আবার র‍্যাব-হাসিনার ইসলামী জঙ্গী কার্ড

 আমার দেশ
১২ অক্টোবর ২০২২

মাহমুদুর রহমান

মাহমুদুর রহমান

মাহমুদুর রহমান

ব্যক্তিগত পড়াশুনা নিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ত থাকায় গত পুরো এক সপ্তাহ সম্পাদকীয় লেখার জন্য হাতে একেবারে সময় পাই নাই। এর মধ্যে দেখতে পাচ্ছিলাম শেখ হাসিনা শূন্য হাতে ওয়াশিংটন থেকে ফিরে, নির্বাচনকে সামনে রেখে আবারও ইসলামী জঙ্গী কার্ড নিয়ে খেলা শুরু করে দিয়েছেন। বছর খানেক ধরে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে পরিবর্তনের হাওয়া জোরদার হচ্ছে। জুনিয়র বুশ, ওবামা এবং ট্রাম্প জামানায় ভারতকে কোলে তুলে নেওয়ার ভ্রান্ত নীতির কুফল মার্কিন প্রশাসন অবশেষে টের পাচ্ছে। রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যকার চলমান যুদ্ধে দিল্লি তার স্বরূপ দেখানোর পর দেরীতে হলেও ওয়াশিংটনের হুঁশ ফিরেছে বলেই মনে হচ্ছে। চীন ও ইসলামের বিরুদ্ধে ‘অনন্ত যুদ্ধে’ এত ঘটা করে যে দেশকে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের কৌশলগত মিত্র ঘোষণা করেছিল সেই দেশ যে মনেপ্রাণে তাদের শীতল যুদ্ধকালীন মুরব্বী সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্রই রয়ে গেছে সেটা ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার যুদ্ধ না বাধলে ওয়াশিংটনের অগোচরেই থেকে যেত। ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভারতকে সাথে পেলেও চীনের বিরুদ্ধে কতটা পাওয়া যাবে সেটা নিয়ে অবস্থাদৃষ্টে যথেষ্ট সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। হিন্দুত্ববাদি মোদি মুসলমানের বিরুদ্ধে সর্বদা খড়গহস্ত হলেও চীনের বিরুদ্ধে টু শব্দটিও উচ্চারণ করেন না। কিংবা সাহস পান না।

আমরা যারা সেই সময় মার্কিন নীতির অদূরদর্শিতার সমালোচনা করেছিলাম তাদেরকে ‘ইসলামিস্ট’ আখ্যা দিয়ে ঢাকায় অবস্থিত সে দেশীয় দূতাবাসের কর্তাব্যক্তিরা রীতিমত ব্ল্যাকলিস্ট করেছিল। ‘আমার দেশ’ পরিবারের উপর ফ্যাসিস্ট হাসিনা রাষ্ট্রের সকল হাতিয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কণ্ঠ রোধ করলেও ওয়াশিংটন বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে কোনরকম মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করে নাই। প্রকাশ্য দিবালোকে, আদালত চত্বরে, পুলিশ ও বিচারকদের সামনে সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগের সশস্ত্র দল আমার উপর লাঠি, পাথর, বল্লম নিয়ে আক্রমণ চালালেও মার্কিন দূতাবাস নিরব থেকে সেই হত্যা চেষ্টায় উৎসাহ জুগিয়েছে। উৎসাহ পেয়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা পরবর্তীতে অবশ্য খোদ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের উপরই একই কায়দায় হামলা চালিয়েছিল। যাই হোক, প্রভু ভারতের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব সৃষ্টিতে অবশেষে কপাল পুড়েছে বিশ্বের একমাত্র নারী ফ্যাসিস্ট শাসক শেখ হাসিনার। যে ফ্যাসিস্ট শাসককে ইসলামী জঙ্গী দমনের নামে চৌদ্দ বছর ধরে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে পায়ের নীচে ফেলে নির্মমভাবে পিষে মারার একচ্ছত্র অধিকার দেয়া হয়েছিল তাকেই এখন ওয়াশিংটনের কাছে নানারকম জবাবদিহি করতে হচ্ছে। হাসিনার ব্যক্তিগত খুনী বাহিনীর লোকজনদের বিরুদ্ধেও সেখান থেকে স্যাংকশন আসছে।

২০০৮ সালের সাজানো নির্বাচনে ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে দিল্লি, ওয়াশিংটন এবং বেইজিং, তিন প্রভাবশালী রাজধানী থেকে একই সাথে সমর্থন পেতে অভ্যস্ত শেখ হাসিনা অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে প্রতিকূল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পড়েছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অতি দ্রুত সকল হিসাবনিকাশ পাল্টে দিয়েছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়েও এবার ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রশাসনের কারো সাথে সাক্ষাৎ না পেয়ে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে শেখ হাসিনা ঢাকায় ফিরেছেন। তিনি ভাল করেই জানেন যে, প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় তিনি উত্তর কোরিয়ার কিম জং কিংবা মিয়ানমারের সামরিক জান্তা হতে পারবেন না। চীনের বিশেষ ঘনিষ্ঠ দুটি দেশের পশ্চিমা দুনিয়ার উপর তেমন কোন নির্ভরতা নাই। অপরদিকে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির বাজার বলতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ। ট্রেড স্যাংকশন পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন হবে না, ওয়াশিংটন শুধু স্যাংকশনের হুমকি দিলেই বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। ঋণের খোঁজে গলদঘর্ম হাসিনার অর্থমন্ত্রীর জন্য আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংকের দরজাও বন্ধ হয়ে যাবে। ২০০৭ সালে জাতিসংঘের ভুয়া হুমকির ভয় দেখিয়ে জেনারেল মইন এদেশে সিভিল-মিলিটারি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলেছিল। এবার ট্রেড স্যাংকশনের হুমকি এলে সামরিক ও বেসামরিক ব্যুরোক্রেসির সাথে ব্যবসায়ীরাও যোগ দিয়ে শেখ হাসিনাবিরোধী অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলবে। দেখা যাবে আওয়ামী ব্যবসায়ী অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল এবং আওয়ামী ব্যবসায়ী বেসামরিক উপদেষ্টা সালমান রহমান অভ্যুত্থানকারীদের সামনের কাতারে ধাক্কাধাক্কি করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। শেখ হাসিনার হাতে একেবারেই সময় নাই। সুতরাং, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মন জয়ের সর্বশেষ চেষ্টা হিসাবে আবারও জঙ্গী নাটক মঞ্চায়নের নির্দেশ দিয়েছেন।

জঙ্গী নাটকের কাহিনী অথবা মঞ্চায়নে কোনরকম নতুনত্ব নাই। কিছুদিন থেকে সেই আগের মতই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে র‍্যাব এবং ডিবি পুলিশ সদ্য তরুণদের গুম করে তাদের ইসলামী জঙ্গী গ্রুপের পলাতক সদস্য বলে প্রচার করছে। এই সমস্ত তথাকথিত, নামসর্বস্ব ইসলামী জঙ্গী দল বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দারাই তৈরি করেছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে এই সব দলের কোথাও কোন অস্তিত্ব নাই। আমি নিশ্চিত যে, গুম করা সব তরুণদের র‍্যাব এবং গোয়েন্দা পুলিশের আয়নাঘর মার্কা সেফ হাউজে আটক রাখা হয়েছে। র‍্যাব-১ এর হেডকোয়ার্টারে এবং ডিবির মিন্টো রোডের কার্যালয়ে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় আমি এই জাতিয় অসহায়, নিরপরাধ নাম না জানা অনেক তরুণকে দেখেছি। পরিকল্পনা মাফিক তাদেরকে কিছু দিন পর বাছাই করা, ইসলামবিদ্বেষী, মিডিয়ার সাংবাদিক নামক গোলামদের সামনে হাজির করা হবে। সেই সব সাংবাদিকরা গোয়েন্দাদের আপন মনের মাধুরী মেশানো সব কল্পকাহিনী তাদের সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে কোন যাচাই-বাছাই ছাড়াই একতরফাভাবে ফলাও করে প্রচার করবেন। গুম হয়ে যাওয়া তরুণদের মধ্যে অনেককে হয়ত জঙ্গীবিরোধী অভিযানের নামে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নির্মমভাবে হত্যাও করা হতে পারে। এই ধরনের অসংখ্য হত্যাকাণ্ড গত চৌদ্দ বছরে ঘটানো হয়েছে। একবার জঙ্গীবিরোধী অভিযানের নামে বিনাবিচারে হত্যাকাণ্ড শুরু হলে সেই অভিযান বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমন করতেও বিস্তৃত করা হবে।

উপরোক্ত মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে শেখ হাসিনা তিন ভাবে ফায়দা লোটার চেষ্টা করবেন। প্রথমত: ইসলামী জঙ্গীবিরোধী অভিযানের সফলতা প্রচার করে তিনি ওয়াশিংটন ও অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রের কাছে নিজের অপরিহার্যতা প্রমাণ করবেন। দ্বিতীয়ত: প্রতিষ্ঠান হিসেবে র‍্যাবকে জঙ্গীদমনে সফল দেখিয়ে মার্কিন স্যাংকশন উঠিয়ে নেয়ার জন্য লবি নিয়োগ করে বাইডেন প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করাবেন। এবং তৃতীয়ত: এই সুযোগে বি এন পি ও অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চালিয়ে ক্রমেই বেগবান হয়ে ওঠা গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করবার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবেন। বিএনপির নেতৃত্বের কাছে আহ্বান জানাবো যে, তারা যেন প্রতিটি মহাসমাবেশ থেকে দেশবাসীকে এই বিষয়টি নিয়ে সতর্ক করেন। এ ছাড়া, বিদেশী কূটনীতিকদের কাছেও ক্ষমতাসীন মহলের এই চক্রান্ত তুলে ধরা উচিৎ। যেহেতু বাইডেন প্রশাসন তথাকথিত ইসলামী জঙ্গী বিরোধী অনন্ত যুদ্ধের বিতর্কিত নীতি থেকে দৃশ্যত: সরে এসেছে, কাজেই আমরা আশা করছি যে, শেখ হাসিনার জঙ্গী নাটক সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে। আসুন আমরা সম্মিলিতভাবে এই ফ্যাসিস্ট শাসকের মুখোশ উন্মোচন করে তার অপশাসনের চিত্র গণতান্ত্রিক বিশ্বের কাছে তুলে ধরি। জঙ্গী নাটক ব্যর্থ হলে শেখ হাসিনা পালানোর জায়গা পাবেন না।

লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