- গোলাম মাওলা রনি
রাজকর্মের সাথে আমলাতন্ত্রের দুটো ইতিহাস রয়েছে। প্রথমটি বেসামরিক আমলাতন্ত্র, যা শুরু হয়েছিল চীন দেশে। দ্বিতীয়টি হলো সামরিক আমলাতন্ত্র, যা শুরু হয়েছিল অটোমান সাম্রাজ্যে। অন্যদিকে, আধুনিক বিচারব্যবস্থা রোম সাম্রাজ্যে শুরু হলেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে এবং বিকশিত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিচারপতি মার্শালের হাত ধরে। যারা প্রথম সংবিধান রচনা করেছিলেন কিংবা সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রসহ বিচারব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন, তারা তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। প্রথমত, ঐতিহ্যবাহী বংশ, শিক্ষা-মেধা এবং পরিশ্রম করার সর্বোচ্চ ক্ষমতা, বিরূপ পরিস্থিতিতে সততা, ন্যায়পরায়ণতার সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষমতা। ফলে প্রাচীন গ্রিক নগররাষ্ট্র থেকে শুরু করে ঐতিহ্যবাহী রোমান সাম্রাজ্য এবং চীন থেকে শুরু করে পুরো অটোমান সাম্রাজ্যে অবিচার, অনাচার এবং দুর্নীতির সাথে আমলাতন্ত্রের বেনজীর মার্কা কোনো ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না।
ইতিহাসের আমলাতন্ত্রে বেনজীর-আজিজদের মতো শত শত নয়, লাখ লাখ উদাহরণ তখনই সৃষ্টি হয়, যখন রাজনীতি কলুষিত এবং রাজসিংহাসনের কর্তারা ভালো-মন্দের পার্থক্য করতে পারেন না। দুষ্টের দমন-শিষ্টের পালনের মতো দৃঢ়তা না থাকলে কোনো শাসকের পক্ষে দুর্নীতিমুক্ত আমলাতন্ত্রের সেবা জনগণের জন্য অবারিত করা অসম্ভব। শাসক যদি নিজে দুর্নীতিমুক্ত এবং দুর্নীতি মোকাবেলায় দক্ষ ও অভিজ্ঞ না হন কিংবা দুর্বল চিত্তের মানুষ হন তখন শাসনকার্যে দুর্নীতি অনিবার্য হয়ে পড়ে। শাসকের বংশধারা, শিক্ষা-দীক্ষা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন এবং ব্যক্তিগত মেধা, যোগ্যতা ও নীতি-নৈতিকতার ওপর সুশাসন কতটা নির্ভর করে তার কিছু ঐতিহাসিক নমুনা পেশ করছি।
পাক ভারতে যিনি দুর্নীতির অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির মহানায়করূপে কুখ্যাতি অর্জন করেছেন তার নাম সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক। মানুষ হিসেবে তিনি অতিশয় ভালো ছিলেন- শিক্ষা-দীক্ষা-বংশ সব ক্ষেত্রেই ছিলেন শ্রেষ্ঠতর। কিন্তু ক্ষমতা লাভের পদ্ধতিটি সঠিক ছিল না। রাজদরবারের প্রভাবশালী আমির ওমরাহ এবং দিল্লির অভিজাতবর্গের চক্রান্তে তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে সুলতানরূপে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। তার কর্মচারীরা মনে করতে থাকেন যে, তারা কুকর্ম করে যদি সুলতানের প্রতিদ্বন্দ্বীদের শেষ না করতেন তবে সুলতানের পক্ষে ক্ষমতায় বসা সম্ভব হতো না। ফলে রাজদরবারে চক্রান্তকারীদের এক বিরাট সিন্ডিকেট তৈরি হয় এবং সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক সেই সিন্ডিকেটের পুতুলরূপে দুর্নীতির নিত্যনতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন।
ফিরোজ শাহ তুঘলকের জমানায় সারা ভারতবর্ষে দুর্নীতি এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, স্বয়ং সুলতান মাঝে মধ্যে নিজ কর্মচারীদের ঘুষ দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নিতে বাধ্য হতেন। ফলে তার শাসনামলে দুর্নীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, অনেকে এ কথা বলেও তামাশা করত যে, ঘুষ দিলে শাহী হেরেম থেকে শাহজাদীকেও ডাকুর দল অনায়াসে অপহরণ করে নিতে পারত।
