আমন মৌসুমের ধান কাটা-মাড়াই প্রায় শেষের দিকে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এ বছর আমনের উৎপাদন আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বাজারে আমনের চাল সরবরাহও হচ্ছে ডিসেম্বরের শুরু থেকে। এ সরবরাহ পুরোদমে থাকলেও এখন মিল, পাইকারি ও খুচরা—প্রায় সব পর্যায়ে চালের দাম বাড়ছে। শুধু পাইকারিতেই গত এক সপ্তাহে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৪-৬ টাকা।
দেশে মোট চাল উৎপাদনের ৪০ শতাংশ হয় আমন মৌসুমে। চলতি আমন মৌসুমে প্রায় ১ কোটি ৭১ লাখ ৭৮ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। মোট ৫৮ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে এ বছর ধানের আবাদ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কাটা হয়েছে ৫৭ লাখ ২৭ হাজার হেক্টর বা সাড়ে ৯৭ শতাংশ জমির ধান। এখান থেকে চাল উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ ৯৩ হাজার টন। গড় ফলন হয়েছে হেক্টরপ্রতি ২ দশমিক ৯৮ টন। গত বছরের শেষ দিকে পোকামাকড় এবং ঘূর্ণিঝড় মিধিলি ও মিগজাউমের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমির ধান। সে হিসেবে কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার প্রায় ১ কোটি ৭৪ লাখ টন চাল উৎপাদন হওয়ার কথা রয়েছে। এ অনুযায়ী এবার আমনে উৎপাদন দাঁড়াতে যাচ্ছে রেকর্ড সর্বোচ্চে।
রেকর্ড উৎপাদনের দাবি করা হলেও বাজারে এখন আকস্মিকভাবেই দাম বাড়ছে চালের। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েকদিনে বিভিন্ন চালে প্রতি কেজিতে প্রায় ৪-৬ টাকা বেড়েছে। তিন-চারদিন আগেও এখানে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ব্রি-২৮ চাল ২ হাজার ২৫০ থেকে ২ হাজার ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫৫০ থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকা। প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২৫০ থেকে ৩ হাজার ৩০০ টাকায়। কয়েকদিন আগে যার দাম ছিল ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০ টাকা। স্বর্ণা ও পাইজাম চালেও দাম বেড়েছে কেজিতে ২-৩ টাকা। আর প্রতি কেজি নাজিরশাইল মানভেদে ৬৫-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা কয়েকদিন আগেও ছিল ৬২-৭৫ টাকা।
কারওয়ান বাজারের চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রিয় রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মো. লোকমান হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত কয়েকদিনে চালের দাম প্রতি বস্তায় ২০০-৩০০ টাকা বেড়েছে। সাধারণত বোরো মৌসুমের চাল বাজারে আসার আগে চালের দাম বাড়ে। কিন্তু এবার হঠাৎ করে আমনের ভরা মৌসুমেই মিল পর্যায়ে চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে। মিলগেটে আমাদের চাল কিনতে হচ্ছে কেজিতে ৪-৬ টাকা বেশি দামে।’
অস্থিরতা বাড়ছে দেশের চালের সবচেয়ে বড় মোকাম নওগাঁ জেলায়। এক মাসের ব্যবধানে জেলার মোকামগুলোয় পাইকারি পর্যায়ে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ২-৩ টাকা। জেলাটিতে আরো এক সপ্তাহ আগেই আমন ধান কাটা-মাড়াই শেষ হয়েছে। ভরা মৌসুমে আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধিতে সিন্ডিকেটের কারসাজি রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন স্থানীয়রা। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দাবি করছেন তারা।
চালের মূল্যবৃদ্ধিতে শঙ্কায় পড়ে গেছেন নওগাঁর স্থানীয় স্বল্প আয়ের মানুষেরা। খুচরা বাজারে চাল কিনতে আসা রিকশাচালক ছোলায়মান সরদার বলেন, ‘নির্বাচনের কারণে এমনিতেই রাস্তাঘাটে মানুষ কম বের হয়েছে। তাই গত মাসের তুলনায় দৈনিক আয় কমেছে অন্তত ১০০ টাকা। এর মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্যের পাশাপাশি চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকলে গরিব মানুষরা না খেয়ে মরবে।’
