আমার দেশ
হাছান বসরি
এই আজব কাহিনীর সব চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত কিংবা মৃত কোনো ব্যক্তি, অথবা কোনো ঘটনার সাথে মিল পাওয়া গেলে তা নিতান্তই কাকতালীয়। এর জন্য গল্পকার দায়ী থাকবে না।।
আজব রানীর রাজ্যে সবই আজব। এই জাহানে আজব আব্বা দ্বিতীয়টি জন্ম নেই নাই। যুদ্ধ মারফৎ স্বাধীনতা অর্জনের মত আজব ঘটনা আজব আব্বা ছাড়া ইহ জনমে কেউ ঘটায় নাই। নয় মাসের একটা ঠুস ঠাস যুদ্ধে তিরিশ লাখ আদম সন্তানের আত্মাহুতির আজব পরিসংখ্যান কস্মিন কালেও কেউ শ্রবণ করে নাই। বছর ব্যাপী খৎনা শতবার্ষিকী পালন করার মত আজব কাহিনী দুনিয়া-বাসি অতীতে কল্পনা করে নাই, ভবিষ্যতেও করবে না।
আজব রানীর রাজ্যে তাই উৎসবের ডামাডোল- হৈ হৈ কান্ড, রৈ রৈ ব্যাপার। উপলক্ষ(?) আজব আব্বার খৎনা শতবার্ষিকী। প্রাথমিক ভাবে বছর জুড়ে উৎসবের পরিকল্পনা থাকলেও শেষতক তা’ দ্বিবার্ষিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। আজব রাজ্যের উত্তরাধিকারী, আজব রানীর এক নম্বর আব্বা, প্রজাকুলের দুই নম্বর আব্বা, ওরফে আজব আব্বার খৎনা শতবার্ষিকী বলে কথা।
নাচ, গান, মিলাদ মাহফিল, আজব আব্বা বন্দনা, ‘হায় আব্বা, হায় আব্বা’ মাতম জলসা, আতসবাজি, রাজ্যের আনাচে কানাচে আজব আব্বার মূর্তি স্থাপন, মূর্তির গায়ে কম্বল লেপন, জামাই রাজ সহ আরও অনেক বিদেশি অতিথির আগমন এবং আরও নানাবিধ রং-ঢং মিশ্রিত, ঝাকানাকা সব আয়োজনে কেটে গেল প্রায় দুটি বছর।
দ্বিবার্ষিক খৎনা উদযাপনে সর্বশেষ সংযোজন দীন-এ-এলাহী কায়দায় দিন-এ-আজব আব্বা নামের নতুন এক ধর্মের শুভ মহরৎ। এ উপলক্ষে রাজ্যে নতুন দুটি ধর্মিয় আচার চালু হয়েছে। প্রথমত, ঘরে ঘরে কল্লা তলা প্রতিষ্ঠা করে সেখানে সকাল সন্ধ্যা আজব আব্বার কল্লা পূজার প্রচলন। আর দ্বিতীয়ত, আব্বা কোট পরিধান করে, নগরীর জিরো পয়েন্টে স্থাপিত আজব আব্বার বিশালাকার মূর্তি চক্রাকারে প্রদক্ষিণ, সাথে ‘হাজির, আজব আব্বা হাজির’ রব তোলা।
নিদারুণ টেনশনের মধ্যে দিয়ে দিন কাটছে আজকাল আজব রানীর। আব্বার মূর্তি বিসর্জনের লগ্ন ঠিক হয়েছে আগামী দশ তারিখ প্রত্যূষে। সেদিন রানী একটা খেলা খেলতে চায়। সেই ব্যাপারে আলাপ করার জন্যই আজকে রানী বিশেষ গোপন সভায় বসেছে। তাঁর উজিরেরা অবশ্য আজকাল ‘উন্নয়ন, উন্নয়ন’ জিকিরের পাশাপাশি ‘খেলা হবে, খেলা হবে’ জিকিরের উপর বেশ আমল করছে।
