

ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক সামরিক অভিযানে দেশটিতে মহাবিপর্যয় নেমে এসেছে। এ যুদ্ধে হাজারো মানুষ মরেছে, লাখো মানুষ ভিটেছাড়া হয়েছে ও অসংখ্য ঘরবাড়ি, অফিস–আদালত ধ্বংস হয়েছে। এ যুদ্ধে রাশিয়ার নৈতিক ও কৌশলগত দীনতা ফাঁস হয়ে গেছে।
বাকি বিশ্বেও বিপর্যয় নেমে এসেছে। এই যুদ্ধ যে শুধু জ্বালানি বাজারকে অস্থির করেছে, মূল্যস্ফীতির আগুনে বাতাস দিয়েছে বা খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যব্যবহার্য পণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খলকে বাধাগ্রস্ত করেছে তা-ই নয়, এই যুদ্ধের কারণে গরিব দেশগুলো আরও বেশি বিপদে পড়েছে, পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার প্রতিযোগিতাকে তীব্র করেছে, সামরিক প্রতিযোগিতাকে বাড়িয়েছে, আইনের শাসনকে খাটো করেছে, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আইনের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং বহুপক্ষীয় সহযোগিতা ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রমকে চরমভাবে কোণঠাসা করেছে। সব মিলিয়ে এটি একটি বিচারবুদ্ধিশূন্য যুদ্ধে পর্যবসিত হয়েছে।
২০১৪ সালে মস্কোর ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেওয়া ও দনবাস এলাকায় সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার সূত্র ধরে ইউক্রেনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ বাড়তে থাকে। তারপর এতগুলো বছরেও ইউরোপ কূটনৈতিকভাবে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সংকটের সমাধান করতে পারেনি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সীমানাসংলগ্ন এলাকায় ন্যাটোর বিস্তৃতি ঘটানোর চেষ্টা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করেছে। এর ধারাবাহিকতায় আজকের এ যুদ্ধদশা।
রাশিয়া ইউক্রেনে বোমা ফেলে পুরো বিশ্বকে অধিকতর অনিরাপত্তার হুমকির অনুভূতি দিয়েছে। এর আগে যতগুলো চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ হয়েছে, তার কোনোটিই এ যুদ্ধের মতো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার এত বেশি ব্যর্থতা উন্মোচন করেনি। এ যুদ্ধের পর আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রমাণিত হয়েছে যে ভূরাজনৈতিক সংঘাতের সময় আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক চুক্তির শর্ত আদতে কোনো কাজে আসে না।
পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পরমাণু অস্ত্রের মজুত গড়া পাকিস্তান, ভারত, উত্তর কোরিয়া ও ইসরায়েলের পদাঙ্ক এখন ইরান, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো আরও বেশ কয়েকটি দেশ অনুসরণ করা শুরু করেছে। রাশিয়া পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের হুমকি দেওয়ার পর পারমাণবিক চুক্তি ও আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ওপর থাকা সবার আস্থায় চিড় ধরেছে।
ইরাকের হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার মিথ্যা অজুহাতে সে দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালানোর পর বিশ্বব্যবস্থার ভিত নড়ে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে অভিযান চালাতে পারলে রাশিয়া কেন ইউক্রেনে পারবে না—এমন একটা যুক্তি রাশিয়া দাঁড় করাতে চেয়েছে এবং তাতে তারা অনেকাংশে সফলও হয়েছে। একইভাবে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারিকে অনুমোদন করার পর ইউক্রেনের ভূমি রাশিয়ার দখল করাকে নিন্দা জানানোও সর্বাংশে গ্রহণযোগ্যতা পায় না।
পশ্চিমা দেশগুলোও নিজেদের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ইউরোপের ছোট-বড় সব দেশ নিজ নিজ সামরিক ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বাড়াচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর যে জার্মানি অস্ত্র প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থাকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই জার্মানিও গত বছর ঘোষণা দিয়েছে, তারা ১১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের একটি সামরিক তহবিল গঠন করছে।
রাশিয়া ২০২৩ সালে ৮ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বাজেটের পরিকল্পনা করেছে, যা ২০২১ সালের তুলনায় ৪০ গুণ বেশি। আর রাশিয়ার এই বর্ধিত বাজেট হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২০২৩ সালের সম্ভাব্য সামরিক ব্যয়ের মাত্র ১০ শতাংশ। অন্যদিকে চীনও অস্ত্র প্রতিযোগিতায় প্রথম সারিতে রয়েছে। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখলের পর বিশ্বের সামরিক ব্যয় ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০২১ সালে তা ২.১ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এখন আর এটি মোটেও আশ্চর্য হওয়ার মতো কোনো খবর নয় যে সারা বিশ্বে যত সামরিক ব্যয় হয়ে থাকে, তার ৬২ শতাংশই ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই সামরিক ব্যয় মেটাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের মানবিক সেবা, সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দঘাটতি দেখা দেয়।
ইরাকের হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার মিথ্যা অজুহাতে সে দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালানোর পর বিশ্বব্যবস্থার ভিত নড়ে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে অভিযান চালাতে পারলে রাশিয়া কেন ইউক্রেনে পারবে না—এমন একটা যুক্তি রাশিয়া দাঁড় করাতে চেয়েছে এবং তাতে তারা অনেকাংশে সফলও হয়েছে। একইভাবে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারিকে অনুমোদন করার পর ইউক্রেনের ভূমি রাশিয়ার দখল করাকে নিন্দা জানানোও সর্বাংশে গ্রহণযোগ্যতা পায় না।
ফলে এ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও অস্ত্র প্রতিযোগিতা থামবে না।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
- মারওয়ান বিশারা আল-জাজিরার সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক








