বলা ভাষ্য নয় এরই প্রমাণ হলো সেকালের জন্মের শুরুতে ইসকনের টিকে যাওয়া। থিওলজি মানে আন্তঃসম্পর্ক বোধ, যা আমাদের ভেতরে এক কানেকটেড বোধ জাগিয়ে দেয় বা রাখে। সে আন্তঃসম্পর্ক হতে পারে মানুষে-মানুষে অথবা প্রকৃতির (মানুষ বাদে) সব কিছুর সাথে মানুষের আন্তঃসম্পর্ক। আর এসব যেকোনো দুইয়ের সম্পর্কের মাঝে থাকে ‘আলাহ’ ধরনের এক ধারণা যার মাধ্যমে আসলে আমরা সবাই সব কিছুর সাথে সম্পর্কিত বোধ করতে থাকি। এতে মানুষের বেঁচে থাকাটা মিনিংফুল এবং উদ্দেশ্যসম্মত মনে হতে থাকে। কিন্তু মডার্নিটির সস্তা বা দায়দায়িত্বহীন ব্যাখ্যার কারণে নিজেরা থিওলজিক্যাল নিড শূন্য ঘোষণা করে দেয়াতে পশ্চিম নিজের ক্ষতি করে ফেলেছে; অথচ বাস্তবে মানুষমাত্রই কম-বেশি একটি থিওলজিক্যাল চাহিদা থেকেই যায়। এ গ্যাপটা পূরণ করতেই এশিয়ান থিওলজিগুলোর অনেকেই পশ্চিমে এসে পপুলারিটি পেয়ে যায়। ইসকন প্রথম দিকে এ সূত্রেই জায়গা পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরে ভারতের লবি প্রতিষ্ঠানগুলোর জোটের অংশ হয়ে যাওয়াতে ইসকনের ফোকাস সরে গেছে। এমনকি নেতৃত্বও বদলে যায়, পরিচালন ক্ষমতায় এমন এক ক্যু হয়ে গেল। এতে আগের ধর্মপ্রচারের উছিলায় আমেরিকায় জন্মানো এশিয়ান থিওলজির প্রতিষ্ঠান এবার হয় ঘোরতর এক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। বিশেষত ভারত সরকারের বর্ধিত হাতের ভ‚মিকায় তার গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে কাজ করার প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে বাংলাদেশ ইসকন হলো বাংলাদেশের হিন্দুদের সাথে ও কাছে ভারত সরকার ও তার গোয়েন্দা সংস্থার যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়ার বা পৌঁছানোর হাতিয়ার। ইসকন এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রবিরোধী এক সংগঠন; যদিও পরিকল্পিতভাবেই ইসকনের আগের ধর্মীয় ভাব ও এর বাইরের আদল সবই বজায় রেখে দেয়া হয়েছে। আর ওদিকে এই নয়া ইসকন এখন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও বিদেশে নাশকতা ও অপতৎপরতার সংগঠন ‘র’-এর বর্ধিত হাত হয়ে নিজেকে সাজিয়ে হাজির করতে থাকে।
শুধু তা-ই নয়, এতে অবস্থা এখন এমনই যে, একালের আরএসএস-মোদির যুগে বাংলাদেশের ইসকনের তৎপরতায় বাংলাদেশের হিন্দুরা যেন কালচারালি বাঙালি হিন্দু নয়; তারা যেন আরএসএসের যে উত্তর প্রদেশের হিন্দু ব্যাখ্যা আছে তার অনুসারী করে নেয়ার এক প্রোগ্রাম। এটিই ইসকনের প্রধান কর্মসূচি এবং তা নিশ্চিত করাই এর কাজ। যেমন বাঙালি হিন্দুকে উত্তর প্রদেশের হিন্দুর স্টাইলে নিরামিশাষী হতে শেখাচ্ছে তারা, ইসকন মার্কা কৃষ্ণভক্ত হওয়ার নামে। অথচ এথনোলজিক্যাল জাতির বিচারে হিন্দু বাঙালির খাদ্যাভ্যাস হলো তারা ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। মানে এরা নিরামিষের লোক নয়। এথনোলজির বিচারে আমরা বাঙালি হিন্দু, উত্তর প্রদেশের আর্য অনুসারী হিন্দু নই। অথচ পুরো উল্টা-পাল্টাই তারা বাংলাদেশে করছে সবাইকে আরএসএস বর্ণিত হিন্দু সাজাতে। আবার এ দিকে বাইরে থেকে দেখে চেনার উপায় চিহ্ন হিসেবে গলায় ‘কাঠের মালা’ পরাচ্ছে। অথচ ফ্যাক্টস হলো, গলায় কাঠের মালা মূলত যারা নদীয়ার গৌড় বা বৈষ্ণব অনুসারী তাদের রেওয়াজ; এবং সবচেয়ে বড় কথা, বাঙালি হিন্দু মাত্রই সবাই নদীয়ার শ্রীচৈতন্যের অনুসারী বা বৈষ্ণব নয়। অর্থাৎ বাঙালি হিন্দু মাত্রই গলায় কাঠের মালা পরা তাদের রেওয়াজ নয়। অথচ আরএসএসের হিন্দু হলো, তারা এটিকে এক ইউনিফর্ম ধারণায় সাজিয়ে নিতে চায়। তাই হিন্দু বাঙালি মাত্রই ইউনিফর্মের মতো সবাইকে কাঠের মালা পরার রেওয়াজে নিতে চায়; অর্থাৎ পুরোটাই রাজনৈতিক ও ভিন দেশের অসৎ রাজনৈতিক স্বার্থ তারা চাপিয়ে রাজত্ব করতে চায়। মূলত এর মূল উদ্দেশ্য হলো আরএসএসের উত্তর প্রদেশকেন্দ্রিক যে হিন্দুত্ববাদী ব্যাখ্যা আছে, বাংলাদেশের হিন্দুদেরও বলপ্রয়োগ করে হলেও এর অংশ করে নেয়া- তাও খাঁটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।
কাজেই আরেক অর্থে বাংলাদেশে ইসকন হয়ে উঠেছে ‘ফুট সোলজার’; মোদি সরকারের ‘বাংলাদেশ দখল নীতি’ বাস্তবায়নের ভয়ঙ্কর হাতিয়ার। স্বাধীন দেশে এটি বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের কাছ থেকে ‘আশা’ করা যায় না। বাংলাদেশের কোনো নাগরিক মোদির নীতির বাস্তবায়ক হতেই পারে না। কারো প্রভাবহীন ও স্বাধীন থাকতে চাইলে বাংলাদেশ সরকারও এটি আশা করতে পারে না; তাকে এটি দমন করতেই হবে। এটি রাষ্ট্র স্বার্থের প্রশ্ন।
এ দিকে এটি হতবাক করার বিষয় যে, সেই ইসকন চট্টগ্রামে জনসমাবেশ ডেকেছে আর তাতে যোগ দিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে লেগেছে প্রতিযোগিতা যে, কে বেশি ইসকনের সুনজর ও অনুগ্রহ লাভ করবে! এর প্রতীকী অর্থও খুবই বিপদের ও লজ্জাজনক! অর্থাৎ কে বেশি ভারতের অনুগ্রহ লাভ করবে? আর তাতে আওয়ামী লীগ যদি ১৩ বছরের শাসন চালাতে পারে তবে বিএনপির ভাগ্যেও নিশ্চয় এর কাছাকাছিই কিছু একটি হবে। এমন অনুমান, তাই কি? তবে মিডিয়া রিপোর্টের এ উপস্থাপনটাই মারাত্মক। লিখেছে, ‘সমাবেশে চট্টগ্রামের উত্তর-দক্ষিণ, নগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি নগর বিএনপির নেতারা উপস্থিত ছিলেন।’ কিন্তু মজার কথা হলো, এর পরও বিএনপির কেবল একটি নেতার নাম আছে। অথচ আওয়ামী লীগের সবচেয়ে ছোট নেতাটার নামও সেখানে দেয়া আছে। আর ভোরের কাগজ লিখেছে, ‘নগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা: শাহাদাত হোসেন’ সেখানে বক্তৃতা করেন।
