আমরা কেমন পরিবর্তন চেয়েছিলাম

জুলাই–আগস্টের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসের এক বাঁকবদল

ক্রিকেটীয় স্কোরের মতো বললে বলতে হয়, স্বৈরশাসন অবসানের পর আজ প্রথম অর্ধশত দিন পার হচ্ছে। তবে এই দিনগুলো এতটাই ঘটনাবহুল ও ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে গেছে যে আমাদের অনেকেরই স্মৃতি ঝাপসা হতে শুরু করেছে। স্মৃতি ঝাপসা হতে শুরু করলে অবশ্য অনেকেই অতি সহজে বলতে পারেন, আমরা কি এমন পরিবর্তন চেয়েছিলাম?

জুলাই-আগস্টের অশান্ত দিনগুলোতে শেখ হাসিনার ক্ষমতা ধরে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টার যে নৃশংস রূপ প্রকাশ পেয়েছে, তার পূর্ণ চিত্র এখনো প্রকাশ পায়নি। বগুড়ার শিশুশিক্ষার্থী জুনায়েদ ইসলাম রাতুল মৃত্যুর সঙ্গে ৪৮ দিন লড়ে গত সোমবার শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছে। আরও যে তিন শতাধিক আহত এখনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে, তারা সবাই বাড়ি ফিরবে কি না, কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তাদের দায়িত্ব গ্রহণের আগের তিন দিন দেশে সরকার কীভাবে চলেছে, তা অনেকটাই অজানা। ক্ষুব্ধ জনতার রোষ প্রথমেই যাদের ওপর পড়েছে, তারা হলো পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী।

সারা দেশের ৬৩৯টি থানার মধ্যে অন্তত ৪৫০টি ‘আক্রান্ত’ হয়েছিল বলে জানিয়েছিল বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন। আত্মরক্ষার জন্য পুলিশ অস্ত্র ফেলে ও পোশাক বদলে পালিয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য চাইলেও কাউকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল না। সেনাবাহিনীর উপস্থিতি মানুষের মধ্যে আস্থা ফেরাতে সহায়ক হয় বটে, তবে তাদের দিয়ে পুলিশের কাজ সম্ভব নয়। একই কথা চলে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির বেলায়ও।

পুলিশের কাজে যারা সব সময়ে সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালনে অভ্যস্ত, সেই আনসাররাও বলতে গেলে সরকারের বিরুদ্ধে একরকম বিদ্রোহ করে বসল। তখনো অন্তর্বর্তী সরকার তাদের দুই সপ্তাহে পুরোপুরি সচল হতে পেরেছে বলা যায় না। আনসার বিদ্রোহ সামাল দেওয়ার মধ্যেই দেশের এক বিরাট অংশ আকস্মিক বন্যায় তলিয়ে গেল।

বন্যার জন্য পূর্বসতর্কতা না দেওয়ার অভিযোগ, সীমান্তে দুই দিনের ব্যবধানে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে দুজন কিশোর-কিশোরীকে হত্যা এবং ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনার রাজনৈতিক তৎপরতার বিষয়গুলো নিয়ে শুরু হয় বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে কূটনৈতিক টানাপোড়েন। এই কূটনৈতিক টানাপোড়েনে অব্যাহত উসকানি চলতে থাকে উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টায়।

দেশের ভেতরেও অস্থিরতার কোনো শেষ নেই। ন্যূনতম মজুরির দাবিকে বিগত বছরগুলোতে কীভাবে দাবিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা আমরা সবাই জানি। এখন সভা-সমাবেশের সুযোগ তৈরি হওয়ায় অনায়াসেই শ্রমিকেরা মিছিল করছেন, রাস্তা অবরোধ করছেন। এমনকি সরকারি চাকুরে অডিটররাও এখন ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় অবরোধ তৈরি করতে পারছেন। এত কিছুর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘটে গেছে গুরুতর সহিংসতা। সব অস্থিরতাই যে স্বতঃস্ফূর্ত, তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। প্রশাসনের অস্থিরতায় অনেকেই অতীত সরকারের অনুসারী ও সুবিধাভোগীদের ভূমিকার আলামত দেখছেন।

সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তরকালের নিষ্ঠুরতম নৃশংসতার কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছুই জনরোষ ও প্রতিশোধপরায়ণতার শিকার হয়। আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন ও সংশ্লিষ্টতার কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকেই আক্রান্ত হন। আবার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও পুলিশের অনুপস্থিতির কারণে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ও বিরোধের জের এবং সহায়–সম্পদ কেড়ে নেওয়ার লোভেও সংখ্যালঘুদের অনেকে সহিংসতার শিকার হন। কিন্তু ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে অতিরঞ্জন ও অপপ্রচার এমন মাত্রায় পৌঁছায় যে শীর্ষস্থানীয় বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমগুলো সরেজমিনে পরিস্থিতি যাচাই করতে এসে বরং ভারতীয় উগ্রপন্থীদের অপপ্রচারকেই তুলে ধরে।

স্মরণ করা যেতে পারে, বছরখানেক আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবির মুখে বলেছিলেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এক রাতেই আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেবে।

