আল্লামা সাঈদীকে যেমন দেখেছি

  • ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক
  •  ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:৫৪
আল্লামা সাঈদী – ফাইল ছবি

১৯৭৯ সালে আমি যখন লন্ডনে ব্যারিস্টারি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র, আল্লামা সাঈদী আসেন এক ওয়াজ মাহফিলে। ওই মাহফিলেই তার সাথে প্রথম দেখা। মাহফিলের উদ্যোক্তা ছিল দাওয়াতুল ইসলাম ইউকে অ্যান্ড আয়ার। তখন আল্লামা সাঈদীকে আমার বাসায় দাওয়াত করেছিলাম। তিনি দাওয়াত গ্রহণ করেছিলেন।
মাহফিলে প্রথমবারের মতো দেখলাম, কিভাবে তিনি মানুষকে মুহূর্তের মধ্যেই হাসাচ্ছেন ও কাঁদাচ্ছেন। তার সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষায় তাফসিরের বয়ান দলমত নির্বিশেষে সবাইকে আকর্ষণ করেছিল। এরপর যতবার এসেছেন আল্লামা সাঈদীর তাফসির মিস করিনি। প্রতিবারই তার সাথে সাক্ষাৎ ও কথা বলার সুযোগ হয়। আমি আধুনিক শিক্ষিত এবং তিনি আলেমে দ্বীন। কিন্তু তারপরও আমাদের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক ছিল। আমাদের সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে।

স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আমি দেশে ফিরে যাই ১৯৮৫ সালে। এরপর থেকে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়। আরো কাছাকাছি আসি ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা সুধাংশু শেখর হালদারকে পরাজিত করে তিনি নির্বাচিত হন। ভোটের ব্যবধান খুব বেশি ছিল না। সুধাংশু শেখর হালদার সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ছিলেন। তিনি ভোটের ফলাফল নিয়ে মামলা করেন। আল্লামা সাঈদীর পক্ষে হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগে ওই মামলা লড়েছিলাম। তখন তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা আরো বাড়ে।
সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে। ২০১০ সালের ২৯ জুন আল্লামা সাঈদীকে গ্রেফতার করা হয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন জনৈক ব্যক্তি। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের আইন তৈরি হয় ব্রিটিশ আমলে, ১৮৯০ সালে। ওই আইনে দায়ের করা মামলায় জামায়াতের তৎকালীন আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকেও গ্রেফতার করা হয়।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে গ্রেফতার করে জামিন দেয়া হয়নি। আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ২০টি অভিযোগ এনে ২ অক্টোবর ২০১১ সালে চার্জ গঠন করা হয়। অর্থাৎ ভিন্ন একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার করে আটক রেখে ১৬ মাস পর চার্জ গঠন করা হয় ট্রাইব্যুনালে। তখন আমি নিউইয়র্কে। ঢাকায় এসে শুনলাম, চার্জ গঠনের দিন ট্রাইব্যুনালে তিনি সূরা ইবরাহিমের ৪৬ নম্বর আয়াত তিলাওয়াত করে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোকে মিথ্যা উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনালের সামনে বক্তব্য রাখেন। সূরা ইবরাহিমের ৪৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারা তাদের সব রকমের চক্রান্ত করে দেখেছে। কিন্তু তাদের প্রত্যেকটি চক্রান্তের জবাব আল্লাহর কাছে ছিল। যদিও তাদের চক্রান্তগুলো এমন পর্যায়ের ছিল, যাতে পাহাড় টলে যেত।’ আশ্চর্যের বিষয়, আমিও তখন সূরা ইবরাহিমের এই ৪৬ নম্বর আয়াত অধ্যয়ন করছিলাম। এর আগে সূরা ইবরাহিম অনেকবার অধ্যয়ন করেছি। কিন্তু ইতঃপূর্বে ওই আয়াতের এ মর্মার্থ বুঝতে পরিনি।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা খুবই জরুরি। নুরেমবার্গ, জাপানের টোকিও, প্রাক্তন যুগোসাভিয়া, রুয়ান্ডা, সিয়েরা লিওন, লেবানন, কম্বোডিয়াসহ আরো অনেক দেশে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের ট্রায়াল হয়েছে। কিন্তু এসব দেশে বা দুনিয়ার ইতিহাসে কোথায়ও এমন নজির নেই যে, ভিন্ন একটি মামলায় আটকের ১৬ মাস পর অভিযোগ আনা হয়। সব জায়গায় আগে অভিযোগ দাখিল করা হয়। অভিযোগের ভিত্তিতে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট ইস্যু করে ট্রাইব্যুনাল। আল্লামা সাঈদীসহ অন্যদের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা নজিরবিহীন।

আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যিনি আজীবন ওয়াজ মাহফিলে তাফসিরের মাধ্যমে ধর্ম প্রচার করেছেন তাকে গ্রেফতার করা হয় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে।
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১১ সালে আমি হেগে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে যাই। আমার সাথে ছিলেন বিলাতের আইনজীবী টবি ক্যাডমেন। ওই দিন ঢাকায় জামায়াতে ইসলামীর বড় একটি মিছিল হয়েছিল। মিছিলের পর সরকার নাশকতার অভিযোগে মামলা দায়ের করে জামায়াত নেতাকর্মীদের নামে। ওই মামলায় আমাকেও অভিযুক্ত করা হয়। বলা হয়, আমি উপস্থিত ছিলাম এবং নাশকতায় জড়িত ছিলাম। সরকারের মামলার ভাষ্য অনুযায়ী, হেগে অবস্থান করেও যেন ঢাকায় নাশকতায় অংশ নেয়া যায়।

হেগ থেকে লন্ডনে আসি। এখান থেকে আমেরিকায় যাওয়ার কথা। আমার বন্ধুবান্ধব সবাই একবাক্যে বললেন, আর দেশে যাওয়া সমীচীন হবে না। গেলেই আমি গ্রেফতার হবো। ওই সময়ে আমার আমেরিকা যাওয়ার কথা। ওখানে স্টেট ডিপার্টমেন্ট, কংগ্রেস ও সিভিল সোসাইটির বিভিন্ন সংস্থার সাথে আমার ইতঃপূর্বেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল। সুতরাং পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী আমেরিকায় চলে গেলাম।
ওই সময়ে জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধ মামলায় আমাদেরকে আইনি সহযোগিতা দেয়ার জন্য বিলাতের তিনজন যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী আইনে বিশেষজ্ঞ একটি টিম আমরা নিযুক্ত করেছিলাম। তারা হলেন, স্টিভেন কে কিউসি (বর্তমানে কেসি), জন কেমেগ ও টবি ক্যাডমেন। তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিলেন, আমার দেশে যাওয়া ঠিক হবে না। ইতোমধ্যে আমি আমেরিকায় চলে গিয়েছি। আমি নিউইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে ট্রেনে পৌঁছলাম। তারা আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন। ওয়াশিংটন ডিসির ট্রেন স্টেশনে পৌঁছার পরই টবি ক্যাডমেন টেলিফোনে আমাকে জানালেন, ‘আমাদের স্পষ্ট অ্যাডভাইস হচ্ছে, আপনি বাংলাদেশে যাবেন না।’

এ দিকে ঢাকা থেকে খবর আসছিল, ১৯ সেপ্টেম্বরের ঘটনায় সরকার দু’টি মামলা দায়ের করেছে। একটি পেনাল কোডের, অন্যটি দ্রুত বিচার আইনে। শেষ পর্যন্ত সরকার আমার বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে অভিযোগ না আনার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন আমি আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, যা হওয়ার হবে, আমি দেশে যাব। ওই সময় লন্ডনে অবস্থানকারী আমার এক বন্ধুকে বলেছিলাম, মক্কা ও মদিনায় অবস্থানরত আমাদের সমর্থকদের যেন অনুরোধ করা হয়, পবিত্র স্থানগুলোতে দোয়া করতে। উল্টো তারাও খবর পাঠালেন, আমি যেন বাংলাদেশে না যাই।
যাই হোক, আল্লাহর ওপর ভরসা করে অক্টোবর মাসে নিউইয়র্ক থেকে ঢাকায় ফিরি। জুনিয়ররা জামিনের আবেদন প্রস্তুত রেখেছিলেন। ২০ ঘণ্টা জার্নি করে ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি হাইকোর্টে গিয়ে অন্তর্বর্তী জামিন চাইলাম। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আমার আইনজীবী ছিলেন। তখনো বিচার বিভাগ অনেকটা স্বাধীন ছিল। হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি হাস্যরসে আমাকে বললেন, মি. রাজ্জাক, আপনি কি ম্যাজিশিয়ান নাকি, একই সাথে ঢাকায় এবং হেগে অবস্থান করতে পারেন!