জেলার খুচরা ব্যবসায়ীরা চালের মূল্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী করছেন পাইকারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের। তাপস খাদ্যভাণ্ডারের খুচরা চাল বিক্রেতা তাপস কুমার মণ্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা এক সপ্তাহ যাবত বেশি দামে চাল কিনছি। তাই প্রতি কেজিতে ২-৩ টাকা বেশি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। খুচরা বাজারে কোনো সিন্ডিকেট হয় না, মিল ও পাইকারি পর্যায়ে অভিযান শুরু হলেই চালের বাজারে স্বস্তি ফিরবে।’
যদিও জেলার চালকল মালিকরা দাবি করছেন চালের দাম বাড়ার বিষয়টি স্বাভাবিক। নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পাইকারিতে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে স্বর্ণা-৫ কেজিতে ১ টাকা বেড়েছে। জিরাশাইল ও কাটারিভোগে বেড়েছে কেজিতে ২ টাকা করে। সরকারি গুদামে চাল দিলেই এখন কেজিতে ৪৪ টাকা পাওয়া যাচ্ছে। সে তুলনায় আমন মৌসুমে চালের বর্তমান বাজার মোটেও অস্বাভাবিক নয়।’
যদিও বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয় বলে মনে করছেন নওগাঁ জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এ বছর আমনের রেকর্ড পরিমাণ ফলন হওয়ায় বাজারে কোনো সংকট নেই। তাই চালের দাম হুট করে বেড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক। প্রশাসনের সহযোগিতায় শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ’
পাইকারিতে বাড়লেও রাজধানীর খুচরা বাজারে এখনো চালের দামে তেমন একটা প্রভাব দেখা যায়নি। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৮-৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্রি-২৮ ও পাইজাম বিক্রি হচ্ছে ৫৪-৫৬ টাকায়। এছাড়া সরু চালের মধ্যে মিনিকেট ও নাজির মানভেদে ৬৫-৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর খিলবাড়িরটেকের ব্যবসায়ী মো. আমিরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দোকানে এখনো চালের দাম বাড়াইনি। শুনেছি বস্তায় ২০০ টাকা বেড়েছে। নতুন চাল আনলে তখন বেশি দামে বিক্রি করতে হবে।’
সংশ্লিষ্টদের কারো কারো অভিমত নির্বাচনের সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা বাজারে চালের দাম বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি একেএম খোরশেদ আলম খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনের সময়েও হঠাৎ চালের দাম বাড়ানো হয়েছিল। প্রতি কেজিতে তখন ৫ টাকা বেড়েছে। সে সময় মন্ত্রণালয় থেকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসলে একজন ব্যবসায়ী নেতা কেজিতে ২ টাকা করে কমানোর ঘোষণা দেন। তার অর্থ হলো এক ঘোষণায় যে ২ টাকা কমাতে পারে সে এক ঘোষণায় বাড়াতেও পারে। তারাই বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যদিও সরকারি তদারকির অভাবে সবসময়ই তারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে।’
এ সময় চালের মূল্য বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন তো চালের ভরা মৌসুম। কিন্তু এখন কেন চালের দাম বাড়বে। এর মাধ্যমে কয়েকদিনে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেবে একটি চক্র। বাজারে আগে ছোট ছোট মিল মালিকরা ছিল। কিন্তু এখন বেশির ভাগই করপোরেটদের দখলে। বড় বড় কোম্পানি বাজারে ঢুকেছে। বাজারটা মূলত তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে।’
চালের বাজার বিভিন্ন সময় অস্থির হয়ে উঠলেও তা নিয়ন্ত্রণে আনতে বরাবরই হিমশিম খেতে হয়েছে সরকারকে। এজন্য বিভিন্ন সময়ে সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্য-উপাত্তের ব্যবধানকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা। চাল উৎপাদনের প্রাথমিক পরিসংখ্যান ডিএই তৈরি করলেও চূড়ান্ত পরিসংখ্যান তৈরি করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। প্রতি বছরই এ দুই তথ্যের মধ্যে দেখা যায় বিস্তর ব্যবধান। আবার আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উৎপাদন পরিসংখ্যানেও দেখা যায় ভিন্নতা। খোদ সরকারের নীতিনির্ধারকরাও বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন।
গত অর্থবছরেও চালের মোট উৎপাদন নিয়ে ডিএই ও বিবিএসের তথ্যে গরমিল ছিল ১৬ লাখ টনেরও বেশি। এ দুই সংস্থার তথ্যের সঙ্গে আবার মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) পরিসংখ্যানেও ছিল বিস্তর ফারাক। চলতি আমন মৌসুমেও ১ কোটি ৭১ লাখ টন চাল উৎপাদনের পূর্বাভাস দিয়েছে ডিএই। যদিও ইউএসডিএর এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তা হতে পারে ১ কোটি ৩৯ লাখ টন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দেশে জমি কম তবুও উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদন ও চাহিদার তথ্যে ব্যাপক গরমিল দেখা যায়। আসলে আমাদের চাহিদা ও উৎপাদন কত তা ঠিক করতে হবে। সে আলোকে উপযোগী সময়েই আমদানি করতে হবে। যেকোনো খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রেই সরবরাহ বেশি থাকলে দাম স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু যখন ব্যবসায়ীরা সরবরাহ সংকট টের পান, তখনই তারা মজুদ করেন বা দাম বাড়িয়ে দেন। আবার বিভিন্ন সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীদের দাম বাড়িয়ে দিতে দেখা যায়। সরকারি মজুদ আরো শক্তিশালী করলে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে পারেন না। চালের ক্ষেত্রে দাম বাড়লে তার প্রভাব দেশের মানুষের ওপর বেশি পড়ে।’
চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত চাল আমদানি করেনি সরকার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে প্রায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল আমদানি হয়। গত নভেম্বরে মোটা ও মাঝারি আকারের চালের দাম কিছুটা বাড়লেও তা ডিসেম্বরে কমে আসে। তবে মাস না যেতেই আবার বাড়তে শুরু করেছে দাম। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ১৪ লাখ টন চাল মজুদ রয়েছে।
কয়েক বছর ধরেই বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ছে। বাড়ছে মূল্যস্ফীতিও। ফলে বাজারে চালের মূল্য বৃদ্ধি মানুষের খাদ্যাভ্যাসে চাপ ফেলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের নিয়মিত ‘খাদ্য নিরাপত্তা’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৭১ শতাংশ পরিবার খাদ্যপণ্যের দাম বেশি থাকা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন।
সাবেক খাদ্য সচিব আব্দুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। এজন্য ব্যবসায়ীরা হয়তো দেশের বাজারেও দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। আবার সিন্ডিকেশনের কারণেও দাম বাড়ে। কিন্তু এ সময়ে দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। আমনে কত উৎপাদন হয়েছে তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। কারণ সরকারি তথ্যের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। এ বছর চাল আমদানি হয়নি। কিছু চাল আমদানি করা উচিত। কারণ আমদানি হলে চালের বাজার অস্থিতিশীল করার সুযোগ পায় না। চালের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষ সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ দেশে মানুষের মোট খরচের প্রায় ৩০ শতাংশ চালে। সবকিছুর দামই বাজারে বেড়েছে। এর মধ্যে চালের দাম বাড়লে সব ধরনের মানুষের ওপরই প্রভাব ফেলে।’