- মইনুল হোসেন
- ০২ আগস্ট ২০২১
ব্রিটিশ দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এডমন্ড বার্ক যথার্থই বলেছেন, ‘ভালো মানুষদের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগেই অপশক্তি মাথা তুলে দাঁড়ায়’। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ আমাদের অনেকে কোনো না কোনোভাবে বলছেন, বাঙালি হিসেবে আমরা আধমরা। বঙ্গজননীর উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আমাদের বাঙালি করে রেখেছে, মানুষ করেনি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের সাহসী, বিদ্রোহী বাঙালি করতে চেয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। আমরা মিথ্যা অহঙ্কার করতে অভ্যস্ত রয়ে গেলাম। আধমরাও থেকে গেলাম।
দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে; কিন্তু সিভিল সোসাইটি কোনো ভূমিকা রাখছে না। অথচ যে কোনো সভ্য ও শিক্ষিত সমাজে জনস্বার্থ রক্ষায় তারাই বলিষ্ঠ শক্তি। বলছি না যে তাদের রাস্তার আন্দোলনে নামতে। অনিয়ম-অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের ঐক্যবদ্ধ চিন্তাশীল প্রতিবাদ থাকতে হবে। সবাই মিলে যে ভয়াবহ নৈরাজ্যের দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছি তা আমরা দেখেও দেখছি না। জনজীবনের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। সীমাহীন ক্ষোভ ও হতাশা জমছে জনমনে।
এদিকে শাসনের নামে বিনা বিচারে জনগণকে পাঠানো হচ্ছে কারাগারে। নিছক সন্দেহের বশে পুলিশ ইচ্ছামতো সাধারণ মানুষকে জেলে পাঠাচ্ছে। কোর্ট-আদালতও চাপের মুখে পুলিশ ও সরকারি উকিলদের ব্যাঘ্র মনোভাব দেখে অন্যান্য সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের সঙ্গে অভিযুক্তদের জেলে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন যদিও আইনের চোখে তাদের কোনো দোষ প্রমাণিত হয় নাই। প্রয়োজনও নাই। এটা করা না হলে তারা ভয় করছেন সরকার বলবে অপরাধ মোকাবেলায় কোর্ট সহযোগিতা করছে না। কিন্তু সন্দেহের বশে জেলে পাঠানোর নাম অপরাধ বা অপরাধীদের মোকাবেলা নয়। অপরাধ প্রতিরোধ অর্থ হচ্ছে অপরাধ না হতে দেয়া।
যখন কোনো লোককে অপরাধী সন্দেহে গ্রেফতার করা হয় তখন আইন তাকে দুটি সুযোগ দেয়। প্রথমটি জেল হেফাজতে থাকার অর্থাৎ কারাবরণ। অন্যটি জুডিশিয়াল হেফাজতে থাকার সুযোগ। সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মতো তাকে জেলে সাজা ভোগ করতে হয় না, সে কোর্টের খবরদারিতে থাকে। কোর্টে আসেই মানুষ বিচারের জন্য কান্নাকাটি করতে। তখনো তাকে সংযত থাকতে হয়; যাতে তাদের কান্নার ভাষা অন্যদের অস্বস্তির কারণ না হয়।
জামিনে থাকা লোকটি মুক্ত নয়, কোর্টের হেফাজতে থাকতে হয় তাকে। জামিনের শর্ত মেনে চলতে হয়। কিন্তু নির্দোষ হিসেবে তার মানবিক অধিকারসমূহ রক্ষা পায়।
জনগণ আজ এক ভয়াবহ সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে, এ সঙ্কট যে কেবল মহামারীজনিত কারণে সৃষ্টি হয়েছে তা নয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা বা দলীয় লোকদের ক্ষমতার অপব্যবহারের বাড়াবাড়ি। জনজীবনে দুঃখ-দুর্দশা বেড়েই চলেছে। আয়-উপার্জনের পথ সীমিত হয়েছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে জনগণের অবাধ চলাচল বন্ধ করতে লকডাউন প্রয়োজন। কিন্তু শত শত লোককে জেলে পাঠিয়ে তো এর সমাধান মিলবে না। অন্যান্য দেশেও লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে, সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু মানুষকে জেলে ঢোকানোর একটি সুযোগ হিসেবে লকডাউনকে ব্যবহার করা হয়নি।
মাদক ব্যবসা জেঁকে বসেছে, প্রতিদিন শতাধিক যুবককে জেলে পাঠানো হচ্ছে। মনে হচ্ছে না কেউ তাদের পরিবার সম্পর্কে কিংবা ভয়ঙ্কর মহামারী প্রতিরোধ নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা করছে। এর মধ্যে ড্রাগ ব্যবসার বিস্তার ঘটেই চলছে কিন্তু সঙ্কট সৃষ্টিতে সরকারের ভূমিকা নিয়েও আমরা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি না। মাদকদ্রব্য কিভাবে দেশে ঢুকছে তা আমাদের অজানা নয়, তেমনি এটাও ভুল নয় যে, বিষয়টির উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই।
দেশে অনেকগুলো এজেন্সি রয়েছে, যারা দুর্নীতি ও অপরাধ নিয়ে কাজ করে থাকে। কিন্তু জনগণ দুর্নীতি ও অপরাধের শিকার হয়েই চলেছে। কে দুর্নীতির পক্ষে আর কে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বোঝা মুশকিল। একের সঙ্গে অপরের কিরূপ সহযোগিতা আছে তা কারও জানার কথা নয়। জনগণ তো দেখছে তারা সবার কাছে অসহায়।