তিনি বলেছিলেন, ‘তারা বলে, ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের কোনো ক্ষতি হবে না। কী সুন্দর কথা! এমনিতেই তারা আমাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। ক্ষমতায় এলে বাকিটা এক রাতের মধ্যেই শেষ করে দেবে।’ ওবায়দুল কাদেরের আগে অন্য আরেক রাজনীতিক আরও ভয়াবহ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী (বীর উত্তম) ২০২২ সালের ২৩ মার্চ বলেছিলেন, ‘আমি আজ চিন্তিত যে এ সরকার চলে গেলে বিএনপি ক্ষমতায় এলেই বঙ্গবন্ধু সরকারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তালা লাগানো হবে। যারা ওখানে আছে, তাদের ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া হবে। তারেক রহমান ক্ষমতায় এলে পাঁচ লাখ লোক এক দিনে মারা যাবে।’

আওয়ামী লীগ যতটা শেষ হয়েছে, তা রাতে নয়, দিনেই হয়েছে এবং দলীয় প্রধানের নিষ্ঠুরতার নীতি ও পলায়নের কারণে হয়েছে। দলটির অবশেষ কতটুকু আছে বা থাকবে, তা ভবিষ্যৎই বলবে। কাদের সিদ্দিকী হয়তো বলবেন, তারেক তো এখনো ক্ষমতায় আসেননি। কোনো হত্যাকাণ্ডই সমর্থনযোগ্য নয় এবং প্রতিটি হত্যা, হামলা ও লুটপাটের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হতে হবে।

তবে ‘শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই’ তত্ত্ব প্রচারকারী ব্যক্তিরা তাঁর পদত্যাগে যে বীভৎস পরিস্থিতির ভয় দেখিয়েছিলেন, তা যে ঘটেনি, সে কারণে অবশ্য কারোরই স্বস্তি প্রকাশের অবকাশ নেই। বরং ৫ আগস্টের পরিবর্তনকে ইতিবাচক পরিণতি, অর্থাৎ পূর্ণ গণতন্ত্রে উত্তরণের দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনে এখনই আইনের শাসন নিশ্চিত করায় আরও মনোযোগী হওয়া দরকার। সব হত্যা, সব অন্যায়ের বিচার নিশ্চিত করায় মনোনিবেশ করতে হবে।

আমাদের রাজনীতির একটি বড় অংশের মধ্যে সহিংসতা অনেক দিন ধরেই মজ্জাগত হয়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসও তা থেকে মুক্ত নয়। দুর্ভাগ্যের কথা হলো ক্যাম্পাসের হত্যাকাণ্ড বা নৃশংসতারও কোনো বিচার হয় না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি ছাড়া যে দলগুলো কখনো ক্ষমতায় যায়নি, সেসব দলের সহযোগী ছাত্রসংগঠনও এ সহিংসতা থেকে পিছিয়ে নেই। তবে সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে গত ১৫ বছরে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য।

স্বাধীনতার পর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৫১ জন শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। ২০১৯ সালের হিসাবে, আওয়ামী লীগের টানা ১০ বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত হয়েছেন ২৪ জন শিক্ষার্থী (লাশ ও খুনি তৈরি করা ছাত্ররাজনীতি, সোহরাব হাসান, ১২ অক্টোবর ২০১৯)। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা আর এর পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না।

প্রশ্ন উঠেছে, শিক্ষাঙ্গন এখন ছাত্রলীগমুক্ত হওয়ার পরও কেন এমন নিন্দনীয় অঘটন দেখতে হবে? এ প্রশ্ন সবারই। কিন্তু কারও কারও প্রশ্নের সুর ও ধরন শুনে মনে হয়, তাঁরা অতীতে ফিরে যেতে চান, বলতে চান ‘আগেই ভালো ছিলাম’। আসলে আমাদের সবার ইতিহাসের দিকে তাকানো উচিত।

যদি শুধু জুলাইয়ের আন্দোলনের পরিসংখ্যান দেখা হয়, তাহলেও দেখা যাচ্ছে জুলাইয়ের ১৫ তারিখ থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে নিহতের সংখ্যা সরকারি হিসাবেই ৭ শ ছাড়িয়েছে, বেসরকারি হিসাবে তা দ্বিগুণ—১ হাজার ৪২৩। আর ৫ তারিখের পর থেকে আগস্টের ২৬ দিনে সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ঢাকা ট্রিবিউন–এর হিসাবে ২৮৬। আবারও বলি, একটি মৃত্যুও গ্রহণযোগ্য নয় এবং তার বিচার হতে হবে। কিন্তু একই সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ আগের নজিরবিহীন নৃশংসতার কথাও ভোলা যাবে না। ১৫ বছরের শত শত গুম, খুন ও জেল-জুলুমের কথাই–বা কীভাবে বিস্মৃত হই?

‘এমন পরিবর্তন কি চেয়েছিলাম’ প্রশ্ন করার আগে আমাদের আরও স্মরণ করা দরকার যে স্বৈরশাসকের দোসরদের অর্থনৈতিক অপরাধ ও মহাদুর্নীতিতে আপাতত ছেদ পড়েছে। এই ছেদের স্থায়িত্ব কত দিন, তা হয়তো বলা সম্ভব নয়। কিন্তু বিদেশে পাচার হওয়া দুই লাখ কোটি টাকার কিছুটা হলেও যেন উদ্ধার হয়, ঋণের নামে দেশের ব্যাংকগুলো খালি করে ফেলা লুটেরাদের কাছ থেকে বকেয়া আদায় হয়, সেই চেষ্টা তো করা দরকার। সর্বোপরি ভোটের অধিকার ফেরানোর লড়াইকে পূর্ণতা দেওয়ার যে সুযোগ এসেছে, তা কি হাতছাড়া করা সমীচীন হবে?

prothom alo