স্বর্ণ নির্মিত তক্তপোষে পা মেলে, মণিমুক্তা খচিত রাজ সিংহাসনে বসে আছে আজব রানী। আয়েশের বদলে কপালে তাঁর দুশ্চিন্তার কুঞ্চন। সভাসদবর্গ যথারীতি আজব রানীর পা চেটে যার যার আসন গ্রহণ করছে।
নিজের ভেতরের দুঃশ্চিন্তা বা উত্তেজনা যথাসাধ্য গোপন করে রানী তাঁর সূচনা বক্তব্য শুরু করল, “প্রিয় সভাসদবর্গ, আজব আব্বার খৎনা শতবার্ষিকী, থুক্কু খৎনা শতদ্বিবার্ষিকী নামের আজব উৎসবের অন্তিম লগ্ন সমাসন্ন। আপনারা জানেন স্বপ্ন দেখা আমাদের খানদানী পেশা এবং নেশা। আমার আব্বা দিবানিশি স্বপ্ন দেখতেন। তাই স্বপ্নের ঘোরেই একদিন বেঘোরে প্রাণটা – – “
এ পর্যায়ে রানী একটু থামল- কারণ সে এখন ক্রন্দন করবে। প্রথানুযায়ী রাজদরবারে শোকের আবহ তৈরি হলো। কেউবা বুক চাপড়ে মাতম করল ‘হায় আব্বা, হায় আব্বা’। আবার কেউবা গাইতে থাকল ‘ফাইটা যায়, রানীমা বুকটা ফাইটা যায়’।
“আমার পূর্বপুরুষ মরুরাজ্য থেকে খচ্চরের পিঠে সওয়ার হয়ে এ রাজ্যে এসেছিলেন ধর্ম প্রচার করতে। আজব আব্বা স্বপ্ন দেখতেন নতুন এক ধর্মের। আজ আব্বার স্বপ্ন সার্থক। শুভ মহরৎ ঘটেছে নতুন এক ধর্মের- দীন এ আজব আব্বা। আব্বার বিশালাকার ভাস্কর্য, স্ট্যাচু অফ আজব আব্বা বুক ফুলিয়ে, দাঁত কেলিয়ে, কম্বল লেপিত হয়ে নগরীর প্রবেশ দারে শোভা পাচ্ছে। বিশ্ব দরবারে আজব আব্বার এই ঈর্ষণীয় অর্জনে শকুন আর হায়েনার নজর লেগেছে। সেই চেতনা বিরোধী শকুন আর হায়েনাদের বিরুদ্ধে দশ তারিখে খেলা হবে।“
রাজদরবারে পিন পতন নিস্তব্ধতা। সবাই ভাউ বোঝার চেষ্টা করছে। কারণ ‘পীরিতের বাজার ভালা না’। চারিদিকে মন্দ বাতাস, সেই বাতাসে টর্নেডোর পূর্ভাবাস। কে, কখন, কীভাবে, কী খেলা যে খেলবে তা বোঝা দুষ্কর।
আজব রানী হুঙ্কার ছাড়ল, “কই কথা বলেন! খেলা হবে, ঠিক্কিনা?”
কাউয়া উজির নীরবতা ভেঙ্গে ডাকল, কা, কা, কা – –
ধমক দিয়ে রানী বলল, “এই, কা, কা, কীরে? কথা বল ঠিক ঠাক। বদের লাঠি কাহাকা।“
কাউয়া- না মানে বলছিলাম বেশ ক’দিন থেকে আমার পাতলা পায়খানা শুরু হয়েছে। ভাবছিলাম দশ তারিখের আগে ছিঙ্গাপুর না হলেও পাশের রাজ্যে গিয়ে যদি একটু চিকিৎসা করানো যেত।
আলগা কোমেন- কাউয়া উজির একা একা বিদেশ বিভূঁইয়ে যাবে, দুষ্টু লোকেরা যদি উলটাপালটা খেলে। আমি সাথে যাই রানীমা?
সারিয়ার কবির- কোমেন কাকু, আপনি বুড়া মানুষ। সামনেরটা পারলেও পেছনের খেলা সামাল দিতে পারবেন না। ম্যায় হু না, আপনার সাগরেদ। আমি বরং কাউয়ার লগে যাই, কি বলেন রানীমা?
