অর্থনীতির দিক থেকে দুর্নীতিকে দেখা হয় আমলাতান্ত্রিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে। যদিও মনোবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান এটাকে নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক ব্যাধি হিসেবে দেখেছে।
হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের অধ্যাপক জোসেফ নাই ১৯৬৭ সালে আমেরিকান পলিটিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত ‘করাপশন অ্যাণ্ড পলিটিক্যাল ডিভেলপমেন্ট: এ কস্ট-বেনেফিট অ্যানালিসিস’ শীর্ষক আর্টিক্লে যখন উল্লেখ করেন: ‘বিশেষ করে একটা নতুন রাষ্ট্রে জনজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ঘুষ ও দুর্নীতি, যা আগাছার মতো সব ভালো গাছকে মেরে ফেলতে চায়; অথবা অন্য ভাষায় বলতে গেলে, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি মানুষের সদিচ্ছাকে নষ্ট করে এবং সমাজের জন্য কল্যাণকর সব নীতিকেও নস্যাৎ করে দেয়’, তখন তিনি কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও নিকোলো ম্যাকিয়াভালির ‘দ্য প্রিন্স’–এরই প্রতিধ্বনি করেন।
তবে দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব। উন্নয়নের গোড়ার দিকে একটা নতুন রাষ্ট্রে দুর্নীতি থাকলেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সুশাসনের অভাবজনিত সমস্যা বা গভর্ন্যান্স প্রবলেম আস্তে আস্তে দূরীভূত হয়। উন্নয়নের ইতিহাস সে কথাই বলে। তা ছাড়া অ্যাংলো-ডাচ দার্শনিক ও রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ বার্নার্ড ম্যান্ডভিল ১৭১৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘দি মিশ্চিফস দ্যাট অট জাস্টলি টু বি অ্যাপ্রিহেণ্ডেড ফ্রম এ হুইগ-গভর্নমেন্ট’ বইয়ে যেমন বলেছেন, ‘একজন দক্ষ ও সৎ রাজনীতিকের হাতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব পড়লে ব্যক্তির অসততাকে তিনি কখনো কখনো সমষ্টির জন্য হিতকর করেও তুলতে পারেন।’
ইউরোপের এইএমএফ-এর ফিসক্যাল আফেয়ার্স বিভাগের প্রধান মাওরো পাওলো ১৯৯৫ সালে অক্সফোর্ড কোয়ার্টালি জার্নাল অব ইকোনোমিকসের প্রকাশিত ‘করাপশন ও গ্রোথ’ শীর্ষক নিবন্ধে বাংলাদেশের উদাহরণ টানেন এবং উল্লেখ করেন যে দুর্নীতি কারণে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে তার বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি হারাচ্ছে। আর বিশ্বব্যাংক তাদের ২০০২ সালের প্রতিবেদনে মন্তব্য করেছে, বাংলাদেশে দুর্নীতি না থাকলে প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণ হতে পারত। অতএব বোঝাই যাচ্ছে, দুর্নীতি কারণে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশে ১৯৯১-২০০০ সময়কালে ৪.৬৮ শতাংশ, ২০০১-২০১০ সময়কালে ৫.৫৮ শতাংশ এবং ২০১২-২০১৯ সময়কালে ৬.৯৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা খুব বেশি বলা যাবে না, যেখানে ইথিওপিয়ার প্রবৃদ্ধির হার ২০১২-২০১৯ পিরিয়ডে ছিল ৯.২৫ শতাংশ।
মালায়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক নিয়াজ আসাদুল্লাহ, ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক আন্তনিও সাভোয়া ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহ্মুদ ২০১৪ সালে ওয়ার্ল্ড ডিভেলপমেন্ট-এ প্রকাশিত ‘পাথস টু ডিভেলপমেন্ট: ইজ দেয়ার এনি বাংলাদেশ সারপ্রাইজ?’ শীর্ষক নিবন্ধে দেখিয়েছেন কীভাবে এনজিও মানব উন্নয়নের সূচকে অবদান রেখেছে। এর মানে হলো, এনজিও কার্যক্রম ছাড়া শুধু সরকারি উদ্যোগে উন্নয়ন কতটা হতো, তা বলা মুশকিল। দুর্নীতি যেহেতু এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, দুর্নীতির কারণগুলো সরকার, সরকারপ্রধান ও সিভিল সোসাইটির জানা দরকার, বোঝা দরকার। দুর্নীতির কারণ জানা গেলে, এর প্রতিকারও বের করা সম্ভব। দুর্নীতির নানা কারণের মধ্যে যেসব কারণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের জন্য প্রযোজ্য, শুধু সেগুলোই এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।
দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক ও আমলা রাষ্ট্রীয় সম্পদ, এমন সব অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে নিয়ে যান, যেখানে তাঁদের অর্থ আত্মসাৎ করার সুযোগ থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা ও তাঁদের অদক্ষতার কারণে রাষ্ট্রকে প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার গচ্চা দিতে হচ্ছে।
মাত্রাতিরিক্ত রেগুলেশন বা আইন ও নিয়মকানুন দুর্নীতির একটা প্রধান কারণ। রেগুলেশন যত বেশি হবে, আমলাদের ঘুষ নেওয়ার তত বেশি সুযোগ সৃষ্টি হবে। বিশ্বব্যাংক ‘একটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো কতটা সহজ’—এ রকম একটা সূচক প্রতিবছর প্রকাশ করে, যা একটা দেশের সরকারি অফিসের আইনগত বাধ্যবাধকতা নির্দেশ করে। ‘করাপশন পারসেপ্শন ইন্ডেক্সে’ তথা দুর্নীতির মাত্রা মধ্যে এই সূচকও প্রতিফলিত।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সুশাসনের মান দিয়ে দুর্নীতির মাত্রা নির্ধারণ করে। সুশাসনের মান ভালো মানে, দুর্নীতির মাত্রা কম। ২০২১-এ সুশাসনের স্কোর ৮৮ নিয়ে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে ১ নম্বরে আর সুশাসনের স্কোর ৮৫ নিয়ে নরওয়ে, সিঙ্গাপুর, সুইডেনের অবস্থান ৪। পক্ষান্তরে, দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের অবস্থান যথাক্রমে ১৭৪, ১৫৪, ১৪৭, ১৪০ ও ৮৫। মালয়েশিয়া গত চার দশকে ব্যবসা-বাণিজ্যে অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে, সে দেশে এ সূচকের মান মাত্র ১২।
গবেষণায় দেখা গেছে, আমলাদের হাতে, এমনকি রাজনীতিবিদদের হাতেও বিবেচনা করতে পারার ক্ষমতা, অর্থাৎ ‘ডিসক্রিয়েশনারি পাওয়ার’ দেওয়া মানে তাঁদের দুর্নীতির করার সুযোগ করে দেওয়া। ক্ষমতাটা থাকতে হবে আইনপ্রণেতাদের হাতে, সংসদে ব্যাপক আলোচনা এবং এই আলোচনার আগে ও পরে সংসদীয় কমিটিকে সংশ্লিষ্ট সব পার্টির কথা শুনতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, আইনটি যদি গার্মেন্টস–সংক্রান্ত হয়, তাহলে পোশাকশ্রমিকদের মতামত নিতে হবে। গুনার মিরডাল তাঁর বিখ্যাত ‘এশিয়ান ড্রামা’ বইয়েও আমলাদের হাতে ডিসক্রিয়েশনারি পাওয়ার দেওয়াকে দুর্নীতির একটা কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
সরকারের আকার যত বড় হবে, দুর্নীতির সুযোগ তত বেশি হবে আর সরকারের ক্ষমতা যত বিকেন্দ্রীকৃত হবে, দুর্নীতির সুযোগ তত কমে যাবে। বিশেষ করে সরকারি ব্যয় বিভিন্ন স্তরে ভাগ হয়ে গেলে দুর্নীতি অনেকটাই কমে যাওয়ার কথা। এ বিষয়ের ওপর যত গবেষণা হয়েছে, তার প্রায় সব কটিরই উপসংহার মোটামুটি একরকম। সরকারের আকার ছোট হলে দুর্নীতি কমবে ঠিকই, তবে দেশে যদি গণতন্ত্র থাকে।
দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক ও আমলা রাষ্ট্রীয় সম্পদ, এমন সব অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে নিয়ে যান, যেখানে তাঁদের অর্থ আত্মসাৎ করার সুযোগ থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা ও তাঁদের অদক্ষতার কারণে রাষ্ট্রকে প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার গচ্চা দিতে হচ্ছে। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকও প্রায় একই মতো প্রকাশ করেছে। তাঁরা বলছেন, দুর্নীতির কারণে অনুৎপাদনশীল খাতে রাষ্ট্রের সীমিত সম্পদ চলে যাওয়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটা বিশাল অংশজুড়ে আছে সংবাদপত্রের তথা প্রেস ও মিডিয়ার স্বাধীনতা ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থার ওপর গবেষণা। প্রেস ও মিডিয়ার স্বাধীনতা ও একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ অসম্ভব। শ্রমের বাজারে, পার্লামেন্টে ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যান্য বিভাগে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ দুর্নীতি কমাতে সহায়তা করতে পারে।
দুর্নীতির সঙ্গে প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সম্পর্ক নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে অর্থনীতিতে ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। গণতন্ত্র মানব উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে, এটা অনেকটা প্রতিষ্ঠিত সত্যের মতো। সুশাসন একটা দেশের মাথাপিছু আয় বাড়াতে সাহায্য করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান যে অপরিহার্য, একাধিক গবেষণার ফলাফল এ কথা পরিষ্কার ঘোষণা করে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সংযোগ ও দুর্নীতি—এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় পারমিট, কন্ট্রাক্ট, লাইসেন্স ও সরকারি অফিসের কাজকর্ম হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হতে বাধ্য। কারণ, যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই বাজারে আছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষগুলো রাজনৈতিক সংযোগ না থাকা কারণে বঞ্চিত হতে পারে, আর যারা বাজারে নতুন ঢুকতে চাচ্ছে, তারা সিন্ডিকেটের কারণে ঢুকতেই পারবে না।
রাজনৈতিক দলের সঙ্গে করপোরেশনগুলো যে যুক্ত হতে চায়, তার বিরাট প্রণোদনা আছে। এর মধ্যে আছে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সুবিধা, যেমন সরকারি মালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠান পানির দরে সে কিনে ফেলবে, সে সহজেই ব্যাংকঋণ পেয়ে যাবে, অপেক্ষাকৃত কম করের বোঝা অথবা কোনো করই দিতে হবে না তাকে, সরকার তার বেলায় আইনগত বাধ্যবাধকতা উপেক্ষা করবে ইত্যাদি। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসাগুলো যে ফায়দা লোটে, এর একটা অংশ রাজনীতিকেরা নিজেরাই নিয়ে নেন।
আগেই বলা হয়েছে যে অর্থনীতি দুর্নীতিকে ব্যাখ্যা করে একটা আমলাতান্ত্রিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে। এর সমাধান হিসেবে তাই অর্থনীতিবিদেরা কিছু ইনস্ট্রুমেন্ট তথা ‘যন্ত্রপাতি’ স্থাপনের পরামর্শ দেন। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, রাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। গণতন্ত্র ও জবাবদিহি, সংসদে কার্যকর বিরোধী দলের উপস্থিতি, প্রেস ও মিডিয়ার স্বাধীনতা, ব্যক্তির বাক্স্বাধীনতা, সব মতবাদ প্রচার করার সমান সুযোগ, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন হচ্ছে সেই ইনস্ট্রুমেন্ট বা ‘যন্ত্রপাতি’। শুধু তা–ই নয়, পুলিশ বিভাগ ও তদন্ত সংস্থাগুলোকেও হতে হবে পুরোপুরি স্বাধীন। সংস্থাগুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়াও হতে হবে স্বচ্ছ ও পক্ষপাতহীন। না হলে দুর্নীতি দূর হবে না।
- ড. এন এন তরুণ ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। ইমেইল: [email protected]