ফিরোজ শাহ তুঘলকের বিপরীতে যদি দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের ইতিহাস খুঁজতে হয় তবে সবাই একবাক্যে বলবেন সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবনের নাম। তার জমানায় কোনো রাজকর্মচারী তো দূরের কথা- আমির-ওমরাহ, উজির, নাজির থেকে শুরু করে প্রধান সেনাপতি- কেউই ঘুষ লেনাদেনার কথা কল্পনাও করতে পারতেন না। সুলতানের স্ত্রী-কন্যা-পুত্র কিংবা নিকটাত্মীয়রা সর্বদা গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকতেন। আমির-ওমরাহরা রাজকর্ম ছাড়া পরস্পরের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ-দোস্তি ইত্যাদি করতে পারতেন না। এমনকি উজির-নাজিররা পরস্পরের ছেলে-মেয়ের সাথে বিয়েশাদীও দিতে পারতেন না। প্রভাবশালীরা যেন সিন্ডিকেট তৈরি করতে না পারে এ জন্য স্বয়ং সুলতান তার বিশাল সাম্রাজ্যের সব স্তরে তিন স্তরের নজরদারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রধান সেনাপতি যিনিই অপরাধ করেন না কেন, কেউই শাস্তি থেকে রক্ষা পেতেন না। প্রকাশ্য দরবারে চাবুক মারা থেকে শুরু করে শিরোশ্ছেদ ছিল সব অপরাধীর নিত্যনৈমিত্তিক শাস্তি।
সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবনের কঠোরতা এতটা নির্মম ছিল যে, তার জেরার মুখে প্রকাশ্য দরবারে অনেক মন্ত্রী ভয়ে প্রস্রাব করে দিতেন। তার কঠোর শাসনে দেশে শান্তি ও সমৃদ্ধি উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল। ভারত সীমান্ত আক্রমণ করার মতো বিদেশী শক্তি ছিল না। এমনকি দুর্ধর্ষ চেঙ্গিস খানের বংশধর মোঙ্গলরা বহুবার আক্রমণ করেও ভারত সীমান্তের এক ইঞ্চি অভ্যন্তরে ঢুকতে পারেনি। ঐতিহাসিকরা সুলতান বলবনের বহুমাত্রিক সফলতা এবং তার দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের নেপথ্যের কারণ হিসেবে তার বংশ মর্যাদা, শিক্ষা-দীক্ষা, অভিজ্ঞতা এবং একজন উত্তম শিক্ষকের কাছে রাজকর্ম হাতে-কলমে শিক্ষা নেয়ার যে কাহিনী বর্ণনা করেছেন তা যখন পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের শাসকের ক্ষেত্রে ঘটে- তখন সেখানেও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা অনিবার্যভাবে জনগণের নসিবে জুটে যায়
আলোচনার এই পর্যায়ে সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবন সম্পর্কে সংক্ষেপে বলে আজকের শিরোনাম প্রসঙ্গে চলে যাব। গিয়াস উদ্দিন বলবন পারস্যের বিখ্যাত ইলখানি রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন। মধ্যযুগের নির্মম বাস্তবতায় তিনি বিদেশী আক্রমণকারীদের কাছে শৈশবে বন্দী হয়ে মধ্য এশিয়ার দাস ব্যবসায়ীদের হাতে পড়েন এবং বেশ কয়েকবার এ-হাত ও-হাত হয়ে একজন ভালো দাস ব্যবসায়ীর হাতে পড়েন, যিনি বাজার থেকে উঁচু বংশীয় শিশু দাসদের ক্রয় করতেন এবং তাদের তৎকালীন দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা শিক্ষায় শিক্ষিত করে পরবর্তীতে পৃথিবীর কোনো নামকরা রাজা-বাদশাহ-সম্রাটদের কাছে অতি চড়া দামে বিক্রি করতেন।
সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবনের মালিক ৪০ জন দাসকে একত্রে লালন পালন করে সর্ব শিক্ষায় শিক্ষিত করে ভারতবর্ষে সুলতান ইলতুৎমিসের দরবারে নিয়ে আসেন এবং কাক্সিক্ষত মূল্যে সবাইকে বিক্রি করেন। দিল্লির রাজপ্রাসাদে অতি অল্প সময়ের মধ্যে বলবন তার মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে সুলতানকে মুগ্ধ করেন। সুলতান তাকে রাজকীয় রক্ষীবাহিনীর (আজকের বাংলাদেশের এসএসএফ বা পিজিআর) প্রধান হিসেবে নিয়োগ দান করেন। এরপর বলবনকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ভাগ্য পরিশ্রম সততা এবং যোগ্যতা তার জীবনে যে রসায়ন তৈরি করেছিল যা কি না বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে তাকে এক অনন্য মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সম্মানিত পাঠক, হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, আমলাতন্ত্র দুর্নীতি এবং বেহাল রাজনীতির সাথে দুর্নীতিপরায়ণ শাসক ফিরোজ শাহ তুঘলক কিংবা কিংবদন্তির সুশাসক গিয়াস উদ্দিন বলবনের কী সম্পর্ক! অথবা চলমান পৃথিবীর দুর্নীতির সাথে ইতিহাসের হাজার বছরের পুরনো ঘটনার কী সম্পর্ক। আপনাদের মনে যদি এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, তবে আমি বলব যে, মানবসভ্যতার ইতিহাসে যেদিন থেকে রাজনীতি শুরু হয়েছে সেদিন থেকেই ভালো-মন্দের দুটো সূত্রের অধীনে সব কিছু হয়েছে। সুশাসন বা কুশাসন অথবা অপশাসনের প্রথম সূত্র হলো, সর্বোচ্চ ব্যক্তি যদি অযোগ্য দুর্নীতিপরায়ণ এবং চরিত্রহীন হন তবে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী একটি রাজতন্ত্র-রাজপরিবার, শাসনতন্ত্র বা বিচার বিভাগ কয়েক দিনের মধ্যে নিকৃষ্টতম নজির স্থাপন করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি অনিয়ম অবিচার ইত্যাদি সুনামি ভূমিকম্প কিংবা অগ্ন্যুৎপাতের মতো দৈব দুর্ঘটনার ন্যায় দেশ জাতির ঘাড়ের ওপর পতিত হয়।
আপনি যদি রোমান সম্রাট নিরো, উমাইয়া শাসক ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া অথবা সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালিকের ইতিহাস পড়েন তবে দেখতে পাবেন, তারা তাদের পূর্বসূরিদের কাছ থেকে যে চমৎকার একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজসিংহাসন এবং রাজভাণ্ডার পেয়েছিলেন তা কলুষিত করার জন্য তাদের সময় লেগেছিল মাত্র ২৪ ঘণ্টা এবং সারাটি জীবন ধরে তারা সেই কলুষিত রাজনীতি এতটা বেপরোয়াভাবে চালিয়েছিলেন যা তাদের চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় এবং তাদের নামগুলোকে কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের অভিশাপের বিষয়বস্তুতে পরিণত করে।
উল্লিখিত উদাহরণের বিপরীতে আপনি যদি মরুঝড় কিংবা বজ্রপাতের গতিতে রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস খোঁজেন তবে ভারতবর্ষের ইতিহাসে যেতে হবে না- বাংলার ইতিহাস ঘাঁটলে শত শত উদাহরণ পেয়ে যাবেন। শশাঙ্ক, গোপাল, ধর্মপাল, আলাউদ্দিন হুসেন শাহ, গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ, শায়েস্তা খান থেকে শুরু করে মুর্শিদ কুলি খান, আলিবর্দী খানের ক্ষমতা লাভ এবং মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রশাসনের সর্বস্তরে কিভাবে সুশাসন নিশ্চিত হয়েছিল- তা জানলে ইতিহাসের পাঠকরা রোমাঞ্চিত না হয়ে পারবেন না। কাজেই মাথা যদি ঠিক থাকে তবে শরীরের বাকি অংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সঠিক অবস্থায় সঠিকভাবে কাজকর্ম করতে পারে। আর মাথা যদি পচে যায় তবে বাকি অঙ্গে পচন মহামারীরূপে ছড়াতে খুব বেশি সময় নেয় না।
রাজনীতির উপরোক্ত সূত্রের বাইরে এমন ঘটনাও বহুবার ঘটেছে যখন একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের কবলে পড়ে দুনিয়ার সর্বকালের সেরা রাষ্ট্রনায়ক নির্মম পরিণতি ভোগ করেছেন। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত দুর্নীতি, অনিয়ম বিশৃঙ্খলা, অবিচার, অনাচার যখন ফুলে ফলে শোভিত হয়ে একটি দেশ-জাতির অপরিহার্য পেশায় পরিণত হয়, তখন সেই জমানাকে বলা হয় আইয়ামে জাহেলিয়াত এবং সেই জাহেলিয়াতের কবলে পড়ে অনেক মহামানবকে নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে। এ জন্য যারা সত্যিকার রাজনীতিবিদ তারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে কোনো অবস্থায় কলুষিত হতে দেয় না। তারা আমলাতন্ত্রের আদি ও অকৃত্রিম নীতিমালা অনুসরণ করে যোগ্য লোককে যোগ্য পদে নিয়োগ দান করে এবং আমলাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভুলভ্রান্তিও ক্ষমা করে না। ফলে দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রে একটি বিধিব্যবস্থা গড়ে ওঠে যার ওপর ভিত্তি করে গণতন্ত্র রাজতন্ত্র স্বৈরতন্ত্র যে নামেই ডাকা হোক না কেন, রাজনীতি একটি শ্রেষ্ঠতম কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। ফলে ক্ষেত্রবিশেষে দুর্বল ও অযোগ্য লোক সিংহাসনে বসলেও সুন্দরতম বিধিব্যবস্থার কারণে সুশাসন বাধাগ্রস্ত হয় না।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
Nayadiganta