অবশেষে সংসদে স্বতন্ত্র এমপিদের জোট বাঁধার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে জোটের নেতা এবং উপনেতাও। তবে এই জোট সংসদে প্রধান বিরোধী জোটের ভূমিকায় থাকবে কিনা, তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। কারণ হিসেবে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলে যুক্ত করার দাবি রয়েছে অনেক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের পর তা চূড়ান্ত হবে বলে জানিয়েছেন একাধিক স্বতন্ত্র এমপি। আগামী ২৮ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় গণভবনে আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ পেয়েছেন ৬২ স্বতন্ত্র এমপি।
একাদশ সংসদের প্রধান হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী সমকালকে জানান, সংসদ নেতা শেখ হাসিনা রোববার স্বতন্ত্র এমপিদের সঙ্গে বসবেন। তবে বৈঠকে কী বিষয়ে আলোচনা হবে, তা সংসদ নেতা ছাড়া কেউ বলতে পারেন না।
গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৯৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে জয় পায়। দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে জাতীয় পার্টি (জাপা) পায় ১১ আসন। জাসদ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও কল্যাণ পার্টি একটি করে আসন পায়। ৬২ আসনে জয় পান স্বতন্ত্ররা। এই অবস্থায় নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর থেকে প্রধান বিরোধী দল কারা হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন তৈরি হয়। ১১ আসন নিয়ে জাপা বিরোধী দলের মর্যাদা পাবে কিনা, তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলতে থাকে। স্বতন্ত্র সদস্যরা জোট গঠনের মাধ্যমে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারেন– এমন আলোচনাও শুরু হয়।
স্বতন্ত্র এমপিরা জানান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রোববারের বৈঠকের পরই সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন, স্বতন্ত্র সদস্যদের জোটগতভাবে সংসদীয় দল গঠন এবং বিরোধী দলের ভূমিকায় স্বতন্ত্ররা থাকবেন কিনা– এসব বিষয় স্পষ্ট হবে। তবে বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র এমপি জানিয়েছেন, তারা নিজেদের আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলে যুক্ত করার দাবি জানাবেন।
গাইবান্ধা-২ আসনের এমপি শাহ সরোয়ার কবির বলেন, স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিত হলেও আমি স্থানীয় আওয়ামী লীগের মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের প্রশ্নই ওঠে না। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। তিনি আরও বলেন, স্বতন্ত্র এমপিরা অনেক ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের এমপিদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। স্বতন্ত্রদের কারণে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে। বিদেশিদের কাছে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। তাই সংসদীয় কার্যক্রম পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্বতন্ত্রদের জোট হতে পারে।
তবে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রবীণ এমপি জানান, স্বতন্ত্র এমপিদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের পদধারী হলেও আপাতত তাদের সংসদীয় দলে নেওয়ার পরিকল্পনা নেই। তাই স্বতন্ত্রদের আলাদা জোট গঠনের মাধ্যমেই সংসদীয় কার্যক্রমে অংশ নিতে হবে। আর স্বতন্ত্র জোটের নেতাই যে বিরোধীদলীয় নেতারা মর্যাদা পাবেন, সেটা নিশ্চিত নয়।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক একজন সদস্যকে স্বতন্ত্র জোটের সংসদীয় দলের নেতা এবং যুবলীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্যকে স্বতন্ত্র জোটের সংসদীয় দলের উপনেতা করার বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে। সংসদ কক্ষে সদস্যদের আসন বিন্যাসের কাজ চলছে। সেখানে স্বতন্ত্র সদস্যদের আসন রয়েছে জাতীয় পার্টির সদস্যদের পাশে। বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র সদস্য সামনের সারির আসন পাবেন।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী দ্বাদশ সংসদের প্রধান বিরোধী দল কারা হচ্ছে তা বলতে চাননি। তাঁর মতে, নির্বাচনে দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি ১১ আসন নিয়ে প্রধান বিরোধী দলের স্বীকৃতি পাবে কিনা– তা নিয়ে আইনগত পর্যালোচনার বিষয় রয়েছে। স্বতন্ত্র সদস্যরা জোট গঠন করবেন কিনা, সেটাও স্পষ্ট নয়। অবশ্য এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় যথেষ্ট রয়েছে।
