শোকেসের গ্লাস সরিয়ে বের করলেন ল্যাপটপ ও দুটি মুঠোফোন। দুই হাতে নেড়েচেড়ে ‘এগুলো ছেলের’ বলেই কেঁদে উঠলেন। বললেন, ‘জানো বাবা, আজ যদি আমার ছেলে বেঁচে থাকত, তাহলে চাকরি করত। আরও কত কী হতো।’
ছেলের ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখিয়ে এভাবেই স্মৃতিচারণা করছিলেন আবরার ফাহাদের মা রোকেয়া খাতুন। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মীর নির্মম নির্যাতনে নিহত হন আবরার ফাহাদ। বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন আবরার।
গতকাল রোববার বিকেলে কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই সড়কের পাশে আবরারের বাড়িতে রোকেয়া খাতুনের সঙ্গে কথা হয়। এ সময় বাড়িতে একাই ছিলেন তিনি। আবরারের একমাত্র ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আবরার ফাহাদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ সোমবার বুয়েটে কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তাঁর বাবা বরকত উল্লাহ ঢাকায় গেছেন।
কথা প্রসঙ্গে আবরারের মা রোকেয়া খাতুন বললেন, ‘পাঁচ বছর আগেও রোববার ছিল। আজও রোববার। সকালে ছেলেকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। বিকেলে বুয়েটে পৌঁছায় ছেলে আমার। এরপর তাকে ছাত্রলীগের ছেলেরা ডেকে নির্যাতন করে হত্যা করে। তারা ছাত্রলীগ করলেও তারই কয়েকজন বন্ধু ছিল। তারাও একটি বারের জন্যও ফোনে জানায়নি ছেলেকে হত্যার বিষয়ে।’
ছেলের কথা বলতে বলতে দুই চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিল রোকেয়া খাতুনের। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ছেলের আম্মু ডাক এখনো কাজে বাজে। ভুলতে পারি না। কীভাবে ভুলব। এই সন্তানকে ভোলার নয়। তাকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেটা মনে হলেই শিউরে উঠি।’
তিনতলা বাড়িটির নিচতলায় থাকে আবরারের পরিবার। একটি কক্ষ বেশ পরিপাটি। খাটের এক পাশে বড় একটি শোকেস। এর পাশে দাঁড়িয়ে রোকেয়া খাতুন বলেন, ছেলে বুয়েটে যে বিছানায় থাকত, সেখান থেকে সব জিনিসপত্র নিয়ে এসেছেন। পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া গেছে তার ল্যাপটপ ও মুঠোফোন।
শোকেসের ভেতরে ছেলের ব্যবহৃত হাতঘড়ি, ব্যাগ, বই, পরিচয়পত্রসহ অনেক কিছুই যত্নে রেখেছেন মা রোকেয়া খাতুন। জুতা, একটি গোলক, পোশাক, জায়নামাজ ও তজবিহও আছে। কিছু চকলেট দেখিয়ে বললেন, আবরার ঘুমানোর সময় চকলেট মুখে দিয়ে ঘুমাত। সেগুলোও পাঁচ বছর ধরে রেখে দিয়েছেন। হাতঘড়ির কাঁটা বন্ধ হয়ে গেছে। সেটিও দেখিয়ে বললেন, আর কত দিন এ ঘড়ি চলবে?
আবরার সব সময় দেশের ভালোর জন্য লিখতেন বলে জানালেন রোকেয়া খাতুন। বললেন, ‘আবরার দেশ নিয়ে ভাবত। দেশের স্বার্থে ভালো কিছু লিখেই একটি দলের শত্রু হয়ে গিয়েছিল। সে তো কোনো রাজনীতি করত না। তাহলে কেন তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে? আর যারা হত্যা করল, তারা তো তারই বন্ধু ছিল। তারা কি দেশের ভালো চাইত না?’
আবরার হত্যা মামলার রায় হয়েছে। ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর আবরার হত্যা মামলায় ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। সব আসামির দ্রুত ফাঁসি কার্যকরের জোর দাবি জানান রোকেয়া খাতুন।
গতকাল মুঠোফোনে কথা হয় আবরারের ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনজন আসামি এখনো পলাতক। তাঁরা সবাই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এই আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও যেসব আসামি কারাগারে রয়েছেন, তাঁদের রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানান তিনি।
prothom alo