আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক টানা ১৫ মাস

দুই বছর আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বাংলাদেশ ডলার-সংকট পড়ে, যা সংকট এখনও চলমান। ওই সময় সংকট সামাল দিতে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন পণ্যের এলসি খোলা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আমদানিতে তাৎক্ষণিক এর প্রভাব দেখা যায়নি। এতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইতিবাচক ছিল আমদানি প্রবৃদ্ধি। যদিও তা নি¤œমুখী হতে থাকে।

আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপের সরাসরি প্রভাব শুরু হয় মূলত ২০২২-২৩ অর্থবছরে অক্টোবর থেকে। ওই মাসে আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে পড়ে। এরপর থেকে আর ইতিবাচক ধারায় ফিরতে পারেনি আমদানি প্রবৃদ্ধি। ফলে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ১৫ মাস ধরে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি চলছে আমদানিতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাসে আমদানির পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ৩৩৮ বিলিয়ন ডলার, যা তার আগের (২০২১-২২) অর্থবছরের চেয়ে ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি। ওই বছরের প্রথম মাসে আমদানি হয়েছিল ৫ দশমিক ১৪১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এর পরের দুই মাস আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে আমদানি প্রবৃদ্ধি ক্রমেই হ্রাস। এর মধ্যে আগস্টে আমদানি প্রবৃদ্ধি হয় ১১ দশমিক ৯৬ শতাংশ ও সেপ্টেম্বরে ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ওই দুই মাসে আমদানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৩৭৫ বিলিয়ন ডলার ও ৭ দশমিক ১৯২ বিলিয়ন ডলার।

গত অর্থবছরের অক্টোবরে আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয় ছয় দশমিক ৪১ শতাংশ ঋণাত্মক। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের অক্টোবরে আমদানি হয়েছিল ৭ দশমিক ১১১ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময় তা কমে হয় ৬ দশমিক ৬৫৫ বিলিয়ন ডলার। সে অনুযায়ী আমদানি কমেছে ৪৫৬ মিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছর নভেম্বরে আমদানি প্রবৃদ্ধির নেতিবাচক ধারা কিছুটা হ্রাস পায়। ওই মাসে আমদানি হয় ৭ দশমিক ৫৯২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা তার আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬৩ মিলিয়ন ডলার বা ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ কম।

ডিসেম্বর থেকে আমদানিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কে (ডাবল ডিজিট) পৌঁছায়। ওই মাসে দেশে আমদানির পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ০৪৩ বিলিয়ন ডলার, যা তার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৩৯৪ বিলিয়ন ডলার বা ২৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের ডিসেম্বরে আমদানি হয়েছিল ৮ দশমিক ৪৩৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য।

গত অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ধারা ছিল সবচেয়ে বেশি। ওই প্রান্তিকে আমদানিতে সবচেয়ে বেশি ধস নামে। মূলত সেই সময় ডলার সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ ব্যাংক এলসি খোলায় নানা রকম তদারকি শুরু করে। বেশকিছু এলসি খোলার আবেদন প্রত্যাখ্যানও করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত অর্থবছরের জানুয়ারি, ফেব্রæয়ারি ও মার্চে আমদানি হয় যথাক্রমে ৬ দশমিক ৩৭২ বিলিয়ন ডলার, ৪ দশমিক ৬২৪ বিলিয়ন এবং ৬ দশমিক ০৮৫ বিলিয়ন ডলার, যা তার আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যথাক্রমে ২৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ, ৪৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং ২১ দশমিক ২৩ শতাংশ ঋণাত্মক। ২০২১-২২ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) আমদানি হয়েছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৩২৭ বিলিয়ন ডলার, ৮ দশমিক ৩২৫ বিলিয়ন এবং ৭ দশমিক ৭২৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য।

ডলার সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়া ও এলসি খোলায় ব্যাংকগুলোর গড়িমসির কারণে গত অর্থবছরের শেষে প্রান্তিকেও আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিলে আমদানি হয় ৫ দশমিক ২২৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য; যা তার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৪৯৬ বিলিয়ন ডলার বা ৩২ দশমিক ৩২ শতাংশ কম। ওই অর্থবছরের এপ্রিলে আমদানি হয় ৭ দশমিক ৭২১ বিলিয়ন ডলার।

