আন্দোলনে ব্যর্থতা, বিএনপিতে নানা প্রশ্ন

বিএনপি
বিএনপি

 

সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনে বিএনপি কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ যখন টানা চতুর্থ দফায় সরকার গঠন করেছে, তখন বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেকের মুখেই এমন আলোচনা। পাশাপাশি এত মামলা, গ্রেপ্তার, চাপ ও প্রলোভনের পরও দল ভাঙেনি এবং মানুষ ভোটে সেভাবে সাড়া দেয়নি; এটাকে সফলতা হিসেবে দেখছেন দলটির অনেকে।

টানা ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। এর মধ্যে এক যুগেরও বেশি সময় কেটেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। গত দেড় বছর দলটি ছিল সরকার হটানোর ‘এক দফার’ নানা কর্মসূচিতে। ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছেড়েছে বিএনপি। এরপর দীর্ঘ আন্দোলনে সরকারের পতন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন বা রাজনৈতিক পটপরিবর্তন—কোনোটিতেই সফল হয়নি দলটি। যদিও ২০২২ ও ২০২৩ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় সমাবেশসহ অনেকগুলো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেছে।

দেশের অন্যতম প্রধান এই রাজনৈতিক দলটির দেশব্যাপী সমর্থন ও শক্তি থাকার পরও আন্দোলন কেন বিফল হলো—এ প্রশ্ন এখন বিএনপির নেতা-কর্মীদের মুখে মুখে। এ নিয়ে গত এক সপ্তাহে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়।

এ প্রশ্নে তাঁদের কাছ থেকে বিভিন্ন রকম মূল্যায়ন বা পর্যবেক্ষণ পাওয়া গেছে। তাঁদের বেশির ভাগই মনে করেন, বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার প্রধান কারণ সরকার ও প্রশাসনের নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা, গ্রেপ্তার, জেল-জুলুম, বিচার ও শাস্তি প্রভৃতি। পাশাপাশি দলের নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং আন্দোলনে বিদেশনির্ভরতার কথাও বলেছেন অনেকে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে আন্দোলনে যুক্ত করার ক্ষেত্রেও বিএনপি সফল হয়নি, সেটা উল্লেখ করেছেন কেউ কেউ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসিন মনে করেন, বিএনপির নেতৃত্বের দুর্বলতা সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি সাংগঠনিক দুর্বলতাও আছে অনেক। এ ছাড়া আন্দোলনে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা কতটা ছিল, সে প্রশ্নও আছে।

একটি আন্দোলনকে যৌক্তিক পরিণতিতে নেওয়ার জন্য যে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি দরকার, সেটা বিএনপির নেতৃত্ব দক্ষতার সঙ্গে করতে পারেনি। বিশেষ করে, আন্দোলন ব্যর্থ করতে সরকার যেসব ব্যবস্থা ও কৌশল নিয়েছিল, তা মোকাবিলায় পাল্টা কৌশল বা প্রস্তুতি ছিল না বিএনপির নেতৃত্বের।

বিএনপির সঙ্গে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত বিভিন্ন দল ও জোটের অনেক নেতাও এমন কথা বলছেন। যদিও তাঁরা আন্দোলনে ব্যর্থতার জন্য বিএনপির নেতৃত্বের দুর্বলতার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশের ভূমিকা এবং সরকারের ‘ভয়ংকর’ দমননীতির কথা বলেছেন বেশি। তাঁরা বলছেন, দেড় যুগ ধরে সরকার বিএনপিসহ বিরোধী দলকে অমানবিক নির্যাতন, গ্রেপ্তার, মামলা ও বিচারের মধ্যে রেখেছে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র যেভাবে একজোট হয়ে গেছে, তা আগে দেখা যায়নি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও প্রবীণ রাজনীতিক সেলিমা রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ দেশের পুলিশ, বিচার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবাইকে অর্থসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কুক্ষিগত করে ফেলেছে। অসাধু কর্মকর্তাদের ভয়, বিএনপি ক্ষমতায় এলে তাদের সমস্যা হতে পারে; সে জন্য তারা বিবেকহীন হয়ে সরকারের পক্ষ নিয়েছে।’

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ মনে করেন, বিএনপি যে দমননীতির কথা বলছে, এর একটা বিকল্প ছিল কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে প্রশাসন বা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ‘নিরপেক্ষ’ করার জন্য চাপ তৈরি করা। কিন্তু বিএনপি সেটা করতে পারেনি। এই দীর্ঘ সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ তেমন কোনো যোগাযোগও স্থাপন করতে সক্ষম হয়নি। এ ছাড়া বাংলাদেশের নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পর সরকারকে চাপে ফেলার মতো একটা পটভূমি তৈরি হয়েছিল, বিএনপির নেতৃত্ব সে সুযোগও কাজে লাগাতে সমর্থ হয়নি।

এবারের নির্বাচন ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতায় রাজনীতিতে কিছুটা উত্তাপ তৈরি হয়েছিল। একদিকে ভারত, চীন ও রাশিয়া; অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ভিন্ন অবস্থানের বিষয়টি ছিল দৃশ্যমান। এবারই ভারত প্রকাশ্যে সরকারের স্থিতিশীলতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।

অবশ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান দিলারা চৌধুরী বিরোধী দলের এবারের আন্দোলনকে একটু ভিন্নভাবে দেখেন। এ প্রসঙ্গে তিনি একদিকে ভারত, চীন, রাশিয়া; অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কথা উল্লেখ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি নিয়ে ভূরাজনীতি জটিল জায়গায় যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, যত দিন চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটা বোঝাপড়া না হচ্ছে, তত দিন ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক রাখতেই হবে। আপাতদৃষ্টে বিএনপির আন্দোলন বা ভবিষ্যৎ এই ফাঁদে পড়ে গেছে।’

