সোহরাব হাসান
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ভাগ্য এখন টু বি এবং নট টু বির মধ্যে আটকে আছে।
সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তাঁকে সরে যেতে হবে। কিন্তু কীভাবে সরে যাবেন, তিনি দাবির মুখে পদত্যাগ করবেন, নাকি তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হবে, সেটাই এখন প্রশ্ন।
আন্দোলনকারী কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম তাঁর পদত্যাগের জন্য বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। উপদেষ্টারা দৌড়ঝাঁপ করছেন। বিএনপির প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে বলেছেন, ‘সাংবিধানিক সমস্যা তৈরি হয় এমন কিছু করা যাবে না।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদচ্যুতি ও দেশত্যাগের পর তাঁর মনোনীত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন স্বপদে থাকতে পারেন কি না, বিতর্কটা শুরুতেও উঠেছিল। তবে সেই সময়ে আন্দোলনে বিজয়ী শক্তির মনোনীত উপদেষ্টা পরিষদ রাজনৈতিক বিতর্ক এড়িয়ে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার ওপর জোর দিয়েছিলেন। ৮ আগস্ট রাষ্ট্রপতির কাছেই শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা শপথ নেন।
বিতর্কটা নতুন করে ওঠে সম্প্রতি মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সম্পাদিত জনতার চোখ–এ প্রকাশিত রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎকারমূলক একটি লেখা থেকে। রাষ্ট্রপতি এতে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে পদত্যাগ করেছেন, তার দালিলিক প্রমাণ তাঁর কাছে নেই। তিনি শুনেছেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে চলে গেছেন। একই কথা মাসখানেক আগে শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ও বলেছিলেন। সে সময় তেমন প্রতিক্রিয়া হয়নি। এবার হলো।
পত্রিকায় খবরটি বের হওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি যে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পাননি, এটা হচ্ছে মিথ্যাচার এবং এটা হচ্ছে ওনার শপথ লঙ্ঘনের শামিল। কারণ, তিনি নিজেই ৫ আগস্ট রাত ১১টা ২০ মিনিটে পেছনে তিন বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওনার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং উনি তা গ্রহণ করেছেন।’
এখানে রাষ্ট্রপতির দুটি ভিন্ন বক্তব্য। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। অন্যদিকে সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেছেন, পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ নেই। প্রথমটি সত্য হলে দ্বিতীয়টি অসত্য। আর সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র কোথায়? আবার এই প্রশ্নও চলে আসে, সরকারপ্রধান ক্ষমতাচ্যুত হলে তাঁর আদৌ পদত্যাগপত্রের দরকার আছে কী না?
অতীতেও পরিবেশ–পরিস্থিতির চাপে পূর্বসূরি রাষ্ট্রপতিরা যে সব সময় সত্য কথা বলেছেন, তা নয়।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের ভাষণের কথা আমরা মনে করতে পারি। তিনি তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারকে অথর্ব ও দুর্নীতিবাজ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। পরে বিচারপতি স্বীকার করেছেন, এটা তাঁকে দিয়ে এরশাদ জোর করে বলিয়েছেন। একইভাবে ২০০৭ সালে ১/১১–তেও রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তাঁর নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙে দেওয়ার সময়ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর দোষ চাপিয়েছিলেন।
অনেকেই বলেছেন, সংবিধানে থাকুক বা না থাকুক রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের বিদায় নেওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তিনি বাংলাদেশের ২৩তম রাষ্ট্রপতি। এর আগে আরও ২২ জন রাষ্ট্রপতি ছিলেন। দু–একজন ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁদের বিদায় হয়েছে বিষণ্ন ও করুণ। যদিও তাঁরা সবাই একটি আনন্দধন পরিবেশে দায়িত্ব নিয়েছেন। আমাদের দুজন সাবেক রাষ্ট্রপতি হত্যার শিকার হয়েছেন, একাধিক রাষ্ট্রপতি অপমানজনকভাবে বিদায় নিয়েছেন।
বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি প্রথম দফায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত এই পদে ছিলেন ( স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী)। যদিও তিনি পাকিস্তানি কারাগারে বন্দী থাকার কারণে এই সময়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশে ফিরে সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। একই সময়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সরকারের সঙ্গে কাজ করতে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর টক্কর লাগে।
১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ালে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন মোহাম্মদউল্লাহ। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সংসদীয় পদ্ধতি বাতিল করে একদলীয় রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির শাসন জারি করেন এবং নিজেই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর এই দায়িত্বও স্থায়ী হয়নি।