‘সাম্প্রদায়িক হামলা নয়, এটি ষড়যন্ত্র’
গুগল সার্চে প্রকাশিত মিডিয়া রিপোর্টগুলোতে দেখা যায় ‘এটি সাম্প্রদায়িক হামলা নয়, এটি ষড়যন্ত্র’ এমন বক্তব্যে সবচেয়ে বেশি রেফারড হয়েছেন আইনমন্ত্রী। আর ভারতের কিছু মিডিয়ায় দেখা গেছে একই বক্তব্য দিয়েছেন খোদ আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। এমনকি গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মৃত্যু ও ধর্ষণের নানা গল্প ছড়ানো হচ্ছে।’ অর্থাৎ সরকারের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত প্রপাগান্ডা মানে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। অথচ এর পরও চট্টগ্রামের সমাবেশের নাম হলো ‘সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে’ এই সমাবেশ। প্রচলিত শব্দ ‘সাম্প্রদায়িক হামলা’ কথাটা দিয়েই সব জায়গায় কুমিল্লার ঘটনাকে বর্ণনা করা হচ্ছে। অথচ ইকবাল হোসেন গং তারা এখনো রিমান্ডে আর তাদের পেছনে কে আছে? নিয়োগ বা অ্যাসাইনমেন্ট দাতা কারা? ‘র’ না ‘ইসকন’? এখনো তা পরিষ্কার নয়। কিন্তু তা ঢেকে দেয়ার প্রপাগান্ডা চলছেই!
এমনকি চট্টগ্রামে ইসকনের সমাবেশে প্রধান গুরুত্ব পায় দু’জন হিন্দুব্যক্তিত্বের বক্তব্য। এর প্রথমজন রানা দাসগুপ্ত, তিনি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদের সাধারণ সম্পাদক। তাদের দেয়া ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দের বর্ণনা অনুযায়ী কি খোদ রানা দাসগুপ্তের সংগঠনের নামটাই তাদের কথিত ‘সাম্প্রদায়িক’ নয় কি?
আবার লক্ষণীয়, ওই সমাবেশে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা ও আক্রমণের মুখে পড়েছে আওয়ামী লীগ। সময়ে মনে হয়েছে কেউ কেউ আওয়ামী লীগের বিকল্প এবার পেয়ে গেছে। এবার তারা বিএনপিকে ক্ষমতায় আনবে। রানা দাসগুপ্ত বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কোনো রাজনীতিবিদের ওপর আমাদের আস্থা নেই। আমরা সরকারি দলের মধ্যে আত্মশুদ্ধি চাই।’ কেউ কেউ এই দ্বিতীয় বাক্যটাকেই মিডিয়ায় শিরোনাম করেছে।
