আয়বৈষম্য কেবল বাড়ছেই

  • সালাহউদ্দিন বাবর

দু’টি গানের দু’টি চরণ স্মরণ করে আজ লেখার সূচনা করতে হচ্ছে। দুই গানের শুরু ‘সবাই তো সুখী হতে চায়, কেউ হয় কেউ হয় না।’ দ্বিতীয়টি হলো ‘আমি সুখের ঘরের চাবিটা যে হারিয়ে ফেলেছি।’ দু’টি গানের অর্থ খুব সহজ। এর আর কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। তবে এটি মনে করার কোনো কারণ নেই যে, গানের কলি স্মরণ করে নিবন্ধের শুরুর অর্থ এমন। খুব হালকা চটুল কোনো বিষয়ে অবতারণা করা। সম্প্রতি দেশের একটি বিশেষ সঙ্কটকে গভীরভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেটিই এই রচনার প্রতিপাদ্য বিষয়। আর বিষয়টির কেন্দ্রে রয়েছে, এই জনপদের মানুষের চরম আয় বৈষম্য নিয়ে সৃষ্ট সঙ্কট। তবে এখানে পুরো আয়-বৈষম্যকে তুলে ধরা নয়। বৈষম্যের একটি খণ্ডিত অংশই এখানে তুলে ধরার প্রয়াস মাত্র।

নিবন্ধটি পড়ে অগ্রসর হলেই বিষয়টি সহজ সরল ও স্বচ্ছ হবে। আর এই লেখার থিমটি বা প্রতিপাদ্যের বিষয়টি একটি খবরকে কেন্দ্র করেই। সেই খবরটির সামান্য একটু পাঠ করলে এই লেখার উদ্দেশ্যের সাথে গানের কলি দুটোর সাথে সাজুয্য খুঁজে পেতে পারেন। সেই খবরটি হয়তো অনেকেই পড়ে থাকতে পারেন। আবার অনেকে নাও পড়তে পারেন। সে যাই হোক, সেই খবরটি থেকে সামান্য কিছু অংশ এখন উদ্ধৃত করছি। বলাবাহুল্য, এই খবরটি অতি সম্প্র্রতি দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বেশ গুরুত্বের সাথে প্রকাশ পেয়েছে। দেশের যে খবরটি পাঠের আগে এর সার নির্যাসটুকু তুলে ধরলে পাঠকের এর বার্তা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে হয়তো একটি মানসিক প্রস্তুতি তৈরি হতে পারে। সে খবরটির শিরোনাম হলো- সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের আরো ১১ ধাপ অবনতি ঘটেছে। এখানে বলা প্রয়োজন, আমাদের সুখবোধ কমার সরল ব্যাখ্যা দাঁড়ায় আমাদের দুঃখজনিত মনোবেদনা গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠছে। প্রতি বছর জাতিসঙ্ঘের একটি অঙ্গসংগঠন বিভিন্ন দেশের মানুষের সুখবোধ নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করে থাকে। সুখী দেশের সেই সূচক তৈরি করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়। এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাব্যবস্থা নাগরিকদের মাথাপিছু আয়, দুর্নীতিজনিত পরিস্থিতি, সামাজিক সম্প্র্রীতি ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়গুলো সেখানে আমলে নেয়া হয়ে থাকে। ওপরে উল্লেখ করা বিষয় তথা ওই সূচকে অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো নিয়ে যদি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নেয়া হয়। দেখা যাবে আমাদের পিছিয়ে পড়ার কারণটি খুব সহজ ও স্বচ্ছ। এখন মূল খবরটি পাঠ করা যেতে পারে। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বের সুখী দেশের যে তালিকা এবার তৈরি করা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ অনেক ধাপ পিছিয়ে গেছে। এ বছর জাতিসঙ্ঘের ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে ১৪৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে নিচের দিকে তথা ১২৯তম স্থানে নেমে গেছে। এতেই স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, সুখের মানদণ্ডে বাংলাদেশের স্থান প্রায় তলানিতে পৌঁছেছে। মোদ্দা কথা, বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থেই আর সুখী কোনো দেশ নয়, দিন দিন মানুষ আরো দুঃখী হয়ে পড়ছে। এখানে অধিকাংশ মানুষই শোক দুঃখে ভারাক্রান্ত। স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছর (২০২৩ সাল) বাংলাদেশ সুখী দেশের তালিকা ১১৮তম স্থানে অবস্থান করছিল। এর আগের ২০২২ সালে সেই তালিকায় এ জনপদের অবস্থান ছিল ৯৪তম স্থানে। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবে সুখবোধ থেকে পিছিয়েই যাচ্ছে। বিষয়টি এই যে, ক্রমান্বয়ে এ দেশে মানুষের দুঃখসীমা অতিক্রম করে চলেছে। তালিকা উপরের দিকে ওঠা দূরের কথা; এক জায়গায় স্থির পর্যন্ত থাকতে পারছি না। পতনের ধারায় বাংলাদেশ পড়ে গেছে।