একই বছরের ১৫ আগস্ট এক রক্তাক্ত সেনা অভ্যুত্থানে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হন। এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন ফারুক–রশীদসহ একদল তরুণ সেনা কর্মকর্তা এবং তাঁরা নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নেন খন্দকার মোশতাক আহমদকে, যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ও বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা।
খন্দকার মোশতাক আহমদের শাসনও ছিল অস্থায়ী। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পাল্টা অভ্যুত্থান হলে ৬ নভেম্বর মোশতাককে পদত্যাগ করতে হয়। নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নেওয়া হয় সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে। এরপর ৭ নভেম্বর ‘সিপাহি–জনতার বিপ্লবে’ খালেদ মোশাররফ ও তাঁর দুই সহযোগী নিহত হন। ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হন জিয়াউর রহমান। সেসময় তিনি নিজে রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধান সামরিক শাসকের পদ না নিয়ে সেই পদে বিচারপতি সায়েমকেই রেখে দেন।
সেটা ছিল সামরিক শাসনকাল। ফলে সংবিধানের বাধ্যবাধকতা ছিল না। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল জিয়াউর রহমান নিজেই এই পদে বসেন এবং সায়েমকে পদত্যাগে বাধ্য করেন, যার বিবরণ ‘অ্যাট বঙ্গভবন: লাস্ট ফেইজ’ বইয়ে আছে।
এরপর জিয়া সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার আগপর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন। একই দিন হাসপাতাল চিকিৎসাধীন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। পরে ওই বছরের ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয় এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থী কামাল হোসেনকে হারিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
কিন্তু নির্বাচনের আগেই সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দেশ পরিচালনায় অংশীদারত্বের দাবি সামনে আনেন এবং ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিচারপতি সাত্তারকে সরিয়ে তিনি ক্ষমতা দখল করেন। তবে এরশাদ সেদিনই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব না নিয়ে আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে এই পদে বসান। ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর তাঁকে সরিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপতি হয়ে বসেন।
এরপর ১৯৮৬ সালের ২৩ অক্টোবর প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের মাধ্যমে সেটাকে জায়েজ করেন। তত দিনে সামরিক আইন তুলে নেওয়া হয়েছে এবং সেই আইনে করা সব আদেশ–নির্দেশেরও বৈধতা দেওয়া হয়। জিয়াউর রহমানও সামরিক শাসনামলের সব অধ্যাদেশ পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জায়েজ করেন।
গণ–অভ্যুত্থানে নব্বইয়ের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগের আগ পর্যন্ত এরশাদ রাষ্ট্রপতি পদে বহাল ছিলেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মত্যেক্যের ভিত্তিতে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত হয় প্রথম অন্তর্বর্তী সরকার, যারা একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করে প্রশংসিত হয়। এই নির্বাচনে বিএনপি ১৪৬টি আসন পেয়ে জামায়াতের সহায়তায় সরকার গঠন করে।
আওয়ামী লীগ জোট ১০০ আসন নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯১ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত। ওই দিন বিএনপির মনোনীত প্রার্থী আবদুর রহমান বিশ্বাস নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনিই প্রথম ৫ বছরের মেয়াদ পূরণ করেছেন। তাঁর সময়ে একটি সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা হলেও সফল হয়নি।
আবদুর রহমান বিশ্বাসের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে রাষ্ট্রপতি হয়ে আসেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রপতি হতে রাজি না হলে তাঁর বাড়ির সামনে অনশন করবেন।’ প্রথম দিকে সরকারের সঙ্গে নানা বিষয়ে টানাপোড়েন চললেও কর্মসম্পর্ক মোটামুটি ভালো ছিল। কিন্তু ২০০১–এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। আওয়ামী লীগের অভিযোগ, রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশন ও লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে মিলে আওয়ামী লীগকে হারিয়েছেন। তারা নির্বাচন বাতিল করতে তাঁকে চাপও দিয়েছিলেন। কিন্তু সাহাবুদ্দীন আহমদ রাজি হননি।
ওই বছরের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতি পদে বহাল ছিলেন। একই দিন বিএনপির মনোনীত প্রার্থী বদরুদ্দোজা চৌধুরী নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বিরোধের কারণে ২০০২ সালের ২১ জুন তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। এরপর তিন মাস স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।
