বিএনপি নেতারা জানান, সারাদেশে দলটির প্রতিটি সাংগঠনিক কমিটির অনেক শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাকি বেশির ভাগ আত্মগোপনে। সবচেয়ে বেশি সংগঠনের পদধারী সক্রিয় কর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। শুরুতে ওইসব কমিটির মধ্য থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সামনে আনার প্রক্রিয়া শুরু হলে তাদেরও বেশির ভাগকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এতে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম এবং রাজপথের আন্দোলনে বেশ শূন্যতার সৃষ্টি হয়। তাই এবার মূল নেতৃত্বের সঙ্গে দ্বিতীয় সারিকেও সামনে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন দলের হাইকমান্ড।
জানা গেছে, আন্দোলনকে গতিশীল করতে কোনো কোনো জেলার দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের কেউ বিদেশে আবার কেউ রাজধানীতে অবস্থান করেন। আবার কোনো কোনো জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে সমন্বয়ক করা হয়েছে। এর মধ্যে পাবনা জেলা বিএনপির সমন্বয়ক হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, বাগেরহাট জেলা বিএনপির সমন্বয়ক হিসেবে সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম ও সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সহ-সমন্বয়ক হিসেবে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক তারিকুল হাসানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া অনেক জেলা-উপজেলায় দায়িত্বশীল নেতা কারাগারে যাওয়ায় নতুন নেতৃত্বকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট জিয়াউদ্দিন শিকদার ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক, টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব মাহামুদুল হক শানু ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে সিনিয়র সহসভাপতি আলী আজম সিদ্দিকী ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, ফরিদপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এবি সিদ্দিক মিতুল ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ও জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আফজাল হোসেন খান পলাশকে ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ রকম বেশ কয়েকটি জেলায় নতুনদের সামনে আনা হয়েছে।
ওইসব নেতা জানান, গত ২৮ অক্টোবরের পর সারাদেশে প্রায় ২৩ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আহত হয়েছেন প্রায় সাত হাজার নেতাকর্মী। আটক বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় নেতাকর্মীর সংখ্যাই বেশি। এতে দলের সাংগঠনিক আর আন্দোলন কার্যক্রম পরিচালনায় বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এ বিষয়টি অনুধাবন করে দলের শীর্ষ নেতা বিগত এক মাস ধরে মাঠের বিকল্প যোগ্য নেতাদের খোঁজ নিতে শুরু করেন। তালিকা করে ওইসব নেতার সঙ্গে ধারাবাহিক ভার্চুয়াল বৈঠক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ১০ বিভাগের সাংগঠনিক কমিটির সঙ্গেও তিনি পৃথক বৈঠক করেন। সেখানে আগামীর আন্দোলনে সবাইকে একযোগে মাঠে নামার নির্দেশনা দেন।
বিএনপি সূত্র জানায়, দলের শীর্ষ নেতার ওই বৈঠক থেকে গঠন করা হয়েছে ঢাকা মহানগরকেন্দ্রিক বিভিন্ন টিম। ওইসব টিমে ২০১৪ ও ’১৫ সালে আন্দোলনে যারা ভূমিকা পালন করেছিলেন, কিন্তু এখন পদ-পদবিতে নেই, সেসব নেতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আন্দোলনের জন্য ঢাকা বিভাগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এখানকার প্রতিটি জেলা ও মহানগরে গঠন করা হয়েছে পৃথক টিম। সেখানে এমপি মনোনয়নপ্রত্যাশী ছাড়াও ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক নেতাদের রাখা হয়েছে। একেক এলাকায় এসব টিমের বাইরে ছায়া টিমও গঠন করা হয়েছে, যারা মূল টিমকে সহায়তা করবে।
থেমে নেই কোন্দল, নজরদারিতে নিষ্ক্রিয়রা: দলের হাইকমান্ডের কড়া নির্দেশনার পরও অনেক সাংগঠনিক কমিটি রয়েছে নিষ্ক্রিয়তার তালিকায়। আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে না পারলেও কোন্দলে এগিয়ে রয়েছে ওইসব কমিটি। এ রকম বেশ কয়েকটি জেলায় অন্দোলনকে বেগবান করতে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সিনিয়র নেতাদের। যেসব ইউনিট আন্দোলনে দুর্বলতা দেখাচ্ছে তাদের আমলনামা তৈরি করা হচ্ছে। এ রকম একটি তালিকায় উঠে এসেছে বরিশালের চিত্র। সেখানে বলা হয়েছে, কোন্দলে আর কমিটি বাণিজ্য নিয়ে এখনও ব্যস্ত জেলার অনেক নেতা। তাদের দেখাদেখি অঙ্গ সংগঠনের অনেকে একই কায়দা অনুসরণ করছেন।
জানা গেছে, এর মধ্যে বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আবুল কালাম শাহীনকে মাঠে খুঁজে পায় না নেতাকর্মী। কোন্দলের কারণে অন্যরাও মাঠে নামার উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। জেলার আহ্বায়ক আবুল হোসেন বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বাধার কারণে সফল হতে পারছেন না। জেলা কমিটিতে না থাকলেও বিএনপি নেতা আবু নাসের মোহাম্মদ রহমাতুল্লাহ একক প্রচেষ্টায় শহরে কাজ করছেন। বরিশাল উত্তর জেলায় কোনো কার্যক্রমই নেই। পুরো ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এ কমিটি। মহানগর কমিটির কয়েক নেতা আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। তবে সেটাও আশানুরূপ নয়। আর জেলা ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক তৌফিক আল ইমরান আন্দোলনের মাঠে তৎপর না থাকলেও কমিটি ভাঙাগড়া এবং পদবাণিজ্য নিয়েই আছেন। কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সোহেল রাঢ়ি, সহসভাপতি আসিফ আল মামুন, যুগ্ম সম্পাদক ইমরান আহমেদ প্রমুখ কর্মসূচি পালনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। এই বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের টিমের মধ্যেও কোন্দল রয়েছে। একজন ডানে গেলে আরেকজন বামে যায়– এ রকম পরিস্থিতি বিরাজ করছে পুরো বিভাগে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এসব জেলায় বিভিন্ন সময়ে কথা বলে, স্কাইপিতে বৈঠক করেও নেতাদের সক্রিয় করতে পারছেন না। সুপারিশের জায়গায় বলা হয়েছে– দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব কমিটিতে ত্যাগী ও যোগ্যদের জায়গা করতে পারলে আন্দোলন বেগবান হবে। এ বিষয়ে জানার জন্য বরিশালের একাধিক নেতাকে ফোন দিলেও তারা কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
জেলা পর্যায়ের এই কোন্দল ছড়িয়ে পড়ছে কেন্দ্রের মধ্যেও। ঢাকা থেকে আয়োজিত স্কাইপিতে জেলা পর্যায়ের অনেক নেতাকে ডাকা হয় না। তাদেরকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয় না। এতে অনেক জেলায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন অনেক সিনিয়র ও অভিজ্ঞ নেতা। চাঁদপুর, ময়মনসিংহ আর ঈশ্বরদী এলাকায় বেশ কয়েকজন নেতা এ বিষয়ে সমকালের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একটি মহলের ইশারায় এখানেও বেছে বেছে নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। জেলার যেসব নেতা আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছেন, তাদেরকেও ওই বৈঠকে ডাকা হয়। কিন্তু যারা এতদিন দলের জন্য কাজ করেছেন; এখন তাদেরকে বৈঠক বিষয়ে অবহিত করা হয় না। এতে তৃণমূল পর্যায়ে তারা বিব্রত বোধ করছেন।
সমকাল