আরো অস্থিতিশীল খাদ্যপণ্যের বাজার

দেশে কয়েক মাস ধরেই বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার কয়েকটি পণ্যের মূল্য বেঁধে দিলেও সুফল নেই, দাম না কমে উল্টো বাড়ছে। নতুন করে অস্থির হয়ে উঠেছে আলু ও পেঁয়াজের বাজার। দুই-তিনদিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ১৫-২০ টাকা। আলুর বেড়েছে ১০-১৫ টাকা। এছাড়া গত দুই সপ্তাহে নতুন করে বেড়েছে চাল, আটা, মসুর ডালসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি দেশী পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০-১১৫ টাকায়। ভারতীয় পেঁয়াজ গিয়ে ঠেকেছে ৮৫-৯০ টাকায়। আলু বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬০ টাকায়। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পণ্য দুটির দাম কয়েকদিন ধরে প্রতিনিয়ত বাড়ছে। দু-তিনদিন আগেও প্রতি কেজি দেশী পেঁয়াজ ৯০-১০০ টাকা, আমদানি হওয়া পেঁয়াজ ৭০-৮০ এবং আলু ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

চালের বাজারেও মূল্যবৃদ্ধির ছাপ। প্রতি কেজি আটাশ চাল এখন ৫৪-৫৬, মিনিকেট ৬৬-৬৮, জিরাশাইল ৮০-৮২, নাজিরশাইল ৭২-৭৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সপ্তাহখানেক আগেও আটাশ চাল বিক্রি হয়েছে ৫০-৫২ টাকায়। তারও সপ্তাহখানেক আগে মোটা এ চাল ৪৮ টাকা কেজি বিক্রি হতে দেখা গেছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, আগে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা আটাশ চাল ২ হাজার ৩৫০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা ছিল। এখন তা বেড়ে ২ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্য জাতের চালেও বস্তাপ্রতি ১০০-১৫০ টাকা বেড়েছে। দাম বেড়েছে আটারও। বর্তমানে দুই কেজির প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা করে। তবে নতুন করে আরো ১০ টাকা যোগ হয়ে বিভিন্ন কোম্পানির প্যাকেট বাজারে আসতে শুরু করেছে।

কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী বাবুল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রতিদিনই পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। গত কয়েকদিনে কেজিতে ২০-৩০ টাকা বেড়েছে। শুনেছি শ্যামবাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ পাইকারিতেই ৮০-৮৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। তাহলে খুচরায় আরো দাম বাড়বে। দেশী পেঁয়াজেও ২০-৩০ টাকা বেড়েছে।’

একই বাজারের আলু বিক্রেতা মো. সাইফুল জানান, পাইকারিতে গত সপ্তাহে আলুর দাম ছিল ৪০ টাকা কেজি। বর্তমানে পাইকারিতেই ৫১ টাকা করে কিনতে হয়। এতে পাঁচ কেজির পাল্লা পড়ে ২৭০-২৮০ টাকা। খুচরায় তাই কেজিপ্রতি আলু বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়।

মসুর ডালের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ৫ টাকা বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, বর্তমানে বড় দানার মসুর ডাল প্রতি কেজি ১০৫-১১০ টাকা, মাঝারি দানা ১২০-১২৫ ও ছোট দানা ১৩০-১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে সিন্ডিকেশনের কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। গত সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আর আগস্টে ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা গত সাড়ে ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ মূল্যস্ফীতির পেছনে সিন্ডিকেশন সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতিতে মূল্য বেঁধে দেয়া যায় না। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে অনেকগুলো বিষয়ের কারণে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকারের কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এ কারণে বাজারে সব জিনিসের দামই বেড়েছে।’

এদিকে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর ডিম, আলু ও পেঁয়াজের মূল্য বেঁধে দেয় সরকার। প্রতি কেজি আলুর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩৫-৩৬ টাকা, দেশী পেঁয়াজ ৬৪-৬৫ টাকা এবং প্রতিটি ডিমের মূল্য ১২ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। যদিও বাজারে সেই দামে পণ্য মেলা ভার। বরং সে সময়ের দেড় মাস পর এসে প্রায় দ্বিগুণ দামে এসব পণ্য বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে।

বাজার মনিটরিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, উৎপাদন মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে খুব অল্প দামেই পেঁয়াজ ও আলু কিনে নেন ব্যবসায়ীরা। চলতি বছর মৌসুমের শুরুতে অর্থাৎ মার্চে কৃষকরা প্রতি কেজি আলু বিক্রি করে পেয়েছেন ১০-১২ টাকা। কিন্তু জুলাই থেকে অস্থির হওয়া শুরু করে নিত্যপণ্যটির বাজার। আলুর দাম নিয়ে প্রতি বছর মূলত কারসাজি হয় হিমাগার পর্যায়ে। এতে ভূমিকা রাখেন ফড়িয়া, হিমাগার (কোল্ড স্টোরেজ) মালিক ও আড়তদাররা।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সার্বিক খরচ বিবেচনায় নিলে প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয় সাড়ে ১১-১২ টাকার মতো। আর হিমাগারে রাখতে কেজিপ্রতি খরচ পড়ে ৫-৬ টাকা। দেশে এ বছর ১ কোটি ৪ লাখ টনের বেশি আলু উৎপাদন হয়, যেখানে চাহিদা রয়েছে ৭০-৭৫ লাখ টন। এর মধ্যে ২০-২৫ শতাংশ উৎপাদন-পরবর্তী সময়ে নষ্ট হয়। সে হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকলেও নিয়ন্ত্রণে নেই আলুর বাজার।

দেশে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৩০ লাখ টন। গত অর্থবছরে নিত্যপণ্যটির উৎপাদন হয় ৩৪ লাখ টনের বেশি। তবে মাঠপর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যন্ত যেতে এক-চতুর্থাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয় কিংবা শুকিয়ে কমে যায়। চলতি বছরের মার্চে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩০-৩৫ টাকায় বিক্রি হয়। তবে গত এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকেই নিত্যপণ্যটির দাম বাড়তে শুরু করে।

সরকারিভাবে মূল্য নির্ধারণ ও এর কার্যকারিতা নিয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু গ্রামের হাটগুলোতেই দেশী পেঁয়াজের কেজি ৮৫ টাকার বেশি বিক্রি হচ্ছে। তাহলে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করব? আমরা বাজার নিয়ন্ত্রণে দিন-রাত পরিশ্রম করেছি। একপর্যায়ে আলু নিয়ন্ত্রণেও এসেছিল। সুপারশপে ৩৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে।’