৬ সেপ্টেম্বর নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। তিনি ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই পদে বহাল ছিলেন। এরপর রাষ্ট্রপতি হন জিল্লুর রহমান। তাঁর মেয়াদকাল ছিল ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ২০ মার্চ।
এরপর সংসদের স্পিকার হিসেবে মো. আবদুল হামিদ মাত্র কয়েকদিনের জন্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং ২৪ এপ্রিল ২০১৮ থেকে ২৩ এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গভবনে একমাত্র তাঁর বিদায়্ই ছিল বর্নাঢ্য ও জাঁকজমনপূর্ণ। যদিও স্বাভাবিকভাবেই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী দলগুলোর কোনো নেতা সেই বিদায় অনুষ্ঠানে যাননি।
২০২৩ সালের ২৩ এপ্রিল নতুন রাষ্ট্রপতি হন মো. সাহাবুদ্দীন। এর আগে সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে যাদের নাম শোনা গিয়েছিল, তাদের মধ্যে সাহাবুদ্দীন ছিলেন না। কেন শেখ হাসিনা তাঁকেই মেনে নিয়েছিলেন, সেটা রহস্য বটে। সেই সময়ে মন্ত্রিসভায় যাঁদের নেওয়া হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগকে নিয়ে প্রশ্ন ছিল। আ হ ম মুস্তাফা কামাল মেয়াদের বেশির ভাগ সময় অনুপস্থিত থেকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এ রকম আরও অনেক বিস্ময় ছিল শেখ হাসিনার শাসনামলে। তবে সবচেয়ে বড় বিস্ময়টি দেখিয়েছেন তিনি ৫ আগস্ট দেশ ত্যাগ করে।
আমাদের সরকারগুলো রাষ্ট্রপতিকে কী ধরনের মর্যাদা দেয়, তার একটি উদাহরণ তুলে ধরেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান। বিএনপি সরকারের আমলে অর্থ মন্ত্রণালয় দুর্নীতির অভিযোগে একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে সরিয়ে দেওয়া এবং সেই পদে অপর একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ সম্বলিত প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠালে তিনি সেটি আটকে দেন। রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস ও অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের সম্পর্ক ভালো ছিল না। এই পটভূমিতে অর্থমন্ত্রী মন্তব্য করেন, তুমি কি মনে কর বঙ্গভবনের বাটঁকু লোকটি দেশ চালাচ্ছেন?
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কেবল প্রধানমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের প্রধানবিচারপতির নিয়োগ ব্যতীত অন্য সব কাজ করবেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ একবার বলেছিলেন, মিলাদ পড়া ও মাজার জেয়ারত করা ছাড়া তাদের কোনো কাজ নেই। বিএনপি সরকারের আমলে নির্বাচিত একজন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষা্ৎ করতে বঙ্গভবন থেকে রওনা হয়েছিলেন্, পরে তাঁকে রাষ্ট্রাচারের কথা বলে ঠেকানো হয়।
তবে সংবিধানে ত্রয়দশ সংশোধনী অর্থাৎ তত্ত্বা্বধায়ক ব্যবস্থা চালুর পর রাষ্ট্রপতি কিছুটা ক্ষমতাবান হন। ওই সময়ে রাষ্ট্রপতির হাতে প্রতিরক্ষা বিভাগ ন্যস্ত ছিলেন। প১৯৯৬ সালে প্রথম সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সশস্ত্র বাহিনিতে বিদ্রোহ দেখা দিলে রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস শক্ত হাতেই সেটি মোকাবিলা করেন। সেই সময়ের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি স্বেচ্ছায় ও স্বতোপ্রণোদিতভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কিন্তু ২০০৭ সালে ইয়াজউদ্দিন আহম্মদ সে রকম শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারেননি। তিনি সেনা নেতৃত্বের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে নিজেরন নেতৃত্বে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙে দেন এবং নতুন উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন।
সেই উপদেষ্টা পরিষদ হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের মতামত নিয়ে। এবারেও উপদেষ্টা পরিষদ হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নিয়ে। আড়াই মাসের মাথায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র জমা দেওয়া না দেওয়া নিয়ে বিতর্ক উঠেছে।
অনেকে মনে করেন, যেই প্রমানমন্ত্রী দেশত্যাগ করেছেন, তাঁর পদত্যাগ করা আইনি দৃষ্টিতে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। সোমবার বঙ্গভবন থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বিষয়টি মীমাংসিত বলে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু সেই বিবৃতির সঙ্গে বাস্তবতার যে কোনো মিল সেই গত কয়েক দিনের ঘটনাবলিই তার প্রমাণ।
অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম ‘রাষ্ট্রপতি থাকবেন কী থাকবেন না, এই প্রশ্নটি এই মুহূর্তে বাংলাদেশ আইনি বা সাংবিধানিক কোনো প্রশ্ন নয়। এটি একেবারেই একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ফলে রাজনৈতিক সমঝোতা এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে।’
সেই রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে কী সিদ্ধান্ত আসে সেটাই দেখার বিষয়।
prothom alo