এর কিছুদিন পরই ট্রাইব্যুনালে গেলাম। ওই ঘটনা যখন ঘটে তখনো ট্রাইব্যুনালে যাওয়া শুরু করিনি। ট্রাইব্যুনালে অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামসহ জুনিয়ররা যাতায়াত করতেন। ট্রাইব্যুনালের প্রথম দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমার সাথে বিএনপির সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীনসহ আরো অনেকে ছিলেন। পরে আল্লামা সাঈদীর মামলায় শুনানিতে অংশ নেয়ার জন্য সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সাহেবও একাধিকবার ট্রাইব্যুনালে গেছেন। এখানে একটি বিষয় অত্যন্ত বিনয়ের সাথে উল্লেখ করতে চাই, আমরা যদি আল্লামা সাঈদীসহ অন্য নেতাদের ডিফেন্সের দায়িত্ব না নিতাম তাহলে বিএনপির সিনিয়র আইনজীবী কাউকেই আমরা সাথে পেতাম না। কারণ, বিষয়টি ছিল খুবই স্পর্শকাতর। আমাদের একটি শক্তিশালী ডিফেন্স টিম গঠন করার পরই আমরা বিএনপির আইনজীবী নেতাদের সমর্থন পাই। বলা দরকার, তাদের অনেকেই বিশেষ করে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সাহেব বেগম জিয়ার সম্মতিক্রমেই ওই মামলায় অংশ নেন।

আমি ব্রিটেনের উচ্চ আদালত, অর্থাৎ হাইকোর্ট, কোর্ট অব আপিল এবং ওল্ড বেইলিতে অনেক মামলা পরিচালনা করেছি। কিন্তু বাংলাদেশে জামায়াতের শীর্ষ ১০ নেতাকে ডিফেন্স করার যে সুযোগ আমি পেয়েছিলাম, এটিকে আমি পেশাগত জীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা মনে করি। এটি সত্য যে, জামায়াত নেতারা সবাই রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু তারা কেউ যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত ছিলেন না। পাকিস্তানের ঐক্যের জন্য কাজ করা ১৯৭২ সালের কোলাবরেটার্স অর্ডিন্যান্সের অধীনে অপরাধ হতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই তা মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় পড়ে না। একজন আইনজীবী হিসেবে আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, দেশে বিচার বিভাগ স্বাধীন হলে মাওলানা সাঈদীসহ অন্য সব নেতা বেকসুর খালাস পেতেন।

এখন মনে হচ্ছে, আমার সব বন্ধুবান্ধবের উপদেশ উপেক্ষা করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন, আল্লামা সাঈদীসহ অন্যান্য নেতার মামলায় ডিফেন্স টিমের চিফ হিসেবে ভূমিকা রাখার জন্য।
আজকের এই আলোচনা আল্লামা সাঈদীকে স্মরণে। তাই তার মামলার গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় বলা প্রয়োজন। আগেই বলেছি, তার বিরুদ্ধে প্রথমে ২০টি চার্জ এনেছিল প্রসিকিউশন। ট্রাইব্যুনালের রায়ে আটটি চার্জে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত রায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ওই রায়ের পর বিক্ষোভে ফেটে পড়ে গোটা দেশের সাধারণ মানুষ। দেশব্যাপী বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে শতাধিক মানুষ নিহত হন।

