আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা

Daily Nayadiganta (নয়া দিগন্ত) : Most Popular Bangla Newspaper


আমাদের রাষ্ট্রে নির্বাচন নামক একটি খেলা প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এখনো হয় বটে, কিন্তু ‘নির্বাচন’ বলতে যা বোঝায় সত্যিকার অর্থে তা হয় কি? নির্বাচনের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পছন্দ করা, অর্থাৎ নিজ কাক্সিক্ষত প্রার্থীকে ভোট দেয়ার মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করার দায়িত্ব অর্পণ করা। প্রার্থী ও ভোটারের মধ্যে একটি গভীর যোগসূত্র না থাকলে পছন্দের মাপকাঠি সৃষ্টি হতে পারে কিভাবে? সে যোগসূত্রের ধারাবাহিকতা কিভাবে রক্ষা হতে পারে?
প্রবাদ রয়েছে যে, আমাদের দেশের রাজনীতি জোয়ারে ভাসে। ‘জোয়ার’ যেদিকে যায় অর্থাৎ যে দল বা প্রার্থী ‘শক্তি’ প্রদর্শন করতে পারে গণমানুষ সেদিকেই তাড়িত হয়। বাস্তবতা হলো এইÑ ম্যাক্সিমাম ভোটার চিন্তা করে যাতে তার ভোটটা ‘নষ্ট’ বা ‘ব্যর্থ’ না হয়। আর একটি ব্যাপার হচ্ছে, ভোটার তার নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে কারণেই যার শক্তি বেশি তার দিকেই ভোটাররা বেশি ঝুঁকে পড়েন। ফলে ‘পছন্দ’ বা ‘ইচ্ছা’ যা-ই হোক না কেন, শক্তির কাছেই এ দেশের ভোটারা মাথা নত করতে বেশি আগ্রহী।

‘শক্তির’ উৎস কী সেটাই এখন পর্যালোচনার বিষয়। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে পারলেই সেখানে ‘শক্তি’ সৃষ্টি হয়। ফলে জনগণ যেমন যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলÑ রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে ১৯৫২ সালে একবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, যেমনি হয়েছিল ১৯৭০-৭১ স্বাধিকার বা স্বাধীনতার আন্দোলনে বা ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সিপাহি জনতার ঐক্য, আবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন দাবিতে। এখন দেখা যায়, সব দলের কর্মসূচিতেই জনসমাবেশের কমতি নেই। কথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মভিত্তিক দলগুলোও অনেক বড় বড় জনসমাবেশ ঘটাতে পারে, কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না বা ঐক্যবদ্ধ করার কোনো উদ্যোগ এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনজীবন অতিষ্ঠ করে ফেলেছে। মানুষ গোপনে হলেও এ দ্রব্যমূল্যের ঊর্র্ধ্বগতি ও রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তায়নের ওপর যারপরনাই নাখোশ। ২৮ মার্চ বামপন্থী ঐক্যজোট দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছিল, পত্রিকার ভাষ্য মতে, হরতাল সফল না হলেও বামপন্থী দলগুলো মাঠে ছিল, ঝুঁকি নিয়ে মিছিল করেছে, পুলিশকে মোকাবেলা করেছে হরতাল সফল করার জন্য। কিন্তু হরতালের সফলতা বলতে যা বোঝায় সে ধরনের হরতাল পালিত হয়নি। জনস্বার্থে আহূত হরতালে জনগণের স্বতঃস্ফ‚র্ত সাড়া পাওয়া যায়নি। অন্য দিকে বৃহৎ বিরোধী দল বিএনপি হরতালে সমর্থন দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও বাম দল তা প্রত্যাখ্যান করে।

বিএনপির একটি বিশাল কর্মীবাহিনী আছে জেনেও বাম দল আহূত হরতালে বিএনপির সমর্থন গ্রহণ না করার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? হতে পারে তারা মনে করে যেÑ ১. বিএনপির সাথে বামদের আদর্শিক কোনো মিল নেই অথবা ২. বিএনপির সমর্থন নিলে হরতালের ক্রেডিট বিএনপির পক্ষে চলে যেতে পারে। ফলে দৃশ্যত ভবিষ্যৎ ঐক্যের অর্থাৎ ২০২৩ সালের নির্বাচনে বাম-ডানদের ঐক্যের প্রাথমিক লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অন্য দিকে ডানপন্থী দলের মধ্যে ধর্মভিত্তিক প্রতিটি দলই আলাদা আলাদা কর্মসূচি পালনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আলাদা প্রার্থী দাঁড় করিয়ে জেনেশোনে সরকারি দলের প্রার্থীর জয়লাভের পথ সুগম করে দিচ্ছে। বিষয়টি পরিষ্কার যে, ডানদের মধ্যেও জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগ এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ২০১৮ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের সাথে ড. কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের ঐক্যের ফলাফল ছিল শূন্য। তখন যে প্রশ্ন উপস্থাপিত হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছু দিন আগে ভোট চাওয়ার প্রারম্ভে সে একই প্রশ্ন উপস্থাপন করে বলেন, ‘বিরোধী দল নির্বাচিত হলে কে হবে দেশের প্রধানমন্ত্রী?’ অন্য দিকে ড. কামাল হোসেনের দলও এখন বিভিন্ন উপদলে বিভিক্ত হয়ে নেতৃত্বের প্রশ্নে তিনিও শূন্যের কোঠায় চলে গেছেন। ফলে সর্বজনীন ঐক্যের প্রশ্নে বিরোধী দল কতটুকু হাঁটতে পারবে এটাই এখন দেখার বিষয়।

