যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বাংলাদেশের জনতা ব্যাংকের ‘জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানি আইএনসি’ (জেইসিআই) থেকে ৬ লাখ ৩ হাজার ৯৪৭ মার্কিন ডলার মেরে দিয়েছে আপিল বিভাগের বিচারপতি আবু বক্কর সিদ্দিকীর মেয়ে সুস্মিতা তাবাসসুম। বর্তমান মূদ্রার বিনিময় মূল্য অনুযায়ী এই ডলারের বিপরীতে টাকার অঙ্ক দাড়ায় ৫ কোটি ১৩ লাখ। তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মচারি ছিলেন।
২০১৫ সালে নিউইয়ার্কে জনতা ব্যাংকের জেইসিআই খোলা হয়। ওই প্রতিষ্ঠানের শুরু থেকেই সুস্মিতা তাবাসসুম টেলিফোন অপারেটর কাম টেলর হিসাবে চাকুরি করছিলেন। ওই প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী টাকা মেরে দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পর থেকে তিনি লাপাত্তা হয়ে আছেন। সুস্মিতা তাবাসসুম বাংলাদেশ বার কউন্সিলের সনদ প্রাপ্ত একজন অ্যাডভোকেট হিসাবে ঢাকা আইনজীবী সমিতিরও সদস্য। ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে তাঁর সদস্য নম্বর হচ্ছে ১৬ হাজার ৭৭। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এই সকল তথ্য জানা গেছে।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য তালিকায় দেখা যায়, সুস্মিতা তাবাসসুমের জন্ম ১৯৮২ সালে। তাঁর পিতার নাম বিচারপতি আবু বক্কর সিদ্দিকী। ঢাকায় বাসার ঠিকানা মোহাম্মদপুরের খিলজী রোডে। গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া।
উল্লেখ্য, সুস্মিতা তাবাসসুমের পিতা আবু বক্কর সিদ্দিকী এবং চাচা হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী সুপ্রিমকোর্টের বর্তমান আপিল বিভাগের আওয়ামী বিচারক। হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী আপিল বিভাগে আওয়ামী বিচারকের পাশাপাশি জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসাবেও দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৫ সাল থেকেই তিনি এই কমিশনের চেয়ারম্যান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র গুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, জেইসিআই-এর প্রধান নির্বাহী ছিলেন জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম। ২০১৯ সালের ২৭ জুলাই তিনি অবসরে গেছেন। এই কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী জনতা ব্যাংকের প্রধান দফতর ঢাকা থেকে একজনকে প্রধান নির্বাহী হিসাবে জেইসিআই-এ নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগপ্রাপ্ত মাহবুবুর রহমানের আমেরিকার ভিসা পেতে বিলম্ব হচ্ছিল। এই সুযোগে জেইসিআই-এ টেলিফোন অপরারেটর কাম টেলার সুস্মিতা তাবাসসুমকে দায়িত্ব পালনের জন্য ঢাকা থেকে সুপারিশ করা হয়। গত বছরের (২০১৯) ২৭ জুলাই থেকে ১০ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পালনাকালীন সুযোগে জেইসিআই থেকে উল্লেখিত ডলার মেরে দেন এই আওয়ামী বিচারপতির কন্যা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সুস্মিতা তাবাসসুম জনতা ব্যাংকের নিয়মিত কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারি নন। পিতা ও চাচার তদবীরেই তাঁকে বেআইনিভাবে ওই পদে বসানো হয়েছিল। জনতা ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, নিয়ম অনুযায়ী জনতা ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারিকে এ পদে নিয়োগ দেয়ার কথা। কিন্তু বাপ এবং চাচার জোরে আইনের ব্যাত্যয় ঘটিয়ে বহিরাগত সুস্মিতাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।
জেইসিআই-এর বর্তমান প্রধান নির্বাহি মাহবুবুর রহমান আমেরিকার ভিসা পাওয়ার পর গত ১১ ফেব্রুয়ারী কর্মস্থলে যোগ দেন। যোগদানের পরই তিনি দেখতে পান হিসাবে গরমিল রয়েছে। হিসাব মিলাতে গিয়ে তিনি দেখেন, ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির আয় ছিল ৩ হাজার ৪৫ ডলার। ব্যয় ৫৪ হাজার ৯৫৭ ডলার। আয়ের তুলানায় ব্যয় প্রায় ১৫ গুণ বেশি। চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে ২০ জুন পর্যন্ত আয় ছিল ১০ হাজার ৫৪০ ডলার। ব্যয় ছিল ১ লাখ ২ হাজার ৪৪০ ডলার।
মাহবুবুর রহমান কর্মস্থলে যোগদানের পর আয়-ব্যয়ের এই বৈষম্য এবং হিসাবে গরমিলের বিষয় গুলো দুইটি পৃথক ই-মেইলে জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, সুস্মিতা তাবাসসুম দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে ৬ লাখ ৩ হাজার ৯৪৭ ডলারের কোন হদিস নেই। এই নিয়ে জনতা ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দফতর গুলোতে চিঠি চালাচালি হলেও প্রাতিষ্ঠানিক কোন ব্যবস্থা এখনো নেওয়া হয়নি।
এদিকে মাহবুবুর রহমান চিঠির মাধ্যমে জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে জানান, তিনি কর্মস্থলে যোগ দেয়ার পর সুস্মিতার কাছে হিসাবের গরমিলের বিষয়ে জানাতে চাওয়া হয়। জবাবে সুস্মিতা জানিয়েছেন, অসুস্থ থাকায় সবকিছু হালনাগাদ করতে পারেননি। এজন্য ২২ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত সময় নিয়েছিলেন। ২২ ফেব্রুয়ারী সুস্মিতা ৩টি জমা রশিদ হস্তান্তর করেন। যাতে দেখা যায় জেইসিআই-এর আর্থিক লেন-দেন ছিল হাবিব আমেরিকান ব্যাংকে (হাব ব্যাংক)। এই ব্যাংকের হিসাবে ৫ লাখ ৯ হাজার ৮২০ ডলার জমা দেখানো হয় পৃথক ৩টি রশিদে। কিন্তু ওই ব্যাংকে গিয়ে মাহবুবুর রহমান জানতে পারেন এই রশিদের বিপরীতে কোন ডলার তাদের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়নি। এ বিষয়ে সুস্মিতাও হাব ব্যাংকের কাছে সন্তোষ জনক জবাব দিতে পারেনি বলে জানানো হয়েছে জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে। বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর থেকে সুস্মিতারও হদিস মিলছে না বলে জানা গেছে।