জনৈক বিসা বালী ও ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার অভিযোগে তাকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়। বিসা বালীর চার্জে সবচেয়ে বড় সাক্ষী ছিলেন তার ভাই সুখরঞ্জন বালী। সুখরঞ্জন বালীর একটি মিথ্যা সাক্ষ্য প্রসিকিউশন তৈরি করেছিল। মামলা চলাকালীন সময়ে সুখরঞ্জন বালীর একটি ভিডিও স্টেটমেন্ট নিয়ে আসেন আল্লামা সাঈদীর যোগ্য সন্তান মাসুদ সাঈদী। এতে সুখরঞ্জন বালী মিথ্যা সাক্ষী দিতে অস্বীকৃতি জানান। আমরা সেই ভিডিও ট্রাইব্যুনালে দিলাম। ভিডিও স্টেটমেন্ট অনুযায়ী প্রসিকিউশনের অভিযোগ পুরোপুরি অসত্য। প্রধান সাক্ষী সুখরঞ্জন বালী ডিফেন্স উইটনেস হতে চান। ট্রাইব্যুনাল সে দিন সুখরঞ্জন বালীকে ডিফেন্স উইটনেস হিসেবে সাক্ষ্য দিতে অনুমতি দেয়নি। বলা হয়, আগে আবেদন করতে হবে। তারপর তারা বিবেচনা করবেন। সে দিনই আমরা আবেদন করলাম। পরে (৫ নভেম্বর ২০১২) সুখরঞ্জন বালীকে ডিফেন্স টিমের একজন আইনজীবীর গাড়িতে করে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হচ্ছিল, আল্লামা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য। ট্রাইব্যুনালে প্রবেশপথে সাদা পোশাকধারীরা আইনজীবীর গাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সুখরঞ্জন বালীকে। পরে তাকে পাওয়া যায় ভারতের একটি কারাগারে। আমার জানামতে, দুনিয়ার ইতিহাসে এমন ঘটনা আর কোনো দিন ঘটেনি। সুখরঞ্জন বালী বাংলাদেশের নাগরিক। অপহৃত হলেন ঢাকার যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল চত্বর থেকে। কেমন করে তিনি ভারতের কারাগারে গেলেন, সেটি বিস্ময়কর।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান সাক্ষী যদি ডিফেন্সের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে আসেন তাহলে মামলার উদ্দেশ্য উন্মোচিত হয়ে যায়। এই ভয়ে সুখরঞ্জনকে আর সে সুযোগ দেয়া হয়নি।

এবার আসা যাক, ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার ঘটনায়। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী একটি মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় তখনই পুলিশ তদন্ত করে চার্জশিট দিয়েছিল। মামলাটির এফআইআর ও চার্জশিটে কোথায়ও আল্লামা সাঈদীর বিষয়ে আকারে ইঙ্গিতেও একটি শব্দ নেই। পিরোজপুর তখন বরিশাল জেলার একটি মহকুমা ছিল। বরিশাল জেলা আদালত থেকে পুরনো এই মামলার সার্টিফাইড কপি সংগ্রহ করলেন আল্লামা সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী। আদালত থেকে সংগৃহীত সার্টিফাইড কপি হলো একটি অকাট্য দলিল। সেটি ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা মামলায় আল্লামা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করে আল্লামা সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ বা দলিলের ভিত্তিতে আদালত আল্লামা সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন তা বোঝার ক্ষমতা একজন আইনজীবী হিসেবে আমার নেই।
অবশ্য স্কাইপ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়েছিল, বিচারকার্য চলছিল বাংলাদেশের মাটিতে আর রায় লেখা হচ্ছিল ইউরোপের ব্রাসেলসে। স্কাইপ কেলেঙ্কারি জনসমক্ষে প্রকাশিত হওয়ার পর দেশ-বিদেশে ওই বিচারের সামান্যতম যে গ্রহণযোগ্যতা ছিল তাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। দ্য ইকোনমিস্ট এ বিষয়ে দু’টি রিপোর্ট প্রকাশ করে। দ্য ইকোনমিস্ট আটলান্টিকের উভয়পাড়ের দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য ও সমাদৃত একটি পত্রিকা। বাংলাদেশে ও লন্ডনে ইকোনমিস্ট স্কাইপ স্ক্যান্ডাল নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশের পর ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করেন। আসলে তাকে সরিয়ে দিতে সরকার বাধ্য হয়। তার জায়গায় মাননীয় বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবিরকে নিয়োগ দেয়া হয়। এই পরিবর্তনের পর তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল আল্লামা সাঈদীকে মৃত্যদণ্ড দেন।

