Prothom Alo
কিউইদের জন্য আক্ষেপ হতে পারে যে কারওরই। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে টানা তিনটি ফাইনালে পরাজিতের দলেই তারা। ২০১৫ সালে এই অস্ট্রেলিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করেই নিউজিল্যান্ডের ফাইনাল হারের শুরু। এরপর দুই বছর আগে লর্ডসের সেই নাটকীয় ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অল্পের জন্য স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। মাঝখানে টেস্টের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলেও এবার টি-টোয়েন্টির শিরোপাটা অধরাই হয়ে রইল তাদের। দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলে ফাইনালে উঠে আসা কেইন উইলিয়ামসনের দলের পক্ষে বাজি ধরার লোকের অভাব ছিল না। কিন্তু ফাইনালে অধিনায়ক ছাড়া, নিউজিল্যান্ড দলে বলার মতো কোনো পারফরম্যান্সই নেই। ১৭২ রানের পুঁজি নিয়েও এত দিন ধরে দুর্দান্ত বোলিংয়ে ক্রিকেট দুনিয়ার মনোযোগ কাড়া ট্রেন্ট বোল্ট, টিম সাউদিরা ওয়ার্নার-মার্শদের সামনে হয়ে রইলেন অসহায়ই। রীতিমতো ব্যাট হাতে রাজত্ব করেই নিউজিল্যান্ডকে ওড়ালেন অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যানরা—ডেভিড ওয়ার্নার আর মিচেল মার্শ। ওয়ার্নার শুরু থেকেই ছিলেন আক্রমণাত্মক—চার বাউন্ডারি আর ৩ ছক্কায় করলেন ৩৮ বলে ৫৩। মার্শ ৬ চার ও ৪ ছক্কায় ৫০ বলে ৭৭ করে অজেয় শেষ পর্যন্ত।
আগে ব্যাটিং করে নিউজিল্যান্ডের তোলা ১৭২ রানের সংগ্রহটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। নিউজিল্যান্ডের ফিল্ডিং-বোলিং বিবেচনায় অস্ট্রেলিয়ার জন্য রান তাড়াটা খুব সহজ ছিল না। তবে দ্বিতীয় সেমিফাইনালে পাকিস্তানের ১৭৬ রানের সংগ্রহকে তারা যেভাবে তাড়া করেছিল, তাতে আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকার কথা নয়। আজ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে যেন অস্ট্রেলিয়া শুরু করল ঠিক সেখান থেকেই, পাকিস্তানের বিপক্ষে তারা শেষ করেছিল যেখানে। পার্থক্য কেবল কুশীলবে। পাকিস্তানের বিপক্ষে সেমিফাইনাল অস্ট্রেলিয়াকে জেতানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন মার্কাস স্টয়নিস ও ম্যাথু ওয়েড। আজ সেটি শুরু থেকেই নিলেন ডেভিড ওয়ার্নার। মাঝখানে দলীয় ১৫ রানে অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চের ফেরাটা যদি ধাক্কা হয়, তাহলে সেই ধাক্কা সামলাতে একবিন্দু সমস্যা হয়নি অস্ট্রেলীয়দের। ওয়ার্নারের সঙ্গী হলেন মিচেল মার্শ। এই দুজন একসঙ্গে মিলে নিউজিল্যান্ডের বোলিং আক্রমণকে নিয়ে যেন ছেলেখেলা করলেন। বোল্ট, সাউদি, মিলনে, স্যান্টনারদের বিপক্ষে এমন অবলীলায় রান করতে থাকলেন তারা, ফাইনাল খেলাটাকে মনে হলো আর দশটা সাধারণ খেলাই। ওয়ার্নার আর মার্শের ব্যাট অনেক আগেই ফাইনালের উত্তজনাটা শুঁষে নিল অসম্ভব বিক্রমেই। ম্যাচ শেষ হওয়ার বেশ আগেই পরিষ্কার হয়ে যায় ব্যাপারটা। নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটাররাও যেন দেখা শুরু করে দেন, আরও একটি বৈশ্বিক ফাইনালে নিজেদের বেদনাগাথা।
টসে হেরে ব্যাটিংয়ে নেমেছিল নিউজিল্যান্ড। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অন্য ম্যাচগুলোর মতো ফাইনালের ভাগ্যও কি ঠিক করে দিল টস! এবার বিশ্বকাপে ১২ ম্যাচের ১০টিতেই শেষ পর্যন্ত জিতেছে টসজয়ী দল। আজ অস্ট্রেলিয়াও যেন টসে জিতে নিজেদের ভাগ্যবানই মনে করছিল। তবে নিউজিল্যান্ড ব্যাটিংয়ে নেমে শুরুটা মন্দ করেনি। ৩ ওভার শেষ হতে না হতেই স্কোরবোর্ড ২৮ রান—শুরুটা ছিল যথেষ্ট ভালোই। কিন্তু ড্যারিল মিচেলকে জশ হ্যাজলউড যখন উইকেটের পেছনে ম্যাথু ওয়েডের ক্যাচ বানালেন, নিউজিল্যান্ডের বিপর্যয়ের শুরুটা বোধ হয় সেখান থেকেই। মিচেল ফেরার পর ক্রিজের অপর প্রান্তে থাকা মার্টিন গাপটিলও যেন নিজেকে খোলসবন্দী করে ফেললেন। ঠিক ‘গাপটিল-সুলভ’ ইনিংস দেখা গেল না তাঁর ব্যাট থেকে। তবে তিন নম্বরে অধিনায়ক কেইন উইলিয়ামসন নেমে যেন সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। গাপটিল ফর্মে নেই, সেটি বুঝতে পেরেই যেন উইলিয়ামসন নিজের স্বভাবসুলভ ব্যাটিংয়ের বাইরে যেতে চাইলেন। দারুণভাবে অস্ট্রেলীয় ফিল্ডিং পজিশনের ফাঁকফোকরগুলো খুঁজে বের করে বাউন্ডারি মারতে লাগলেন। গাপটিল নিষ্প্রভ থাকার পরেও নিউজিল্যান্ডের রানের চাকা রইল সচলই। ৪৫ বলে ৪৮ রানের জুটি গড়লেন গাপটিলকে নিয়ে—কিন্তু গাপটিল অধিনায়কের ছায়ায় থেকেও সেই সুবিধাটা আদায় করে নিতে পারলেন না—তিনি আউট ২৮ রান করে। কিন্তু এই ইনিংসটি তিনি খেললেন ৩৫ বলে।
গাপটিলের ফেরার পর উইলিয়ামসন নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে আরও সচেতন হয়ে গেলেন। ডেভন কনওয়ে নেই, দলের সংগ্রহটাকে অস্ট্রেলিয়ার জন্য ‘কঠিন’ করে তুলতে দরকার তাঁকেই। তিনি সে হিসেবটা মাথায় নিয়েই খেললেন—দুবাই ক্রিকেট স্টেডিয়াম দেখল দুর্দান্ত এক ইনিংস। ৪৮ বলে ৮৫ রানের। ১০টি বাউন্ডারি এল উইলিয়ামসনের ব্যাটে, ৩টি ছক্কা। এত হিসেব কষে, নিখুঁত যে ইনিংসটি উইলিয়ামসন খেললেন, সেটির সঙ্গে খুবই জরুরি ছিল সতীর্থ একজন বা দুজন ব্যাটসম্যানের সঙ্গ। তাঁকে মোটামুটি সঙ্গ দিলেন কেবল গ্লেন ফিলিপস। ৩৭ বলে ৬৮ রানের জুটি। কিন্তু সেটিও যথেষ্ট ছিল না। ফিলিপস ফিরলেন ১৭ বলে ১৮ রান করে। প্রথম সেমিফাইনালের ‘বীর’ জিমি নিশাম—ব্যর্থ তিনিও ৭ বলে ১৩ রানের বেশি করতে পারলেন না তিনি। সবচেয়ে বড় কথা ১৭ ওভারে নিউজিল্যান্ড উইলিয়ামসনকে হ্যাজলউডের বলে হারায়, একই ওভারে একটু আগেই ফেরেন ফিলিপস। নিউজিল্যান্ডের ইনিংসটি শেষ পর্যন্ত টেনে নেওয়ার যে দায়, সেটি মেটাতে পারেননি কেউই। এই দুজনের অন্তত একজন যদি ২০ ওভার পর্যন্ত খেলে আসতে পারতেন, তাহলে নিউজিল্যান্ডের সংগ্রহটা ১৯০-এর কোটা স্পর্শ করতে পারত। সেটি অবশ্য করতে দেননি জশ হ্যাজলউড। শুরুতে স্টার্কের বলে উইলিয়ামসনের ক্যাচ ফেলেছিলেন হ্যাজলউড—সেই ভুলেন প্রায়শ্চিত্ত তিনি করলেন মাত্র ১৬ রানে ৩ উইকেট নিয়ে। অ্যাডাম জাম্পা তাঁর লেগ স্পিনে নিয়েছেন একটি উইকেট।
১৭৩ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নেমে যা করার দরকার ছিল অস্ট্রেলিয়া সেটিই করেছে। নিউজিল্যান্ডের বোলারদের কখনোই ওপরে চেপে বসতে দেননি তাদের ব্যাটসম্যানরা। ওয়ার্নার যেন পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে তাঁর রিভিউ না নিয়ে ডাগআউটের দিকে হাঁটার ভুলটা পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন শুরু থেকেই। বোল্ট, সাউদি, মিলনেদের নিতান্তই হেলাফেলা করেই উইকেটের চারদিকে উড়িয়ে ফেলতে লাগলেন। ফিঞ্চের আউটের পর ওয়ার্নারের পার্টিতে যোগ দিলেন মিচেল মার্শ। শেষ পর্যন্ত ওয়ার্নকেই ছাপিয়ে গেলেন তিনি। দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দিয়েই দায়িত্বটা শেষ করলেন এই ডান হাতি ব্যাটসম্যান।
বোল্টই যা একটু সফল। ৪ ওভার বোলিং করে ১৮ রানে নিয়েছেন ৮ উইকেট। কিন্তু সাউদি, মিলনে, সোধিরা সবাই ছিলেন খরচে—আরেকটি ফাইনালে হারের দিন সেটিই যেন ছিল তাদের ভবিতব্য।