সংবাদপত্র-গণমাধ্যম পদানত ও বশীভূত থাকা সত্ত্বেও উঁচু তলার অপরাধ ও দুর্নীতি কারও জানতে বাকি থাকছে না। এ নিয়ে হয়রানির বিরুদ্ধে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল উদ্বেগ প্রকাশ করলেও আমাদের সার্বভৌম সরকার বলছে, ওসব তথ্য বানোয়াট। একজন অন্ধ মানুষও ভাবে না যে অন্য সবাই অন্ধ।
এটাও সবার দেখার বিষয় যে, পুলিশকে অতিরিক্ত বোঝা বহন করা লাগছে, যেসব সমস্যার সমাধান করতে রাজনৈতিক নেতাদের রাজনৈতিক যোগ্যতা ও চিন্তা-ভাবনার দরকার সেসবও দেখতে হচ্ছে পুলিশকে। এই পুলিশি সমাধানের কারণে জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের ক্ষোভ বেড়েই চলেছে। রাজনীতি শেষ করার ফলে রাজনৈতিক সহযোগিতাও শেষ হয়েছে। রাস্তায় চলাচল করা সর্বত্রই বিপজ্জনক। সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার অভাবে মানুষ জীবন হারাচ্ছে, দুর্ঘটনার চেয়ে সঠিক চিন্তা-ভাবনার অভাবই বেশি দায়ী। বায়ুদূষণের পরিমাণ সীমা ছাড়িয়ে গেছে। শতকরা ৮০ ভাগ ট্রাফিক পুলিশ শ্বাসকষ্টে ভুগছেন।
কারাগারে কয়েদিদের মধ্যেও কোভিড-১৯-এর রোগীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। মানুষ যে সহজ সময় পার করতে ঘরের বাইরে যায় না, এটা পর্যন্ত আমরা বুঝতে চাই না। আর্থিক সঙ্কট তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে বাধ্য করে। এই দুর্যোগকালে সরকার কখন তার দক্ষতা ও কার্যক্রম কিভাবে বাড়াবে, তা নিয়ে কেউ ভাবছেন না। কারণ মনে হচ্ছে সরকার চূড়ান্ত অচলাবস্থায় এসে পড়েছে।
মহামারীর কারণে সৃষ্ট আর্থিক সঙ্কটে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের একটা অংশকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে এখনো যাদের চাকরি আছে; তারাও ফিরে যেতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জোগাড় করতে গিয়ে যন্ত্রণা ভোগ করছেন। অতিরিক্ত পারিশ্রমিক লাভের ব্যাপারটি স্বাভাবিক আছে।
ইয়াবা অথবা অন্য ড্রাগস সমস্যার সমাধান পেতে বেকার তরুণ বহনকারীদের ধরে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। চিন্তা-ভাবনা ছাড়া দারিদ্র্যপীড়িত বেকার যুবক অনেককে এভাবে জেলে পাঠিয়ে সমস্যাকে আরো সঙ্গিন করে তোলা হচ্ছে।
গোষ্ঠীস্বার্থ সংরক্ষণ করে সরকার নিরাপদে ক্ষমতায় আছে। তাদের কোনো চিন্তা নেই। আইনজীবীদের একটা বড় অংশ আর্থিক কষ্টে আছেন। পরিকল্পনা নিতে পারলে তাদের জন্য কিছু করা সম্ভব ছিল। কোর্টে এখন যেসব মামলা হচ্ছে তার বেশির ভাগই জামিন সংক্রান্ত মামলা। এসব মামলার সঙ্গে আইনের তো তেমন সম্পর্ক নেই। কোর্টের সুবিবেচনাই শেষ কথা। এক্ষেত্রে পেশাজীবী হিসেবে আইনজীবীদের তেমন কিছু করণীয় নেই।
আমরা একটা হৃদয়হীন জাতিতে পরিণত হচ্ছি। অন্যের দুঃখ-কষ্টে সাড়া দেয়ার সময় আমাদের নেই। জনজীবনের এটাই সাধারণ ছবি। বেসরকারি সাহায্যের প্রস্তাব পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এটা সংগঠিত করা সহজসাধ্য নয়। বিচ্ছিন্নতা বিরাজ করছে সর্বত্র।
সর্বব্যাপী হতাশা ও অন্যায়কারীদের অপরাধ ও অবিচার সত্ত্বেও আমাদের ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা মানবতার সেবায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন। আত্মরক্ষার জন্য অপরিহার্য উপকরণাদি না পাওয়া সত্ত্বেও ঝুঁকি নিয়ে তারা সেবার কাজে নিবেদিত রয়েছেন। তারাই মহৎপ্রাণ মানুষ।
সবকিছু মিলিয়ে দেখলে এটাই সত্য যে, আমরা আধমরাই থেকে গেলাম। স্বাধীনতা বা ন্যায়বিচার তো আধমরাদের বিষয় নয়। কিছু লোকের মিথ্যা অহঙ্কারও তাদের কিছু যায় আসে না।
দেশের শিক্ষিত সমাজ বা সিভিল সোসাইটির এতটুকু বলার সাহস থাকতে হবে যে, জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকারসমূহের প্রতি সরকারকে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। দেশ যে জনগণের তা মানতে হবে। শিক্ষিত-সচেতন লোকদের প্রতিবাদী ভূমিকা থাকতে হবে। জনসমাগম করে অন্যদের রাস্তার আন্দোলন অনেক দেখেছি। এই বিশ^াস বারে বারে ব্যক্ত করে এসেছি যে, সুস্থ চিন্তার একটি সুন্দর ও সুখী দেশ গড়ার মতো যোগ্য, জ্ঞানী-গুণী লোক আমাদের মধ্যে রয়েছেন। মিথ্যা অহঙ্কার নিয়ে গর্ব করার প্রয়োজন নেই। নিজেদের গর্ব আমরা নিজেরাই অর্জন করতে পারি।
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী,
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট