আর ‘মৃত্যুদিবস’ নয়, ‘প্রয়াণ দিবস’

আর ‘মৃত্যুদিবস’ নয়, ‘প্রয়াণ দিবস’

Daily Nayadiganta

আশির দশকের শেষ দিকে এবং নব্বইয়ের শুরুর দিকে ঢাকায় মহিলা সমিতি মঞ্চে নাটক দেখতে যেতাম। তখনকার শাসক এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সংবিধানে যুক্ত করেছেন। তার প্রধানমন্ত্রী (সম্ভবত তখন এই পদেই ছিলেন) মওদুদ আহমদ দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছিলেন, ‘মৌলবাদকে প্রতিহত করতেই সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযুক্ত করা হয়েছে।’ এই উপলক্ষেই তখন হিন্দু-বৌদ্ধ -খ্রিষ্টান-আওয়ামী ঐক্য পরিষদ গঠিত হলো। কাজেই এই ঘোষণায় মূল লাভ কাদের হয়েছে- সেটি গবেষণার বিষয়।

কাজটি এরশাদ করলেও ঘৃণার কামানটি যেন বিশেষত জামায়াতে ইসলামীর দিকেই তাক করা হয়েছিল। বিশিষ্ট লেখক, কবি ও সমাজচিন্তক ফরহাদ মজহারের কথামতো, তারা ইসলামকে গালি দেয়ার সময় নিরাপদ উপায় হিসেবে জামায়াতকেই বেছে নেয়।’ তার এই পর্যবেক্ষণটি খুবই প্রণিধানযোগ্য এবং ট্রিলিয়ন ডলারের একটি পর্যবেক্ষণ।

মহিলা সমিতি মঞ্চে আয়োজিত এক দিনের নাটকের একটি দৃশ্য মনে দাগ কেটে আছে। দাড়ি-টুপি পরিহিত ভিলেন দাঁত মেসওয়াক করতে করতে নায়িকাদের ড্রয়িং রুমে ঢুকে পড়ে। রাজাকারি কিছু সংলাপ আওড়াচ্ছে আর বিরক্তিকর হম্বিতম্বি প্রদর্শন করছে। একপর্যায়ে ওয়াক থু বলে এক দলা থুথু মুখে রেডি করেছে নিক্ষেপের জন্য। এমন সময় নায়িকা বললেন, জানেন, এটি কার বাসা? আমার ভাইয়ের নাম অমুক। এটি বলতেই বিশেষ ভঙ্গি করে সেই প্রায় ফেলে দেয়া থুথু বিশেষ ভঙ্গি করে পুনরায় মুখে টেনে তুলে ফেলল। নায়িকাসহ হলের সমস্ত দর্শক ঘৃণার দৃষ্টিতে এই ভিলেনের দিকে তাকাচ্ছেন! এগুলো আসলে একটি বিশেষ ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্বেষী প্রচারণা বলেই জনগণ দেখেছে।

বাস্তবে জামায়াত শিবিরের লোকজন মেসওয়াক খুব কমই ব্যবহার করেন। বেশির ভাগই ব্রাশ-টুথপেস্ট ব্যবহার করে থাকেন। তাবলিগ জামায়াতসহ কওমি মাদরাসার লোকজন রাসূল সা:-এর একটি সুন্নত হিসেবে এই কাজটি অত্যন্ত সিরিয়াসলি করে থাকেন। তবুও নাটকে এটি দেখানো হলো জামায়াত শিবিরের একটি ঘৃণ্য ও মধ্যযুগীয় আচরণ হিসেবে।

মহিলা সমিতি মঞ্চে তখন নাটকের ভেতরেই স্লেøাগান দেয়া হতো- গোলাম আজম-সাঈদী/বাংলার ইহুদি। কেন ইহুদিদের জামায়াতের সাথে এক পাল্লায় তুলে গালি দেয়া হবে, সেটিও রহস্যময় মনে হতো।
সে সময় নাটকের পর কিছু লিফলেট বিতরণ করা হতো। সে সব লিফলেটে বিশেষ আবেদন হিসেবে থাকত, আপনার ছেলেমেয়ের নাম বাংলায় রাখুন।’ মূলত ‘মরুভূমির দেশের নামে’র বিরুদ্ধেই ছিল তাদের এই প্রচারণা জেহাদ।

ভাগ্যের আজ কী নির্মম পরিহাস! বিশুদ্ধ বাঙালি বানানোর মানসে আমাদের ছেলেমেয়েদের নাম যারা বাংলায় রাখতে উদ্বুদ্ধ করলেন, বাংলা ভাষার সেই কমরেডরা লাইন ধরে আজ নিজেদের ছেলেমেয়েদের ইউরোপীয় সাদা চামড়াদের সাথে বিয়ে শাদি করাচ্ছেন! এসব বিয়েতে তারা নিজেরা যে খুব মনোযাতনায় ভুগছেন- তা বোঝার উপায় নেই। বিয়ের অনুষ্ঠানে বর বা কনের আধুনিক বাবা-মা হিসেবে তাদের উদোম নাচ দেশবাসীকে এবং উপস্থিত সবাইকে বিনোদিত করেছে। এতে তাদের খাঁটি বাঙালিত্ব যেন আরো পোক্ত হয়েছে।

বাংলা ভাষার খাঁটি প্রেমিকরা ইদানীং আরো একটি কাজ শুরু করেছেন। দেশে বহুল প্রচলিত শব্দ বাদ দিয়ে কিছু অপ্রচলিত ও কঠিন শব্দ ও ভাব প্রচলনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। এতদিন দেশবাসী পালন করত দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের ‘মৃত্যু দিবস’। এখন তাদেরই ‘প্রয়াণ দিবস’ পালন শুরু হয়েছে। এই শব্দে নাকি প্রয়াত ওই ব্যক্তিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়।

এ রকম প্রচলিত বহু শব্দ বদলিয়ে অপ্রচলিত কঠিন শব্দ চালু করার চেষ্টা শুরু হয়ে গেছে। কেউ প্রশ্ন করে না, প্রচলিত শব্দটি সমস্যা সৃষ্টি করল কিভাবে?

আমাদের বাপ-দাদারা ইন্তেকাল অথবা মৃত্যুবরণ করলেও আমাদের শেষ গন্তব্য ‘না ফেরার দেশে’ই স্পষ্ট হয়ে গেছে। মাঝখান থেকে নেহায়েত ইসলাম ধর্মীয় পরিভাষা ‘শহীদ’ শব্দটি কেন যেন এই শব্দ অ্যালার্জিকদের মাত্রাধিক পছন্দ হয়ে পড়ল! যারা ইন্তেকাল করতে চান না, ইহলোক ত্যাগ করতে চান না, এমনকি মৃত্যুবরণকেও অপছন্দ করেন, তারাই বুঝি প্রয়াণের পর ‘শহীদ’ হিসেবে গণ্য হতে চান! সত্যিই আজব এই চাওয়া-পাওয়া।

দিন কয়েক আগে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চল্লিশতম ‘প্রয়াণ দিবস‘ পালন অনেকেরই মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এতদিন ‘মৃত্যু দিবস’ পালন করে এলেও এখন শুরু হয়েছে নজরুলের ‘প্রয়াণ দিবস’ পালন! কবি জীবদ্দশায় এ ধরনের শব্দঅ্যালার্জিকদের বিরুদ্ধে ছিলেন খুবই সোচ্চার। কবি নজরুলের সেই সময়টি ছিল ব্রিটিশ-ভারতের যুগ। তখনো ভারতবর্ষ ভাগ হয়নি। উপমহাদেশের মুসলমানদের ওপর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নিপীড়নের চিত্রটি কবি নজরুল তার লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন।