অথচ নিয়ত দেশের মানুষ কর্তৃপক্ষীয় সূত্রে শুনছে অনেক অনেক ভালো ও সুন্দর কথা। অনেক স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। হাজারো প্রতিশ্রুতির আশ্বাস আর প্রবোধ দেয়া হয়। বলা হয় দেশ শনৈই শনৈই এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে স্বর্ণ শিখরের দিকে। সম্ভাবনার ফল্গুধারা বইছে চতুর্দিকে। কিন্তু বাস্তবতাটা কী ও কোথায়। তার একটি চিত্র পাওয়া যায়। ওই ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস’ প্রতিবেদনে। এই ‘হ্যাপিনেস’-এর রিপোর্টটি তৈরি করেছে জাতিসঙ্ঘ। অপর দিকে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্য নিরাপত্তা-সংক্রান্ত অতি সম্প্র্রতি প্রকাশিত এক জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে যা প্রকাশ পেয়েছে সেখানে জাতিসঙ্ঘের প্রকাশিত রিপোর্টেরই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ব্যুরোর সেই জরিপ নিয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে। ব্যুরোর রিপোর্টে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে দেশের বহু পরিবারের ঘরে চাল থাকে না, তথা শতকরা হিসাবে ২ শতাংশ অর্থাৎ ৩৪ লাখ পরিবারের এক বেলা খাবার পর অপর বেলায় আর খাবার কিছু থাকে না। ঘরে আটা থাকে না ৬০ শতাংশ পরিবারের ঘরে। আর ডাল শূন্য থাকে ১৯ শতাংশ পরিবারে। প্রতিটি পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তার একটি করুণ চিত্রই এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এখন দেশের মোট পরিবারের সংখ্যা চার কোটি ১০ লাখ। সংস্থাটির জনশুমারি ও গৃহগণনার চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের মোট সংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। সে হিসাবে দেশে ৩৩ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮০ জন মানুষের একবেলা খাওয়ার পর পরের বেলায় চালের জোগান থাকে না। ওই প্রতিবেদনে খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে, খাদ্য এবং সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে না পারার বিষয়টি এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ এবং একই সাথে বড় উদ্বেগের বিষয়। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে জর্জরিত জনগোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করে কোনো দেশের অর্থনীতির ভিত গড়ে উঠতে পারে না।

এই সব তথ্য সামনে রেখে বিশিষ্টজনদের অভিমত হচ্ছে- ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার বিষয়টি কেবল অলীক স্বপ্ন, কল্পনা বা দুঃস্বপ্নের বিষয়। যেখানে প্রতি বছর দেশের মানুষের ক্রমান্বয়ে দুখী হয়ে যাওয়ার যে চিত্র উঠে এসেছে সেখানে উন্নত দেশ হয়ে উঠার যে লক্ষ্য স্থিরকৃত হয়েছে তার পাশাপাশি আজকে দুঃখবোধের ছবিটিও হাতে রয়েছে। তাকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কর্তৃপক্ষীয় উদ্যোগ প্রচেষ্টা প্রত্যয় পুরোপুরি বিপরীত। কথার ফুলঝুরি আর বাস্তবতা এক বিষয় নয়।

সুখ বোধের সাথে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেখানেও কিন্তু কোনো ভালো খবর নেই; বরং দুঃসংবাদ রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওই প্রতিবেদনে বিগত পাঁচ বছরের এমন চিত্র উঠে এসেছে। যেমন দেশে শিশুমৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ায় মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু কমেছে। ২০২৩ সালের হিসাবে গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৩ বছর, অথচ আগে অর্থাৎ ২০২২ সালে ছিল ৭২ দশমিক ২। একই সময়ে শিশুমৃত্যুর হার বেড়ে হয়েছে প্রতি হাজারে ৩৩ জনে। আর ২০২২ সালে শিশুমৃত্যু হাজারে ২৫ জন। ওই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় দেশের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি কতটা পিছিয়ে পড়েছে। এটি অবশ্যই মানুষের দুঃখ-কষ্টের অন্যতম এক কারণ।