এদিকে, নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে স্বতন্ত্র এমপিদের কাছে চিঠি দিয়ে সংরক্ষিত আসনের নির্বাচনে তাদের অবস্থান জানতে চাওয়া হয়েছে। গত ২২ জানুয়ারি ইসি সচিব জাহাংগীর আলমের সই করা ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচনের জন্য সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে আসন বণ্টনের জন্য আলাদা তালিকার নিয়ম রয়েছে। সংসদের সাধারণ নির্বাচনের ফল গেজেটে প্রকাশিত হওয়ার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে এই তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। এতে স্বতন্ত্র সদস্য কোনো রাজনৈতিক দল বা জোটে যোগ দিলে আলাদা তালিকা তৈরির নিয়ম রয়েছে। বিষয়টি সাধারণ নির্বাচনের ফল গেজেটে প্রকাশিত হওয়ার পরবর্তী ২১ কার্যদিবসের মধ্যে ইসিকে অবহিত করতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচনের উদ্দেশ্যে কোনো দলের সঙ্গে জোট গঠন করা হলে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে কমিশনকে জানানোর অনুরোধ জানানো হয়।
নির্বাচন কমিশনের চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বরিশাল-৪ আসনের স্বতন্ত্র এমপি পংকজ নাথ জানান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরে তিনি এ বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত ইসিকে জানাবেন। তাঁর আসনে নৌকার প্রার্থী ছিল না। এর আগের সংসদে তিনি নৌকা নিয়ে বিজয়ী হন। এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জিতলেও এখন তিনি আওয়ামী লীগেরই একজন। তবে সংসদে কোন ভূমিকায় থাকবেন, রোববারের বৈঠকে সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা পাবেন বলে আশা করছেন এ স্বতন্ত্র এমপি।
ময়মনসিংহ-৭ আসনের স্বতন্ত্র এমপি এ বি এম আনিসুজ্জামান জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তিনি গণভবনে আমন্ত্রণ পেয়েছেন। এই আমন্ত্রণ সংসদের কোনো বিষয় নয়, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
৬২ স্বতন্ত্র এমপির মধ্যে ৫৭ জন আওয়ামী লীগের পদপদবিতে রয়েছেন। দু’জনের পদ না থাকলেও, তাদের পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আর বাকি তিনজনের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে নির্বাচিত এস এ কে একরামুজ্জামান নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদ থেকে বহিষ্কার হন। সিলেট-৫ আসনে ফুলতলীর পীরের ছেলে মোহাম্মদ হুছামউদ্দিন চৌধুরী স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগের মাসুক উদ্দিন আহমেদকে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেন এবং পরে তাঁর পক্ষে মাঠে নামেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা।
নীলফামারী-৪ আসনটি জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের ভাগনে আহসান আদেলুর রহমানকে ছেড়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এই আসনে লাঙল না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হন জেলা জাপার সহসভাপতি সিদ্দিকুল আলম। তবে দলের সিদ্ধান্ত না মানায় তিনি বহিষ্কৃত হন। এর মাধ্যমে জাপার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে বলে জানান এ স্বতন্ত্র এমপি। তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে চাওয়ার অভিমত প্রকাশ করেন।
পদপদবি না থাকলেও আওয়ামী লীগ পরিবারের দুই সদস্যের মধ্যে গাইবান্ধা-১ আসনে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফরোজা বারীর মেয়ে আবদুল্লাহ নাহিদ নিগার নির্বাচিত হন। তিনি মায়ের ভোটের প্রচারে এসে ‘ডামি প্রার্থী’ ছিলেন। তাঁর মা নৌকা প্রতীক পেলেও জাপার সঙ্গে সমঝোতা হওয়ায় নির্বাচন থেকে সরে যান। ফলে এই আসনে নাহিদ নিগার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে হারান।
একইভাবে জাপার সঙ্গে সমঝোতার কারণে পিরোজপুর-৩ আসনে নৌকা পেয়েও নির্বাচন থেকে সরে যান আশরাফুর রহমান। তাঁর ভাই শামীম শাহনেওয়াজ ছিলেন ‘ডামি প্রার্থী’। তিনি জাপার সাবেক এমপি রুস্তম আলী ফরাজিকে পরাজিত করেন।
৬২ স্বতন্ত্র এমপির ৪৩ জন আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করেন। চারজন জয় পেয়েছেন ১৪ দলের শরিক দলের নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে। বাকিরা জয় পান জাপা এবং অন্যান্য স্বতন্ত্র প্রার্থীকে হারিয়ে।