নতুন প্রজন্মের এই বিষয়গুলো জানা থাকা দরকার। কারণ সেই সময়ের চেয়েও কঠিন সময় পার করছে উপমহাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়। এখন আমরা কোন শব্দ দিয়ে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করব, শুধু তাই শিখিয়ে দেয়া হচ্ছে না; আমাদের খাবার মেন্যু কী হবে সেটাও বলে দেয়া হচ্ছে। ফ্রিজে গরুর গোশত আছেÑ এই সন্দেহে কোথাও কোথাও পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। এ ধরনের উগ্রতা ও ধর্মীয় উন্মাদনা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি অর্জন করে আমাদের একের পর এক গ্রাস করছে। ‘ইসলামী মৌলবাদ’ নিয়ে দেশে যে শ্রেণীটি সর্বক্ষণ আতঙ্ক ছড়াতেন, তারা ক্রমবর্ধমান হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদের বিরুদ্ধে রহস্যজনকভাবে নীরব হয়ে পড়েছেন। বরং যারা এই উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে, সাংস্কৃতিক ন্যাওটারা তাদের বিরুদ্ধেই কথিত সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তুলছে।

প্রায় শত বছর আগে কবি নজরুলের ‘খুন’ শব্দটির ব্যবহার নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন তখনকার কবিসম্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ ব্যাপারে কবি নিজের জবানিতেই ‘বড়র পিরিতি বালির বাঁধ’ নামক প্রবন্ধে লিখে গেছেন; ‘এই অভিমন্যুর রক্ষী মনে করে কবিগুরু আমায়ও বাণ নিক্ষেপ করতে ছাড়েননি। তিনি বলেছেন, আমি কথায় কথায় ‘রক্ত’ কে ‘খুন’ বলে অপরাধ করেছি। কবির চরণে ভক্তের সশ্রদ্ধ নিবেদন, কবি তো নিজেও টুপি-পায়জামা পরেন। অথচ আমরা পরলেই তাঁর এত আক্রোশের কারণ হয়ে উঠি কেন, বুঝতে পারি না।

এই আরবি-ফার্সি শব্দ প্রয়োগ কবিতায় শুধু আমিই করিনি। আমার বহু আগে ভারতচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথসহ অনেকেই করে গেছেন। আমি একটা জিনিস কিছুদিন থেকে লক্ষ করে আসছি। সম্ভ্রান্ত হিন্দু বংশের অনেকেই পায়জামা-শেরওয়ানি-টুপি ব্যবহার করেন, এমনকি লুঙ্গিও বাদ যায় না। তাতে তাদের কেউ বিদ্রƒপ করে না, তাদের ড্রেসের নাম হয় ‘ওরিয়েন্টাল‘। কিন্তু এগুলোই মুসলমানরা পরলে তারা হয়ে যায় ‘মিয়া সাহেব’! মৌলানা সাহেব আর নারদ মুনির দাড়ির প্রতিযোগিতা হলে কে যে হারবেন তা বলা মুশকিল; তবুও এ নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রƒপের আর অন্ত নেই। আমি তো টুপি পায়জামা-শেরওয়ানি-দাড়িকে বর্জন করেছি ওই ‘মিয়া-সাহেব’ বিদ্রƒপের ভয়েই- তবুও নিস্তার নেই। এইবার থেকে আদালতকে না হয় ‘বিচারালয়’ বলব, কিন্তু নাজির-পেশকার-উকিল-মোক্তারকে কী বলব? খুন আমি ব্যবহার করি আমার কবিতায়, মুসলমানি বা বলশেভিক রং দেয়ার জন্য নয়। হয়তো কবি এই দুটোর একটিও পছন্দ করছেন না, তাই এত আক্ষেপ তার। আমি শুধু ‘খুন‘ নয়, বাংলায় চলতি আরো অনেক আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছি আমার লেখায়। আমার দিক থেকে এর একটি জবাবদিহিতা আছে। আমি মনে করি, বিশ্ব কাব্যলক্ষ্মীর একটা মুসলমানি ঢং আছে। ও-সাজে ওর শ্রীর হানি হয়েছে বলেও আমার জানা নেই। … বাংলা কাব্যলক্ষ্মীকে দুটো ইরানি জেওর পরালে তার জাত যায় না, বরং তাকে আরো খুবসুরতই দেখায়।’