আরো একটি কেলেঙ্কারি হলো, ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় একটি ভবনে (সেফ হাউজ) সাক্ষীদের এনে সাক্ষ্যে কী কী বলতে হবে তা শেখানো হতো বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু অনেক সাক্ষী শেখানো বক্তব্য আদালতে বলতে নারাজ ছিলেন। তাই রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে একটি তালিকাসহ আবেদন করে বলে, অমুক অমুক সাক্ষীকে পাওয়া যাচ্ছে না। আদালত যেন পুলিশের কাছে দেয়া তাদের সাক্ষ্যকেই সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেন। আমরা এর বিরোধিতা করি। ইতোমধ্যে মাসুদ সাঈদী সেফ হাউজের সব কাগজপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। তার বিবরণ দু’টি জাতীয় দৈনিক প্রকাশ করে। সেই ডকুমেন্টস থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণ হয় যে, সরকার কথিত নিখোঁজ সাক্ষীরা যাত্রাবাড়ীর সেই ভবনেই অবস্থান করছিলেন এবং তাদের কোর্টে আসতে কোনো বাধা ছিল না। কিন্তু তারপরও মাননীয় ট্রাইব্যুনাল অনেক সাক্ষীকে কোর্টে উপস্থাপন ছাড়াই পুলিশের জমা দেয়া দলিল তাদের সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেন। এটি ছিল ন্যায়বিচারপরিপন্থী।
সেই ঘটনা নিয়ে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা আবেদন তিনজন মাননীয় বিচারপতি মিলেই শুনলেন। কিন্তু আদেশ দেয়ার সময় মাননীয় বিচারক এ কে এম জহির অনুপস্থিত ছিলেন। সম্ভবত তিনি বাকি দু’জনের সাথে একমত হতে পারেননি। তার অনুপস্থিতিতে দু’জনে আদেশ দিলেন। পরে বিচারপতি এ কে এম জহির আর ট্রাইব্যুনালেই থাকতে পারেননি। তিনি পদত্যাগ করেন।

১৯৯২ সালে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত গণ-আদালতের সাথে যে বিচারক সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে গঠিত সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী টিমের সদস্য ছিলেন। সুতরাং একজন তদন্তকারী ব্যক্তি বিচারক হতে পারেন না। এ বিষয়টি নিয়ে ট্রাইব্যুনালের শুরুর দিকে একটি রিক্যুয়েজাল পিটিশন দেয়া হয়েছিল। রিক্যুয়েজাল পিটিশন হচ্ছে, এ ধরনের ক্ষেত্রে বিচারক নিজেই নিজেকে বিচারকার্য থেকে প্রত্যাহার করে নেবেন। ওই পিটিশন মাননীয় বিচারক এ কে এম জহির ও এ টি এম ফজলে কবীর শুনানি করলেন। তারা একটি ভালো রায় দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, রিক্যুয়েজাল করবেন কি না, সেটি ওই বিচারকের এখতিয়ার। কিন্তু মাননীয় বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম জানিয়ে দিলেন, তিনি রিক্যুয়েজাল করবেন না। এ রকম ঘটনাও কোনো দুনিয়ার বিচারের ইতিহাসে বিরল।

আল্লামা সাঈদী ট্রাইব্যুনালে এলে প্রায়ই আমার হাত ধরে বলতেন ব্যারিস্টার ভাই, আল্লাহর দ্বীনের জন্য শহীদ হওয়া বড় কামনা। কিন্তু তাই বলে কি এসব অভিযোগে! আমার বিরুদ্ধে নারী ধর্ষণের অভিযোগ! মানুষ হত্যার অভিযোগ! তিনি আরো বলতেন, জীবনের একটিমাত্র আশা- জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে বের হয়ে মানুষের ঘরে ঘরে কুরআনের বাণী পৌঁছাতে চাই। তার সে আকাক্সক্ষা আর পূর্ণ হয়নি। কিন্তু, তথ্যপ্রযুক্তির এই আধুনিক যুগে মানুষ তার মুখে তাফসির যুগ যুগ ধরে শুনতে থাকবে। এটি পরিষ্কার, জীবিত সাঈদীর চেয়ে মৃত সাঈদী কম শক্তিশালী নন।

লেখক : বিশিষ্ট আইনজীবী