রানা দাসগুপ্ত কড়া অভিযোগগুলো তুলেছেন। এমনকি এটিও বলেছেন, ভোরের কাগজ লিখেছে, ‘আওয়ামী লীগ ক্রমেই ১৯৪৮ সালের আওয়ামী মুসলিম লীগের দিকে চলে যাচ্ছে।’ বহু পুরনো দিন থেকেই মুসলিম লীগ নিয়ে হিন্দু নেতাদের অভিযোগের শেষ নেই; যদিও খোদ শেখ মুজিবও এর নিন্দা করেননি বা নিজে মুসলিম লীগার ছিলেন বলে কখনো অস্বীকার করেননি। এমনকি হাসিনা শেখ মুজিবের আত্মজীবনী প্রকাশ করেছেন তাকে মুসলিম লীগার হিসেবেই বর্ণনা বজায় রেখে এবং কোনো রাখঢাক না করেই।
আসলে ভারতের কংগ্রেস যেমন হিন্দু জাতিবাদী দল; সমতুল্যভাবে (পূর্ব) পাকিস্তানে মুসলিম লীগ মুসলমান জাতিবাদী দল। অথচ বাংলাদেশের হিন্দু নেতারা কংগ্রেসের চোখ দিয়ে কংগ্রেস যেমন মুসলিম লীগকে তার মুখ্য প্রতিদ্ব›দ্বী দল হিসেবে দেখে, সেভাবে ও চোখেই দেখে গেছে। অথচ কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি কোনো সর্বজনীন স্ট্যান্ডার্ড নয়, কারণ এটি হিন্দু-জাতিবাদী চোখ। ফলে পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ ওই দৃষ্টিভঙ্গি কখনো গ্রহণ করেনি। অথচ রানা দাসগুপ্তরা অযথা এই পণ্ডশ্রম করে গেছেন। এখানেও করেছেন। কংগ্রেস বা একালের বিজেপি এদের হিন্দুত্ববাদী চোখ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশকে দেখতে হবে ও সাজানোর দাবি করতে হবে। নইলে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে ট্যাগ লাগিয়ে দেবে। অবশ্য এখানে একটি সূ² দিক আছে। লক্ষণীয়, আসলে রানা দাসগুপ্ত কিন্তু ‘মুসলিম লীগ’ বলেনইনি। বলেছেন ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। অর্থাৎ যেটা আওয়ামী লীগেরই আগের নাম বা প্রথম জন্মকালীন নাম। তা হলে আওয়ামী মুসলিম লীগের দিকে যাওয়া বলতে তিনি এমনকি আপত্তির দেখছেন বা তার বিশেষ অভিযোগটা কী? পুরোটাই ভুয়া। রানা দাসগুপ্ত কি তা হলে ভাসানী-শামসুল হকের আওয়ামী মুসলিম লীগের গায়ে দাগ লাগিয়ে দিতে চাইছেন? নাকি কিছু ভেবেচিন্তে বলেননি?
আসলে ব্যাপারটা হলো, কংগ্রেস যদি হিন্দু-জাতিরাষ্ট্রের প্রবক্তা ও কায়েমকারী হয় তা হলে এই দলের বা সমর্থকের কি আর মুসলিম লীগকে বিরোধিতা বা নিন্দা করার সুযোগ থাকে? কারণ কংগ্রেসই কি মুসলিম-জাতিরাষ্ট্রের জনক নয়? তাদের হিন্দু জাতিরাষ্ট্র গড়তে বেপরোয়া হওয়াটাই কি মুসলমানদের মুসলিম-জাতিরাষ্ট্র গড়তে বাধ্য করা ও উৎসাহ দেয়া নয়? ডেকে আনার প্রতিষ্ঠান নয়? ভারতকে কংগ্রেস যদি হিন্দু-জাতিরাষ্ট্র করে আকার দিতে চায়, তবে এটিই কি প্রকারান্তরে মুসলমানদের ঠেলে দেয়া নয় যে, ভারত বা কংগ্রেসে তোমাদের জায়গা নেই তাই তোমরা একটি পাল্টা মুসলিম-জাতিরাষ্ট্র গড়ে নাও? তা হলে হিন্দু-জাতিরাষ্ট্রধারী কংগ্রেসের মুসলিম লীগকে কোনো সমালোচনা বা আপত্তির জায়গা কই? করলে সেটি তো নিজেরই সমালোচনা হবে!