জানি না মনের কষ্ট আজ রাখি কোথায়? জীবিত থাকতে যে কবি এই শব্দঅ্যালার্জিকে সমস্ত শক্তি ও প্রজ্ঞা দিয়ে প্রতিহত করেছেন, আজকে তারই মৃত্যু দিবস হয়ে গেল ‘প্রয়াণ দিবস’! এগুলো নিয়ে প্রতিবাদ করার কেউ নেই। বড়র ‘পিরিতি বালির বাঁধ’ প্রবন্ধটি পড়লে মনে হবে, এগুলো শত বছরের আগের ঘটনা নয়- যেন অতি সাম্প্রতিক ঘটনা।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ লিখেছিলেন, ‘এটা অবধারিত সত্য যে, কবি নজরুল জন্মগ্রহণ না করলে অন্তত বাংলাভাষী মুসলমান সমাজে আজিকার জয়যাত্রার অগ্রগতি থেকে অন্তত এক শতাব্দী পিছিয়ে থাকতে বাধ্য হতো। নজরুল ইসলাম একদিন বিনা নোটিশে ‘আল্লাহু আকবার’ তাকবিরের ‘হায়দরি হাঁক ‘মেরে ঝড়ের বেগে এসে বাংলা সাহিত্যের দুর্গ জয় করে বসলেন, মুসলিম বাংলার ভাঙা কেল্লায় নিশান উড়িয়েছিলেন। একদিন দূর করেছিলেন মুসলিম বাংলার ভাষা ও ভাবের হীনম্মন্যতা। মনের দিক থেকে জাতীয় জীবনে এটা একটা বিপ্লব। এ বিপ্লবের এক ইমাম নজরুল ইসলাম। ‘সই শব্দঅ্যালার্জি নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আজ কবি নজরুলের মতো কোনো ‘ইমাম’ নেই এই প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার। আবুল মনসুর আহমদের মতো কোনো মোয়াজ্জিনও খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং সেই মোয়াজ্জিনদের কারো কারো বংশধররাই শব্দঅ্যালার্জিকদের অগ্রসৈনিক সেজে বসেছেন। নিজের বাবার বলা সব কথা বলা বা লেখার সাহস পান না।

কবি নজরুল এবং আবুল মনসুররা যে ‘ভাব ও ভাষার হীনম্মন্যতা ‘থেকে জাতিকে কিছুটা মুক্ত করেছিলেন- তাতেই জাতিকে আবারো নিমজ্জিত করছেন তাদের সুযোগ্য শিষ্যরা। আত্মঘাতী এই কাজটি করছেন তারা প্রগতি ও আধুনিকতার মোড়কে।

কোনো কোনো বিশিষ্টজন যে ফোরাম গঠন করে গেছেন তা মধুর সিন্ডিকেটে রূপান্তরিত হয়েছে। তাদেরই চমৎকার ম্যানুভারিংয়ে দেশে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সবাই মিলে ‘স্বাধীন সাংবাদিকতার অপূর্ব নমুনা’ সৃষ্টি করে ফেলেছেন। এই মধুর সিন্ডিকেটের শুধু শিরোনামই এক হয় না, সংবাদের দাড়ি-কমাও মিলে যায়। সরকারের ছোটখাটো এবং সাক্সেস স্টোরি প্রকাশে গণমাধ্যম ‘পুরাপুরি স্বাধীন’। কিন্তু জনমনের কৌতূহল মেটাতে মাঝে মধ্যে ক্ষমতাবান কেউ কেউ কেমন আছেন এবং কোথায় আছেন, এই প্রশ্ন করতেও ভয় পায়।
[email protected]