জনগণের ‘ঐক্যবদ্ধতা’ যেমন সরকার হঠানোর জন্য একটি অন্যতম প্রধান শক্তি হতে পারে, তেমনি পাক-ভারত উপমহাদেশের রাজনীতিতে একমাত্র ভারত ছাড়া অন্যান্য রাষ্ট্রে সরকার পরিবর্তনে সেনাবাহিনী অনেক ক্ষেত্রে মুখ্য ভ‚মিকা পালন করেছে। পাকিস্তান ও মিয়ানমার কোনো সময়ই সেনা প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি। বাংলাদেশে বিগত ৫০ বছরে তিনবার সরকার পরিবর্তনে সামরিক হস্তক্ষেপ কার্যকর হয়েছে (খন্দকার মোশতাক, জেনারেল এরশাদ, জেনারেল মঈনইউ আহম্মদ)। জেনারেল এরশাদ সামরিক আইন জারির পর রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিলে বিভিন্ন দলের নেতারা একযোগে তার দলে যোগদান করে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় স্থান করে নেন। এরশাদের যখন পতন আসে গণবিদ্রোহের কারণে তখন আটরশির পীর সাহেবসহ অনেকেই তাকে ছেড়ে চলে যান এবং সুযোগমতো বিভিন্ন দলে আত্মনিয়োগ করেন।

কথিত আছে, তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নূরউদ্দিন যদি প্রেসিডেন্ট এরশাদকে সাপোর্ট করতে সম্মত হতেন তবে এরশাদের পতন হতো না। যা হোক পুরস্কারস্বরূপ জেনারেল নূরউদ্দিন আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ফলে প্রতীয়মান হয়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সেনাবাহিনী অন্যতম আর একটি প্রধান শক্তি যদি তারা প্রয়োগ করে। জেনারেল মঈন ইউ আহম্মদ ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার সুযোগ করতে না পারায় রণে ভঙ্গ দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে সমঝোতা করে তার শেষ রক্ষা হয়। তবে ড. ইউনূস বা ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর মাধ্যমে কিংস পার্টি গঠন করার চেষ্টা করলেও পরবর্তীতে পরিস্থিতি অনুক‚লে না থাকায় সরকার সমর্থিত রাজনৈতিক দল গঠন করা যায়নি। ফলে তাদের উচ্চ আকাক্সক্ষা এমনিতেই আগুনে পোড়া অবশিষ্ট ধোঁয়ার মতো বাতাসে মিশে গিয়েছিল।

বাংলাদেশের ইলেকশন কারসাজিতে আমলা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ বাহিনী অনৈতিকভাবে একটি উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা পালন করে আসছে। নির্বাচনে তাদের ব্যাপক ভ‚মিকা থাকে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমলাদের কারসাজিতেই বিরোধী দল মাঠে নামতে পারেনি। দিনের ভোট রাতে হওয়ার অভিযোগ ছাড়াও গায়েবি মামলা, মামলায় অভিযুক্তদের রিমান্ড এবং জজকোর্ট পর্যন্ত জামিন পেতে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় শেখ হাসিনা সরকার সহজেই বৈতরণী পার হতে পেরেছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে আমলা, পুলিশ ও নি¤œআদালত যদি সরকারের প্রতি গোপন সমর্থনে অনুরূপ ভ‚মিকা রাখে তবে শক্তি প্রদর্শনে বাকি দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই, যার লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না।

অনেকের ধারণা, পৃথিবীর বৃহৎ শক্তি বা জাতিসঙ্ঘ বাংলাদেশের নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো ভ‚মিকা রাখতে পারে। তবে স্মরণ রাখা দরকার, পৃথিবীতে সংগঠিত কোনো অমানবিক গণহত্যার বিষয়েও জাতিসঙ্ঘ বা বৈদেশিক শক্তি কার্যকর কোনো ভ‚মিকা রাখেনি। সামরিক জান্তা মিয়ানমার রোহিঙ্গা গণহত্যা বা তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার অমানবিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘ বা বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রগুলো ত্রাণ দিলেও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কার্যকর ভ‚মিকা রাখেনি। পৃথিবীতে কোনো রাষ্ট্রই কোনো রাষ্ট্রের বন্ধু নয়। দু’টি দেশের মধ্যে সম্পর্ক কোথাও সঙ্ঘাত অথবা কোথাও পারস্পরিক লেনদেনের ভিত্তিতে ।

বৈশ্বিক বাস্তবতা হলো এক রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের সাথে স্বার্থ ছাড়া সম্পর্ক রাখে না। ফলে কোনো রাষ্ট্রে নির্বাচন সুষ্ঠু হলো, কি হলো না; এই মর্মে অন্য কোনো রাষ্ট্রের কোনো মাথাব্যথা নেই। বর্তমান বৈশ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্ব এখন অর্থনৈতিক যুদ্ধে লিপ্ত। অর্থনৈতিক স্বার্থে ব্যাঘাত না ঘটলে কোনো রাষ্ট্র কারো বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ভ‚মিকা নেবে না। ফলে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কতটুকু নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে, নাকি আগের ধারাই অব্যাহত থাকবে তা এখনো নিশ্চিত নয়।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: [email protected]