মনে হচ্ছে সূর্য সেনদের রাজনীতি রানা দাসগুপ্ত এখনো করে যাচ্ছেন। কলকাতাকেন্দ্রিক অবিভক্ত বাংলার জমিদাররা তাদের সব ক্ষমতা ও প্রভাব কলকাতাকে কেন্দ্র করে ধরে রাখতে চান। আবার এ-ও আবদার যে, ব্রিটিশদের অবকাঠামোগত ব্যয় সব কলকাতাতেই হোক। কিন্তু ব্রিটিশরা তা মানেনি, সম্ভব ছিল না। তারা বাংলাকে ভাগ করে ঢাকাকে রাজধানী করে আলাদা অবকাঠামো গড়তে ব্যয় করতে চেয়েছিল। কেন? মূল কারণ তত দিনে আসাম চা উৎপাদন যোগ্যতার জন্য তৈরি ও সম্পন্ন হয়ে গেছে। অথচ চা বিক্রি, বিতরণের জন্য সেই চা চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে যেতে ঢাকা পেরিয়ে নারায়ণগঞ্জে ছোট জাহাজে তোলার কোনো অবকাঠামোই ছিল না। এ কারণে ঢাকাকে রাজধানী করে আসাম ও পূর্ববঙ্গকে নিয়ে আলাদা প্রদেশ করা হয় ১৯০৫ সালে। এটিই ‘বঙ্গভঙ্গ’। আর এটিই সহ্য হয়নি কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু জমিদারদের, চ্যালেঞ্জ বোধ করেছেন যে, ঢাকা কলকাতার প্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে যাবে তাতে। এ ছাড়া পূর্ববঙ্গে জনসংখ্যার দিক থেকে মুসলমানরা বেশি; ফলে কলকাতার মতো একচেটিয়া কুক্ষিগত প্রভাব তারা ঢাকায় জমাতে নাও পারতে পারেন। এটিই ছিল হিন্দু জমিদারদের ভীতি আর এই স্বার্থে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা এবং এ জন্য তারা অস্ত্র হাতে শাসকদের বিরোধিতা করেছিলেন। তা হলে সূর্য সেনরা ছিল মূলত হিন্দু জমিদারদের স্বার্থে কাজ করেন এবং সবচেয়ে বড় কথা, চট্টগ্রামের লোক হয়েও সূর্য সেনরা নিজ পূর্ববঙ্গের স্বার্থের বিরোধী। কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু জমিদারদের পক্ষে দাঁড়ানো লোক হলো পূর্ববঙ্গের, বাংলাদেশের কেউ হতে পারেন না; বরং কলকাতার জমিদারের পক্ষের লোক। কাজেই পূর্ববঙ্গের চোখে তারা কোনো বীর নন; বরং পূর্ববঙ্গের বা ঢাকার স্বার্থের বিরোধী। কাজেই কথিত স্বদেশী এটি কাদের আন্দোলন? কলকাতার এবং হিন্দু জমিদারদের জন্য স্বদেশী। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এটি পূর্ববঙ্গের স্বার্থই নয়। অথচ জবরদস্তিতে কলকাতা বা কংগ্রেসের স্বার্থটা বারবার আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
এখনো কংগ্রেসের স্বার্থ ও অবস্থানের চিন্তাটাই রানাদের মাথায় সবসময় ভর ও ডমিনেট করে। ফলাফলে হিন্দু জমিদার স্বার্থ তার চোখে হয়ে যায় কথিত অসাম্প্রদায়িক আর কেউ এর বিরোধিতা করলেই হয় ‘সাম্প্রদায়িকতা’। এই মুখস্থ কথা আর কত দিন?
