ইউনূস একজনই!

logo

ঢাকা, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

শাব্বীর আহমদ

mzamin

ইউনূস-যার গ্লোবাল লিডারশিপের গোড়াপত্তন হয়েছিলো ১৪ বছর বয়স থেকে। ১৪ বছর বয়সের ইউনূস দেশের প্রতিনিধিত্ব করা শুরু করেছিলেন বিশ্বব্যাপী। কানাডায় অংশ নিয়েছিলেন বিশ্ব স্কাউট জাম্বুরীতে; অতঃপর ঘুরে দেখেছিলেন সমগ্র ইউরোপ। এরপর বহু পথ তিনি পাড়ি দিয়েছেন, দেখেছেন পৃথিবীর রঙিন রূপ। নিজেকে তৈরি করেছিলেন সর্বোচ্চ সৃজনশীল একজন হিসেবে যার সামনে ছিলো স্বপ্নের চাইতে বড় একটা ভবিষ্যৎ। কিন্তু তার মনের সর্বস্বজুড়ে ছিলো ‘নিজ দেশ’!

দেশের প্রতি তার কর্তব্যের প্রতিফলন বিশেষভাবে দৃশ্যমান হয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। মার্চ ২৫, ১৯৭১ ঢাকায় ঘটে যাওয়া বর্বরতার খবর পেয়ে তিনি মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে বাংলাদেশি হিসেবে এবং পাকিস্তান বিরোধী হিসেবে বেছে নিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের আগ্রাসনের প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন আদায় করতে তিনি আমেরিকায় বসে গঠন করলেন ‘বাংলাদেশ সিটিজেনস কমিটি’। কমিটির সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাঁদা সংগ্রহ শুরু করলেন। স্থানীয় টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা, বিশ্ববিদ্যালয়, ডিপ্লোম্যাট-সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, সাক্ষাৎকার দিলেন। নিজ পরিসরে একটা ক্যাম্পেইন গড়ে তুললেন।

ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল হিলে বাঙ্গালিদের অবস্থান কর্মসূচীতে যুক্ত হলেন অবিচ্ছেদ্য কর্মী হিসেবে। নিজের হাতে তৈরি করলেন ব্যানার-ফেস্টুন। আমেরিকায় অবস্থিত দূতাবাসগুলোতে ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায় করতে থাকলেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মুহূর্তে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন- দেশে ফেরত যাবেন, কারণ দেশের প্রতি তার কর্তব্য রয়েছে। যুদ্ধকালীন সময়ে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নিতে আগরতলা শিবিরে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও সেখানকার বাংলাদেশি নেতাদের নির্দেশনা মোতাবেক সেখানে না গিয়ে আমেরিকা থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকলেন।

আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের লোভনীয় প্রফেসরশীপ ছেড়ে ফিরে আসলেন সদ্য যুদ্ধপীড়িত নিজের বাংলাদেশে। নেমে পড়লেন আরেকটি যুদ্ধে। সমাজের উঁচুশ্রেণি যেসব মানুষদের ‘মানুষ’ হিসেবে গণ্য করতো না, সেসব মানুষের কাছে গেলেন। কাদামাটির উঠোনে বসে তাদের কথা শুনলেন, তাদের মানুষের মতো বেঁচে থাকার অধিকার দিতে চেষ্টা করলেন। সমগ্র প্রথাগত ব্যবস্থার বিপরীতে গড়ে তুললেন একটা অর্থনৈতিক সংগ্রাম। মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তি দেওয়ার সংগ্রাম।

একটা সময় ছিলো গ্রামের জরিমন, আসিয়া বেগমরা একবেলা খাবারের বিনিময়ে গৃহস্থের বাড়িতে সারাদিন হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খাটতো। ঝোঁপঝাড়ে বেড়ে উঠা লতা-পাতাই ছিলো তাদের পরিবারের দৈনন্দিন খাদ্যের একমাত্র যোগান। সেসব জরিমন, আসিয়াদের এখন আর মানুষের বাড়িতে কাজ করার জন্য খুঁজে পাওয়া যায় না। যে মমতাজ বেগমদের নিজেদের মুরগির ডিম বিক্রি করা টাকা গুনতে অন্য কারো সাহায্য লাগতো, তাদের সন্তানরা এখন বড় বড় প্রতিষ্ঠানের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার।

দেশের বর্তমান সামগ্রিক ব্যবস্থায় উন্নয়নের যে চিত্র তা ইউনূসদের মতো হাতেগোনা প্লেয়ারদের অবদান। এসব করতে সাহস লাগে, লাগে প্রকৃত দেশপ্রেম।

তার এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো সংগ্রাম বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও গ্রহণ করলো। দেশে-বিদেশে তাকে অতিথি করার জন্য কাড়াকাড়ি লেগে থাকার বিষয় নিত্যনৈমিত্তিক। কারণ তার কাছে আছে বিশ্বের ঘুনেধরা ব্যবস্থাকে বদলে দেওয়ার জ্ঞান। শুধু মুখের বুলি নয়, তার কাছে আছে বাস্তব অভিজ্ঞতা। তার কথা শোনার জন্য বহু দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা পর্যন্ত বছরজুড়ে অপেক্ষা করেন। বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত চিন্তাবিদরা তার কাছে উপদেশ চান কিভাবে তাদের দেশের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করবেন।

তাকে নিয়ে অগণিত বই লেখা হয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। বহু অনুকরণীয় উন্নত দেশের পাঠ্যবইয়ে পড়ানো হয় ইউনূসকে নিয়ে। বাচ্চারা নিজেদের জ্ঞানের ভিত্তি স্থাপনের সময় বিভিন্ন মৌলিক জ্ঞানের পাশাপাশি ‘ইউনূস’কেও শিখে।

পূর্ব থেকে পশ্চিম কিংবা উত্তর থেকে দক্ষিণ-পৃথিবীর এমন কোনো বন্দর পাওয়া যাবে না যেখানে অন্তত একজন ইউনূসকে চিনে না। এমনও দেখা যায় কেউ কেউ বাংলাদেশ দেশটি সম্পর্কে জানেন না কিন্তু প্রফেসর ইউনূসকে ঠিকই চেনেন। এয়ারপোর্ট, রেস্তোরা, হাসপাতাল, বিজনেস সেন্টার সবখানেই অগণিত লোক পাওয়া যায় যারা অবাক বিস্ময়ে, আবেগঘন চোখে তার কথা শোনার জন্য, ছবি-অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে দ্বিধাবোধ করেন না। তিনি বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করে গেছেন এবং অদ্যাবধি করে যাচ্ছেন মাথা উঁচু করে।

ব্যক্তি ইউনূস নিজের জন্য কিছু গড়েন নি। তিনি বরং নিজের বাংলাদেশটাকেই গড়তে চেয়েছেন।