পরের দুই মাসে (মে ও জুন) আমদানি প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় যথাক্রমে ১১ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং ৩৩ দশমিক ৫২ শতাংশ ঋণাত্মক। ওই দুই মাসে আমদানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ৪৬৫ বিলিয়ন এবং ৫ দশমিক ০৯৭ বিলিয়ন ডলার। তার আগের অর্থবছরের একই সময়ে আমদানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ২৭৬ বিলিয়ন এবং ৭ দশমিক ৬৬৬ বিলিয়ন ডলার।

বিদায়ী অর্থবছরের দেশে মোট পণ্য আমদানি হয় ৭৫ দশমিক ০৬২ বিলিয়ন ডলার, যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৪ দশমিক ১০১ বিলিয়ন বা ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের আমদানি হয়েছিল ৮৯ দশমিক ১৬২ বিলিয়ন ডলার।

গত অর্থবছরের মতোই চলতি অর্থবছরও ডলার সংকট নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনি সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে আমদানিতে কড়াকড়ি কমানো হয়নি। তবে গত ছয় মাসে ডলার সংকট আরও গভীর হয়েছে, যার প্রভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেও আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ধারায় রয়েছে। এই ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে অনেক বেশি। চলতি অর্থবছরের সবচেয়ে বেশি ঋণাত্মক ছিল আগস্ট মাসে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে আমদানি কমেছে  প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বা ১৫ দশমিক ০৪ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছর জুলাইয়ে আমদানি হয়েছে ৫ দশমিক ৩৮৫ বিলিয়ন ডলার, আগের অর্থবছর একই সময়ে যা ছিল ৬ দশমিক ৩৩৮ বিলিয়ন ডলার। পরের মাসে (আগস্ট) আমদানি হয় ৫ দশমিক ২৪৮ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ১২৮ বিলিয়ন ডলার বা ২৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের আগস্টে আমদানি হয়েছিল ৭ দশমিক ৩৭৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। আর গত সেপ্টেম্বরে আমদানি হয়েছে ৫ দশমিক ২৭৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১  দশমিক ৯১৫ বিলিয়ন ডলার বা ২৬ দশমিক ৬২ শতাংশ কম।

এদিকে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের অক্টোবর মাসে আমদানি কমেছে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছর অক্টোবরে আমদানি হয়েছে ৫ দশমিক ৯৬২ বিলিয়ন ডলার, যা তার আগের অর্থবছরের একই সময় ছিল ৬ দশমিক ৬৫৪ বিলিয়ন ডলার।

পরের মাসে (নভেম্বর) আমদানি হয় ৫ দশমিক ৮৯০ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ দশমিক ৪০ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের নভেম্বরে আমদানি হয়েছিল ৭ দশমিক ৫৯১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। আর গত ডিসেম্বরে আমদানি হয়েছে ৫ দশমিক ২৩২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ দশমিক ০৪২ বিলিয়ন ডলার বা ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ কম।

চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) মোট আমদানি হয়েছে ৩২ দশমিক ৯৯৫ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪১ দশমিক ১৯৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ছয় মাসে আমদানি কমেছে ৮ দশমিক ১৯৯ বিলিয়ন ডলার বা ১৯ দশমিক ৯০ শতাংশ।

এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ খাতেই আমদানি প্রবৃদ্ধি ব্যাপক হারে ঋণাত্মক হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছয় মাসে খাদ্যশস্য আমদানি কমেছে ৪২ দশমিক ০৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে এসব পণ্য আমদানি হয় ৭৬৭ মিলিয়ন ডলারের, যা তার আগের অর্থবছরের একই সময় ছিল ১ দশমিক ৩২৩ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া ভোগ্যপণ্য আমদানি কমেছে ১৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ, মধ্যবর্তী পণ্য ২০ দশমিক ৩৬ শতাংশ, মূলধনি যন্ত্রপাতি ২৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং অন্যান্য পণ্য ৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কমেছে।

ব্যবসায়ীরা বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে যায়। এসব পণ্য আমদানিতে ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে ডলারের সংকট দেখা দেয়। অন্যদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে দেশে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। আবার সরকার এলসি খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করে। সব মিলিয়ে উৎপাদন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে আমদানি কমাতে বাধ্য হয়েছেন তারা।

sharebiz