একালে কিছু হলেই আরেক বক্তব্য হলো রাষ্ট্রধর্মে ইসলামের বিরোধিতা। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের আদালতেও কোনো মামলায় হেরে গেছে, মুসলমানের অধিকারের সাথে সমান অধিকারের ট্রিটেড হননি এবং সেটি ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হওয়ার কারণে, এমন রেকর্ড কোথাও আছে কি? অর্থাৎ অধিকারে কোনো অসাম্য হয়নি। তবে ডেকোরেটেড পিস হিসেবে শব্দগুলো আছে। অর্থাৎ এটি একটি জেদ-ক্ষোভের সিম্বল। কিন্তু তা-ই-বা কেন? কারণ ইন্দিরা গান্ধী প্রগতিশীলতার নামে, অসাম্প্রদায়িকতার নামে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রচিন্তায় কল্পিত এক অর্থহীন ‘সেকুলার’ ধারণা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। এতে আবার সেই ইসলামবিদ্বেষ ফোবিয়া চালু করেছেন। অথচ ১৯৪৭ সালে ভারতকে হিন্দু জাতিরাষ্ট্র (নেশন-স্টেট) বানালেও নেহরু-গান্ধী কখনোই ভারতের কনস্টিটিউশনে ‘সেকুলার’ শব্দটা রাখেননি; বরং আমাদের ওপর জবরদস্তি করার পরে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৬ সালে এবার ভারতের কনস্টিটিউশনের ৪২তম সংশোধনী হিসেবে ‘সেকুলার’ শব্দটা অন্তর্ভুক্ত করেন। আর সেই থেকে অনেকের ভুল অনুমান হলো, হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রচিন্তায় কল্পিত এক অর্থহীন ‘সেকুলার’ শব্দসহ সব কিছুই নিশ্চয় আমাদের কনস্টিটিউশনেও থাকতেই হবে। তা হলে এটি অসাম্প্রদায়িক হবে, নইলে নয়।’ কিন্তু নতুন বাংলাদেশ তো অন্তত মুজিবের ‘বাঙালি নেশন স্টেট’; ভারতের মতো ‘হিন্দু নেশন স্টেট’ কোনোভাবেই নয়। ফলে ভারতকে কপি করতে হবে কেন আর তা ফিট করবে কেন? ফলে সেই থেকে তাদের ‘কল্পিত দুঃখে’ আমাদেরও খাচ্ছেন।
ওদিকে ১৯৭১-৭২ সালে এই সেকুলারিজম চাপিয়ে দেয়ার বিরোধিতা সহজ বা সময়ের সাথে মানানসই ছিল না বা হতো না। এ জন্য এমনকি শেখ মুজিবই তা বিরোধিতা করতে যাননি। তাই পঞ্চম সংশোধনী লেখার সময় আর পরে অষ্টম সংশোধনী লেখার সময় সেই জিদ উসুল করা হয়েছিল।
এই রাগ-জেদের দিকটা ভালো বোঝা যায় যখন পঞ্চম সংশোধনীতে সেকুলারিজম ফেলে দিয়ে লেখা হয়েছিল ‘আল্লার উপর অগাধ বিশ্বাস’। অর্থাৎ যেন বলতে চেয়েছে, ভারতের এক হিন্দু নেশন স্টেট রাষ্ট্রচিন্তায় কল্পিত ‘সেকুলার’ শব্দটা বাংলাদেশে তোমরা চালু করতে চেয়েছে অযথা। কারণ বাংলাদেশ তো হিন্দু নেশন স্টেট কখনোই নয়। কাজেই ইসলাম বা মুসলমানদের কন্ট্রোল করা আবদ্ধ রাখা জাতীয় কোনো শব্দ ইসলামবিদ্বেষ ও ফোবিয়ার বুদ্ধি। আর এর প্রতিবাদ চিহ্ন লটকে দিতেই ১৯৮৮ সালে আরো পোক্ত হবে ভেবে রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করে দেয়া। অথচ এর কোনো ব্যবহারিক বা লিগ্যাল ইমপ্লিকেশন নেই, কারো কারো জন্য হয়তো এক অস্বস্তি ছাড়া। আর এটিই মুসলমান হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী অ্যান্ড গংদের ওপর শাস্তির মতো বা প্রতিবাদ চিহ্ন লটকে দেয়া।