টাকলা- খেলা পেছন দিয়ে হলে একশ খেলোয়াড় আমি একাই সামাল দিতে পারব।
শামীম ওচমান- শ’ শ’ রাকাত নামাজ পড়লে যা হয় আরকি। আমার হাঁটু কাঁপা ব্যারাম হয়েছে রানীমা। চেতনা বিরোধীদের সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে হলে, দশ তারিখের আগেই বিদেশ যাওয়াটা আমার জন্য অতি জরুরী।
কৃষি উজির রাদ্দাক- আমি চাষা ভুষা মানুষ, আমার গোবর সমৃদ্ধ মস্তিষ্ক বলছে বিদেশ বসে অনলাইনে খেলাটা জমে ভাল। দেখেন না কনক চাপা, এলিয়াস হুসেন, পিনকি ভট্টাচার্যরা বিদেশ থেকে কী খেলাই না খেলছে। খালি ছক্কার পর ছক্কা, গোলের পর গোল।
ডিপু মুনি- দেশে বসে খেললে প্রত্যেক খেলোয়াড়কে গিপিএ ফাইভ আর বিদেশ থেকে খেললে গিপিএ দশ দিয়ে সম্মানের সাথে পাশ করানো হবে।
আইটেম গার্ল- মন মতো খেলার জন্য জুতসই খাট, সরি মাঠ এজীবনে পেলাম না। দুঃখে বুকটা ফাইটা যায়। এখন দেখি বিদেশ গিয়ে যদি জুতসই- – –
লোটা কামাল- আমি দুনিয়ার এক নম্বর অর্থ উজির। খেলার জন্য টাকা কড়ি ভিক্ষা আনতে দশ তারিখের আগেই বিদেশ পাড়ি দেয়ার অনুমতি চাই রানীমা।
মাতাল কামাল- লাগেজে চেতনা আর দেশী বোতল, আগে ভাগেই ভরে রাখব। বিদেশী মালে আমার আবার অ্যালার্জি। তবে দুঃসংবাদ এই যে বাজারে লাগেজ আর উড়োজাহাজের টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না।
দুদুক- লাগেজ আর উড়োজাহাজের টিকেট নিয়ে কোন রকম দুর্নীতি বরদাস্ত করা হবে না- জিরো টলারেন্স। এ ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য অগ্রবর্তি একটা দল আগেভাগেই বিদেশে অবস্থান করছে রানীমা।
হাসাউ মামুদ- বুকের ভেতর সুগন্ধি রুমাল রেখে ডোরা ফাতেহি বলেছিল- আমি আসছি, খেলা হবে। কথা রাখেনি ডোরা ফাতেহি। আমি অভিমান করে বেগম পাড়া চলে যাবো। আমার বউয়ের বাচ্চা হবে দশ তারিখে।
আজব রানী- এ কী কথা উজির? তুমি দুই বছর ধরে দেশে আর তোমার বউয়ের বাচ্চা হবে। শুনেছি বেগম পাড়ার রাজ্যে চেতনা বিরোধীদের খুব উপদ্রব। এটা ওদের ষড়যন্ত্র নয় তো?
হাসাউ- না রানীমা। ডিজিটাল যুগে ভার্চুয়ালি সব কাজ হয়ে গেছে।
রাজ দরবারে হাসির রোল ওঠে। রানীও সেই হাসিতে যোগ দেয়। যদিও ভেতরে ভেতরে ভীষণ মর্মাহত, রাগান্বিত সে। তার আব্বাকে ঘিরেও এরকম চাটার দল ছিল। বিপদের সময় কারও টিকিটা খুঁজে পাওয়া যায়নি সেদিন। আব্বার লাশ ধোয়ার জন্য একটা সুগন্ধি সাবান পর্যন্ত – – – –
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলে হতেও পারত। কিন্তু ইবলীস মহারাজের দয়া, অমরত্ব বরের দিশা সে খুঁজে পেয়েছে। ইবলীস যার প্রাণের সখা তার কিসের ভাবনা? কালা মোরগের রক্ত দিয়ে স্নান করে ’বাণ’ কাটানোর গুরুত্বপূর্ন কাজটা সে আর তার ছেলে মেয়েরা সেরে ফেলেছে।
এবারে বিসর্জনের পর্বটা ভালয় ভালয় কাটলেই অমরত্ব নিশ্চিত। তারপর মুনাফেক গুলোকে সাইজ করবে সে, মনে মনে ফন্দি আঁটে আজব রানী। তোদের আমি করিব ফিনিস, জানিস না ব্যাটারা, আজব রানী কী জিনিস!
