ইউক্রেন বোঝো, ফিলিস্তিন বোঝো না

হায়দার ইদ : আবারও গাজা! কিন্তু এবারের বিষয়টা ভিন্ন। এতদিন বর্ণবাদী ইসরায়েলের নিয়মিত গণহত্যামূলক আক্রমণগুলোর জবাব দিত ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন; এবার তারা নজিরবিহীনভাবে ‘আগাম’ পদক্ষেপ নিয়েছে।

ইসরায়েলের ‘উদারতার’ জন্য অপেক্ষা করার বদলে– যেখানে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে ইসরায়েল পৃথিবীর বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগারের সাতটি ফটকের একটি খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়– বন্দিরা এবার ১৯৪৪ সালের ওয়ারশ বিদ্রোহ থেকে শিক্ষা নিয়ে, সেই ফটকগুলো নিজেরাই ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে ওই বছর পোল্যান্ডের গোপন প্রতিরোধ যোদ্ধারা জার্মানির দখলদারিত্ব অবসানে বিদ্রোহ করেছিল।

২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েল ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন সমর্থন নিয়ে গাজার ওপর ভয়াবহ মধ্যযুগীয় অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই চলে একের পর এক গণহত্যামূলক যুদ্ধ। এ অবরোধের উদ্দেশ্য গাজার ফিলিস্তিনিদের ধীরে এবং বেদনাদায়কভাবে সেখান থেকে উৎখাত করা।

তবে ফিলিস্তিনিরা বুঝেছে, যথেষ্ট হয়েছে, আর তা চলতে দেওয়া যায় না!

গাজার ডান ও বামে প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো হাওয়া ঘুরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা ফিলিস্তিনি সংগ্রামকে একটি নতুন প্রেরণা দিয়েছে; মুক্তি ও বি-উপনিবেশায়নের জন্য একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে। বর্ণবিদ্বেষী ইসরায়েল এটা পুরোপুরি স্পষ্ট করে দিয়েছে– যেহেতু ওরা আমাদের নির্মূল করতে পারছে না, তাই তারা আমাদের দাস বানিয়ে রাখবে, অধিকারহীন মানুষ বানিয়ে রাখবে।

ইসরায়েলি ইহুদিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাদের সরকারের গণহত্যা নীতিকে সমর্থন করে। কারণ বর্ণবাদী ইসরায়েলে বসবাসকারী জায়নবাদী হিসেবে তারা এ চিন্তা করতে অভ্যস্ত যে তারা কিছু বিশেষ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী এবং তা অবশ্যই ভূমির আদি বাসিন্দাদের প্রাপ্য নয়।

এ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে ফিলিস্তিনিরা বুঝেছে, সেটলার ঔপনিবেশিকতাই হলো তাদের শত্রু। কিন্তু এ উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তির পথ নিয়ে তারা একমত হতে ব্যর্থ হয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ বিষয়ে কৌশলগত চিন্তাধারায় একটি আমূল পরিবর্তন এসেছে। তারা সেটলার ঔপনিবেশিকতা ও বর্ণবাদের কাঠামোতে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সম্পর্ককে দেখছে। এ প্রেক্ষাপটে সত্যিকারের মুক্তির অর্থ হলো, যেখান থেকে তাদের একদিন বিতাড়িত করা হয়েছিল সেখানে প্রত্যাবর্তন। ১৯৪৮ সালে বাস্তুচ্যুত সব ফিলিস্তিনির ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের নিজ নিজ শহর ও গ্রামে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে সত্যিকার সমতা অর্জন করাই তাদের লক্ষ্য। ফলে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, গাজা এই নজিরবিহীন পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গাজার দুই-তৃতীয়াংশ লোক কিন্তু এ ধরনের শরণার্থী– ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ১৯৪ নম্বর প্রস্তাব মতে তারা নিজ ভিটায় ফেরার অধিকার রাখে।

গুঞ্জন আছে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মধ্যে যারা স্টেরত শহরে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন তারা হুজ গ্রামের উদ্বাস্তুদের নাতি। এই এলাকায় ১৯৪৮ সালে ইহুদিবাদী মিলিশিয়ারা জাতিগত নির্মূল অভিযান চালিয়েছিল। পরে তারা এর নতুন নাম দেয় স্টেরত। অন্যরা হিরবিয়া গ্রামের, ইসরায়েলিরা যার নাম দিয়েছে জিকিম।