এসব কথার সবচেয়ে ভালো প্রমাণ হলো, রানা দাসগুপ্ত বা অনুপম সেনরা এখন কী বলছেন তা যদি দেখি। সারকথায় তারা বলছেন, তারা বাহাত্তরে ফিরে যেতে চান। অথচ খোদ শেখ হাসিনাই তো ১৫তম সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম আর সেকুলারিজম দুটোই রেখে দেন; অথচ কায়দা করে রানা দাসগুপ্ত বলছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কোনো রাজনীতিবিদের ওপর আমাদের আস্থা নেই। আমরা সরকারি দলের মধ্যে আত্মশুদ্ধি চাই।’
আসলে এসব কায়দা করে লাভ নেই। কিন্তু তারা এখন এসব কথা তুলছেন কেন? আমাদের দুই রাজনৈতিক দলই এখন ভারতের আনুগত্য লাভের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত এবং তা সরাসরি ভারতের কাছেও না, তার ‘র’-এর কাছেও না একেবারে ‘র’-এর হ্যান্ডলার ইসকনের কাছে হাত পেতেছে আর তা দেখে আপনাদের নিজেকে অনেক পাওয়ারফুল মনে হচ্ছে? কিন্তু আর কত? ২০০ বছর হয়ে গেল এই দাবড়ানোর চিন্তাতেই আজ আমরা তিন দেশই বিচ্ছিন্ন, ধুঁকছি।
আসুন হিংসা পাশে ফেলে রাখি। আর আপনাদের চোখে ধর্মই যদি সব সমস্যার উৎস হয়ে থাকে ব্রাহ্মধর্ম বা ব্রাহ্মসমাজের কথা তো শুনেছেন। অবিভক্ত ভারতে রাষ্ট্র ধারণার গোড়া যেখান থেকে, সেই ১৮১৫ সালে রামমোহন রায় যিনি আবার বেঙ্গল রেনেসাঁর আদিগুরু, তা হলে তিনি নতুন করে ব্রাহ্মধর্ম বা ব্রাহ্মসমাজ চালু করেছিলেন কেন? রেনেসাঁর আদিগুরুর সাথে ধর্ম? এত দুধ আর লেবুর চেয়েও খারাপ মিশ্রণ! এটি কেন? উচিত হবে এর কারণ খুঁজে দেখা। ব্রাহ্মসমাজ জন্মের কারণ ধরতে পারলে বুঝে যাবেন, ধর্ম (আসলে ইসলাম ধর্ম) নিয়ে আপনাদের অনুমান কতটা ভিত্তিহীন।
অথচ খুবই সহজ এসবের সমাধান। আমাদের ‘জাতি-রাষ্ট্র’ ধারণা ত্যাগ করতে হবে। বদলে তা অধিকারভিত্তিক নাগরিক রাষ্ট্র হতে হবে যেখানে সবাই সমান অধিকারের নাগরিক। ফলে হিন্দু বা মুসলমান (বা জুম্ম জাতি) জাতি পরিচয় নিয়ে লড়ার কিছু থাকবে না। তখন দেখবেন, সেকুলার বা অসাম্প্রদায়িক ধরনের শব্দের আর দরকার নেই, লাগছে না।
শেষ কথা
এত সেকুলারপ্রিয় আপনারা যারা সেকুলার ভারতের কনস্টিটিউশনকে আদর্শ মনে করেন, ভারতের এই কনস্টিটিউশন আরএসএসের মোদিকে রাজত্ব করতে জায়গা করে দেয় কেমন করে? সেই প্রশ্ন করুন না। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট, নির্বাচন কমিশনও এতে কোনো সেকুলারিজমের সমস্যা দেখে না! কেন?
এ ছাড়া অনেকেই দেখি এই মোদির সাথে দেখা করে এসে বলশালী অনুভব করেন। কিভাবে করেন এগুলো? তা হলে আপনারা ঠিক কী চান? বাহাত্তরের কনস্টিটিউশন নামের আড়ালে মোদির ভারতের আধিপত্য ও অধীনস্থতা কায়েম? পারস্পরিক বিশ্বাসযোগ্যতা না বাড়ালে কিছু পরিবর্তন কাজ করবে না।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com