জাহাজ থেকে হাসিমুখে নাবিকেরা একে একে নেমে আসছেন। নেমেই জেটি চত্বরে অপেক্ষমাণ স্বজনদের বুকে জড়িয়ে ধরছেন। জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা আতিক উল্লাহ খান জাহাজ থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আদরের দুই ‘রাজকন্যা’কে বুকে টেনে নিলেন। নাবিক নুরউদ্দিন হাত বাড়িয়ে আড়াই বছরের সন্তানকে কোলে তুলে আদর করতে লাগলেন। জাহাজের চতুর্থ প্রকৌশলী তানভীর আহমেদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছেন মা জ্যোৎস্না বেগম। খানিক দূরে নাবিক আইনুল হককে কাছে পেয়ে মা লুৎফে আরা বেগমের কান্না যেন থামেই না। এই দুই মায়ের চোখেমুখে সন্তান ফিরে পাওয়ার আনন্দ।
সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার এক মাস পর নাবিকদের সঙ্গে স্বজনদের প্রথম দেখার দৃশ্য এটি। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের জেটি চত্বরে এমন আবেগঘন দৃশ্যের অবতারণা হয়।
দস্যুদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার পর কেএসআরএম গ্রুপের এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি গতকাল বঙ্গোপসাগরে বহির্নোঙর করে। সেখান থেকে এমভি জাহান মণি–৩ জাহাজে করে বিকেল চারটায় নাবিকদের বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল আনা হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ টার্মিনাল চত্বরে নাবিকদের সংবর্ধনার আয়োজন করে। নাবিকদের স্বজনেরাও ছুটে আসেন বন্দরে।
বাবা আসবে—এমন খবরে বেলা আড়াইটার দিকে চাচার সঙ্গে জেটি চত্বরে এসে হাজির হয়েছিল ছোট্ট ইয়াশরা ও উনাইজা। জীবনের রঙিন দিনটিকে স্মরণীয় করতে রঙিন ফুল নিয়ে এসেছিল তারা। সেই ফুল দিয়ে বাবাকে বরণ করে নেয় দুই কন্যা। জাহাজ থেকে নামতেই দুই মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেন আতিক উল্লাহ খান। আর বাবার গালে-মুখে আদরের চিহ্ন এঁকে দেয় মেয়েরা। এমন দৃশ্য দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন উপস্থিত অনেকেই। আতিক উল্লাহ খান বলেন, ‘এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম।’
আতিক উল্লাহ খানের দুই শিশুসন্তানের মতো উচ্ছ্বাস ছিল জ্যোৎস্না বেগমেরও। ছেলে তানভীর আহমেদ জাহাজের চতুর্থ প্রকৌশলী। জিম্মি হওয়ার পর থেকে চিন্তায় চিন্তায় অস্থির ও অসুস্থ হওয়ার অবস্থা। ছেলেকে পাওয়ার পর এই মায়ের খুশি যেন আর ধরে না। মায়ের বুকে ফিরতে পেরে ছেলে তানভীরও খুবই উচ্ছ্বসিত।
ছেলেকে বহনকারী জাহাজ জেটিতে পৌঁছার আগে জ্যোৎস্না বেগম বলছিলেন, ‘৩৩ দিন যে কীভাবে কেটেছে, তা ব্যাখ্যা করতে পারব না। এখন ছেলেকে কাছে পাব, এর চেয়ে আর বড় সুখ কী হতে পারে?’ লুৎফে আরা বেগমের উচ্ছ্বাসও যেন শেষ হচ্ছিল না। ছেলে যখন দস্যুদের হাতে জিম্মি, তখন ভালো করে ঘুমাতেই পারতেন না।
জিম্মিদশার দিনগুলোতে ভয় পেয়েছিলেন নাবিক নুরউদ্দিন। জাহাজে দস্যুদের অস্ত্রের মহড়া দেখে ভেঙে পড়েছিলেন। গতকাল বন্দরে নেমেই প্রথমে কোলে তুলে নেন আদরের সন্তান সাদ বিন নুরকে। আড়াই বছরের সাদ ‘পাপা পাপা’ বলে বাবাকে জড়িয়ে ধরে রাখে। নুরউদ্দিনের স্ত্রী এমন খুশির দিনে নিজের হাতে বানানো কেক নিয়ে এসেছেন বন্দরে।
এমভি আবদুল্লাহর মাস্টার ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ জাহাজ থেকে নেমেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘মালিয়ার দস্যুদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে আজ আমরা এখানে পৌঁছাতে পেরেছি। আমরা সবাই সুস্থ ও অক্ষতভাবে ফিরতে পেরেছি, পরিবারের কাছে ফিরতে পেরেছি। এ এমন এক অনুভূতি, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।’
বন্দরে নাবিকদের সংবর্ধনা
জাহাজ থেকে নামার পর নাবিকদের সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ সময় সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল, কেএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।
নাবিকদের সংবর্ধনার পর বন্দরে ইমিগ্রেশন হয়। এরপরই নাবিকেরা বাড়ি ফিরে যান।
গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগর থেকে কেএসআরএম গ্রুপের এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ ছিনতাই করেছিল সোমালিয়ার দস্যুরা। জলদস্যুদের হাতে জিম্মির খবরে জাহাজের নাবিকদের পরিবারে নেমে আসে রাজ্যের দুশ্চিন্তা। শেষ পর্যন্ত মুক্তিপণ দিয়ে ৩৩ দিনের মাথায় গত ১৩ এপ্রিল দিবাগত রাতে নাবিকদের ও জাহাজটি মুক্ত করা হয়।
এরপর জাহাজটি প্রথমে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে পৌঁছায়। সেখানে পণ্য খালাস শেষে আরেকটি বন্দর থেকে চুনাপাথর বোঝাই করে চট্টগ্রামের পথে রওনা হয়েছিল জাহাজটি। ১৩ দিনের মাথায় জাহাজটি বাংলাদেশের জলসীমায় এসে পৌঁছাল। আরব আমিরাত থেকে রওনা হওয়ার ১৪ দিন এবং জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার এক মাসের মাথায় ঘরে ফিরলেন নাবিকেরা।
নাবিকদের জিম্মি করার পর থেকে মুক্ত করে আনা পর্যন্ত পুরো কাজ সফলভাবে শেষ করেছে জাহাজটির মালিক কেএসআরএম গ্রুপ।
গ্রুপটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের নাবিক ভাইয়েরা আমাদের কাছে ফিরে এসেছে, এর চেয়ে আনন্দের দিন আর হতে পারে না। নাবিকেরা জিম্মি থেকে মুক্ত করে আনা পর্যন্ত সরকারসহ অনেকেই সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের ধন্যবাদ জানাই।’
prothom alo