তারা ‘অচিন্ত্যনীয়’ এক কাজ করেছে, অর্থাৎ পিতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেছে। এবং সেটা উপনিবেশকারীর অনুমতিপ্রাপ্ত দর্শনার্থী হিসেবে নয়, বরং মুক্তিদাতা হিসেবে। প্রত্যাবর্তনের এই বৈপ্লবিক কাজটি জায়নবাদ-উত্তর পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের ধারণা দেয়। আমাদের ভাবা উচিত এ পথই সবার মুক্তি আনবে। আমাদের জন্য মুক্তি মানে জায়নবাদী ঔপনিবেশিকতা ও বর্ণবাদের কাঠামো ভেঙে ফেলা এবং গত ১০০ বছরে ফিলিস্তিনের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর যে বৈষম্য ও অবিচার করা হয়েছে তা মোকাবিলা করা।

আমাদের জন্য মুক্তির লক্ষ্য ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের মধ্যকার সম্পর্ককে সম্পূর্ণ সমতা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে ঢেলে সাজানো। আশা করা যায়, সেটলার সোসাইটি সব ঔপনিবেশিক সুযোগ-সুবিধা পরিত্যাগ করবে এবং অতীতের অপরাধ ও অবিচারের জন্য দায় স্বীকার করবে। আদিবাসী ফিলিস্তিনিরা যে সমঝোতার প্রস্তাব দেবে তা হলো, জর্ডান নদী ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী নতুন রাষ্ট্রে বসতি স্থাপনকারীদের সমান নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করা।

এটাই শান্তি ও নিরাপত্তার পথ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, যারা দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধকে অস্বীকার করেছে এবং এমনকি যারা তাদের প্রশ্রয় দিয়েছে, তাদের এটি মানতে হবে।

ইতিহাস থেকে কিছুই না শিখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যেদিন ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা কাঁটাতারের মধ্য দিয়ে ইসরায়েলে ঢুকেছিল সেদিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি পুরোপুরি ইসরায়েলের পেছনে রয়েছেন; তাঁর সেনাবাহিনীকে গাজার বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে আরও যুদ্ধাপরাধ করার অনুমতি দিয়েছেন।

১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের ভেতরে প্রতিরোধ শুরুর তিন দিন পর ইসরায়েল গাজায় ১৪০ শিশুসহ ৭৭০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা এবং চার হাজার মানুষকে আহত করে। ১ লাখ ৮০ হাজারেরও বেশি লোককে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে হয়, কারণ তাদের প্রতিবেশী এলাকাগুলো ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের নিষ্ঠুর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল। আমি তাদের একজন।

বাইডেনের মতো নেতাদের ব্রাজিলীয় শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক পাওলো ফ্রেইরির এ কথাগুলো মনে রাখা ভালো হবে: ‘নিপীড়নের সম্পর্ক তৈরির সঙ্গে সঙ্গে সহিংসতা শুরু হয়। ইতিহাসে কখনও নির্যাতিতদের দ্বারা সহিংসতার সূচনা হয়নি। তারা কীভাবে সূচনাকারী হতে পারে, যদি তারা নিজেরাই সহিংসতার ফল হয়? … তাদের পরাধীন করার জন্য সহিংসতা না থাকলে নির্যাতিত বলে কেউ থাকত না। যারা নিপীড়ন করে, যারা শোষণ করে, যারা অন্যকে মানুষ হিসেবে চিনতে ব্যর্থ হয় তাদের দ্বারা সহিংসতা শুরু হয়– যারা নিপীড়িত, শোষিত এবং অচেনা তাদের দ্বারা নয়।’

গাজা এবং জেনিনে– আমরা ভেড়ার মতো ইসরায়েলের মৃত্যুকূপে যেতে অস্বীকার করি। গাজা এবং জেনিনে– প্রকৃতপক্ষে সমস্ত ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনে– আমরা এটি একেবারে পরিষ্কার করে দিয়েছি যে, জর্ডান নদী ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যে জবরদখল করে বসতি স্থাপনকারী, ঔপনিবেশিক, বর্ণবাদী শাসনকে প্রতিহত করব।

আমরা আশা করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে ঠিক একইভাবে সমর্থন করবে, যেভাবে তারা রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতিরোধকে সমর্থন করছে। আমরা তাদের যে দ্বিচারিতা দেখেছি তাতে নিশ্চিত ফিলিস্তিনি হিসেবে আমাদেরই দায়িত্ব নিজেদের মুক্তির জন্য রাজনৈতিক পরিসর তৈরি করা; অন্য কেউ তা করে দেবে না।

আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং প্রত্যাবর্তনের অধিকারসহ আমাদের মৌলিক অধিকারগুলোর প্রশ্নে আমরা কোনো আপস করতে পারি না। আমাদের মুক্তির লক্ষ্যে একটি পরিষ্কার পথ রয়েছে, যার অবস্থান স্বাধীনতা নিয়ে বুলিবাগীশ এবং ছদ্মবেশী বর্ণবাদী সমাধান থেকে অনেক দূরে।

হায়দার ইদ: গাজার আল আকসা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক। আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর করেছেন সাইফুর রহমান তপন