প্রকৃত অর্থে বলা চলে, দেশের প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনো দুঃখ বেদনায় ভারাক্রান্ত। যদিও বিভিন্ন শ্রেণী-গোষ্ঠীর মানুষের দুঃখবোধের প্রকৃত মাত্রায় ভিন্ন রয়েছে। বিদ্যমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে নিম্নবিত্তের মানুষের হার ক্রমবর্ধমান। অপর দিকে একই কারণে মধ্যবিত্তের সংখ্যাও কমছে আয়রোজগার কমে যাওয়ার জন্য। নিম্নবিত্তের বলয়ে তারা প্রবেশ করছে। তবে লক্ষণীয় দেশের উচ্চবিত্তের সংখ্যা আবার ক্রমাগত স্ফীত হচ্ছে। নিম্নবিত্তের মানুষের আয় রোজগার কমায় তাদের দুবেলা খাবার জোটে না। জঠর জ্বালায় তাদের শান্তি সুখ জ্বলে-পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে। আর যারা মধ্যবিত্তের স্তরে কোনোক্রমে এখনো টিকে আছে তাদের হয়তো দুবেলা ডাল ভাত আলু সিদ্ধ ভর্তা ভাজি কোনোক্রমে জুটছে। তবে এসব মানুষের দুঃখ কম নয়। তবে তাদের মনোকষ্টের প্রকৃতি ভিন্ন।

দেশে গণতন্ত্র নেই, মানবাধিকার হারিয়ে গেছে, লিখতে বলতে নানা বিপত্তি। এসব বিষয় এই স্তরের মানুষের মর্মপীড়ার কারণ। এসব দুর্ভোগ দুর্যোগের মধ্যেও উচ্চবিত্তের মানুষের সংখ্যা দ্রুতই বেড়ে চলেছে। দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা দীর্ঘ হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ হিসাব অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে। এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা দাঁড়িছে এক লাখ আট হাজার ৪৫৭টিতে। মাত্র তিন মাস আগে এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল এক লাখ তিন হাজার ৫৯৭টি। ২০১১ সালের জুন মাসে কোটি টাকার হিসাব ছিল ৯৯ হাজার ৯১৮টি। এই সব কোটিপতিরও দুঃখের সীমা নেই। তাদের দুঃখ হয়তো এটিই যে, তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আরো টাকা কেন জমানো যাচ্ছে না। আরো অর্থ কেন পাচার করতে দেরি হচ্ছে। আরো দ্রুত কেন ভুয়া ঋণ নিতে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে।
এভাবে আর্থিক বিচারে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য ভয়াবহ রূপ নিতে চলেছে, যা চলমান একটি প্রক্রিয়া।

এ লেখা শেষ করার আগে আরেকটি বেদনার গল্প বলা যেতে পারে। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার গত ২৭ মার্চ ২০২৪ সংখ্যায়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতো অনুরূপ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত সংগৃহীত হয়েছে অপর জরিপ রিপোর্ট থেকে। সেই জরিপ থেকে বেরিয়ে এসেছে, দেশের ৭০ শতাংশ পরিবার খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন তথা খাবারের মান ও পরিমাণকে কমাতে বাধ্য হয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর আকাশচুম্বী হওয়ার কারণেই। এ জরিপটি পরিচালনা করেছে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক্স মডেলিং (এসএএনইএম)। গত বছরের এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে সংস্থাটি দেশে ৯ হাজার ৬৫টি পরিবারের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমেই তাদের জরিপ সম্পন্ন করেছে। ওই জরিপের তথ্য-উপাত্ত থেকে প্রকাশিত হয়েছে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ পরিবারই মূল্যস্ফীতির কারণে মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে দিন যাপন করছে।

গ্রামাঞ্চলের ৭৮ শতাংশ পরিবার এবং শহরাঞ্চলের ৭৬ শতাংশ পরিবার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে মারাত্মক দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন যাপন করছে। স্থান সঙ্কুলানের তাগিদের সেই জরিপ নিয়ে আর বেশি কিছু তুলে ধরা সম্ভব হলো না।

nayadiganta