ভেতরের গোস্বা যথাসাধ্য সম্বরণ করে রানী তাই বলল, “আব্বার বিসর্জনের দিন আমি একটা খেলা দেখাবো। প্রিয় সভাসদ বর্গ আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। দশ তারিখের পর চেতনা বিরোধীদের আর সাধ্য হবে না তাফালিং করার। এই কে আছিস?“
তেঞ্জির, আজির, কারুন, পনিরুল একসাথে কুর্নিশ করে বলল, “হুকুম করুন স্যার।“
‘স্যার’ শব্দের সাথে মর্দামি ভাব মিশ্রিত থাকায়, পাইক পেয়াদারা রানীকে ‘স্যার’ সম্বোধন করে থাকে।
আজব রানী হুকুম করল, “তিন দিনের মধ্যে চেতনা বিরোধী পালের সব গোদাদের আটক করে জাহাজে চালান দেবার হুকুম করছি। যাও, যার যার বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো।“
পাইক পেয়াদারা হুকুম তামিল করতে রওয়ানা করল। পারিষদবর্গের দিকে তাকিয়ে রানী বলল, “ আমি আজব আব্বা কন্যা, এ রাজ্যের মালিক- সবাইকে হুঁশিয়ার করে বলতে চাই, দশ তারিখে সব ষড়যন্ত্রের অবসান হবে। সেই সাথে সেদিন আপনাদেরকে একটা সারপ্রাইজ দেবো। এমন সারপ্রাইজ, আপনাদের বাপের বয়সে পান নাই, মানি ব্যাক গ্যারান্টি। আমার ওপর পূর্ববত আস্থা রাখতে পারেন।“
মানি ব্যাক গ্যারান্টির কথা শুনে সভার হাল পানি পেলো, পালে হাওয়া লাগল। পরিস্থিতি হঠাৎ করে পালটে গেল। আশা, নিরাশা, বিশ্বাস, অবিশ্বাসের দোলাচল থেকে সরে এসে সভাসদ বর্গ যেন প্রাণ খুঁজে পেলো। রাজদরবারের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল, “জয় আজব রানী। জয় আজব আব্বা। খেলা হবে, খেলা হবে, দশ তারিখে খেলা হবে।“
অপরদিকে নগরীর আরেক প্রান্তে জড়ো হয়েছে কতিপয় তরুণ, যুবা, প্রৌড়। ওদের সবার চোখে মুখে প্রিয় মাতৃভূমিকে হায়েনা মূক্ত করার দৃপ্ত প্রত্যয়।
একজন তরুণ দাঁড়িয়ে বলল, “প্রিয় সহযোদ্ধাবৃন্দ, দেশ ও জাতির সামনে আজ এক ক্রান্তিকাল। দল, মত, বয়সের ব্যবধান এক পাশে সরিয়ে আজ আমরা এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হয়েছি। সেই কেন্দ্রবিন্দুর মূল লক্ষ্য জাতিকে হায়েনা মূক্ত তথা আজব রানীর দুঃশাসনের অবসান ঘটানো। আজব রানীর ইবলীস বাহিনী আমাদের ঘিরে ফেলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের জাহাজে অন্তরীন করা হবে এবং দশ তারিখে মহাসাগরে আমাদের সলীল সমাধি ঘটানো হবে। কিন্তু যে ভাবে প্ল্যান করেছি তাতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সহায় হলে বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত। তারপরও মৃত্যু যদি এসেই যায় তবে আমরা মরতে প্রস্তুত। এ মৃত্যু যেন হয় বীরের মৃত্যু, শহীদের মৃত্যু- ভীরু কাপুরুষের মৃত্যু নয়।
আমীন।
চলবে – – –