বিদেশনির্ভরতা

বিএনপির অনেকে মনে করেন, আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার আরেকটি বড় কারণ বিদেশনির্ভরতা। বিশেষ করে, পুরো আন্দোলনে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল বিএনপির নেতৃত্ব। নেতা-কর্মীদের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি করা হয়েছিল যে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাসহ জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে এমন কিছু পদক্ষেপ আসবে, তাতে সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান, বক্তব্য ও বিবৃতি বিএনপিকে আশাবাদী করে তুলেছিল।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির মধ্যম সারির একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ‘নেতারা এমন ভাব দেখিয়েছেন যে ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে বিএনপির ভালো বোঝাপড়া আছে। বাস্তবে ইউরোপ-আমেরিকা সরকারের নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে শক্তভাবে বলেছে। সেটা বিএনপির পক্ষে গেছে। কিন্তু তারা তো বিএনপির পক্ষে কথা বলেনি।’

যদিও বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা আন্দোলনে বিদেশের ওপর নির্ভরশীলতার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেন না। বরং তাঁরা এ ক্ষেত্রে সরকারি দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অতিমাত্রায় ভারত নির্ভরশীলতার অভিযোগ করেন। বিএনপির নেতারা মনে করেন, ভারতের সমর্থন এ সরকারকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে।

বাংলাদেশের সদ্য সমাপ্ত ‘একতরফা’ দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ‘ভারত পরিষ্কার হস্তক্ষেপ করেছে’ বলে মন্তব্য করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা সেলিমা রহমান।

অবশ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বিরোধী দলের আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার তিনটি কারণ নির্দিষ্ট করেছেন। প্রথমত, বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো সরকার এত বছর একচ্ছত্র ক্ষমতায় ছিল না। বিচারব্যবস্থা, পুলিশ ও প্রশাসনকে সর্বাত্মকভাবে ব্যবহার করার সক্ষমতা এবং দৃঢ় ইচ্ছা অতীতে কোনো সরকারের মধ্যে এতটা দেখা যায়নি।

দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধ, চীনের সঙ্গে রাশিয়ার নতুন সম্পর্ক—এই পরিস্থিতিও বিরোধী দলের আন্দোলনের বিপক্ষে চলে গেছে। তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় থাকাকে ভারত নিজেদের অখণ্ডতা রক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত করে ফেলেছে। এই তিনটি বিষয়কে এড়িয়ে শুধু আন্দোলনের ব্যর্থতা খোঁজা সঠিক হবে না।

অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমি এই আন্দোলনকে বিএনপি বা বিরোধী দলের ব্যর্থতার চেয়ে সরকারের দমন করার শক্তির বিজয় হিসেবে দেখতে চাই।’

গুরুত্বপূর্ণ পক্ষগুলোর অনুপস্থিতি

অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, যেকোনো বৃহত্তর আন্দোলন বা পটপরিবর্তনে ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবীদের মুখ্য ভূমিকা থাকে। বিএনপি বা বিরোধী দলের আন্দোলনে এই তিন শ্রেণির উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল না। ঢাকা শহরে এর প্রভাব বিশেষভাবে দেখা গেছে। এই ঘাটতির পাশাপাশি আরেকটি বিষয় এখন আলোচনায়, সেটা হচ্ছে রাজনৈতিক পথচলায় বিএনপি তার আদর্শিক জায়গা থেকে দূরে চলে গেছে কি না। এ প্রশ্নটি রাজনৈতিক বিশ্লেষক বা পর্যবেক্ষকদের মধ্যেও আছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিএনপি একটি মধ্যপন্থী দল হিসেবে পরিচিত। ‘ডানপন্থীর বামে, বামপন্থীর ডানে’ বলে বিএনপির যে রাজনৈতিক অবস্থান ছিল, সেটি দলটির সাম্প্রতিক বছরগুলোর কার্যক্রমে অনুপস্থিত ছিল। এ ক্ষেত্রে বিএনপি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের পথে অনেকটা হেঁটেছে বলে দলের ভেতরে-বাইরের অনেকের অভিযোগ। বিশেষ করে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে। বিএনপির নেতৃত্ব ভারতের আস্থা অর্জনে অনেক চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত সেটা হয়নি।

এ ছাড়া ভোটের হিসাবে ইসলামপন্থী বা এই ভাবধারার লোকজনের একটি অংশকে বিএনপির জনসমর্থনের মূল ভিত্তি ধরা হয়। গত কয়েক বছরে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় ইসলামি অনেকগুলো দল বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে যায়। আবার কোনো কোনো দলকে এড়াতে গিয়ে বিএনপি জোট ভেঙে দেয়। বিপরীতে আওয়ামী লীগ নানা কৌশলে অনেক ইসলামি দলকে কাছে টেনেছে। এর ফলে বিএনপি বৃহত্তর আন্দোলন গড়ার কথা বললেও সে অর্থে আন্দোলন সামগ্রিক রূপ পায়নি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আন্দোলনে বিএনপি ইসলামপন্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক করতে চায়নি পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারতের আস্থা পাওয়ার জন্য। কিন্তু দলটির এই কৌশল কাজে লাগেনি। বিএনপি ও ইসলামপন্থীদের মধ্যে ‘অবিশ্বাস’ ও ‘অনাস্থা’ তৈরি হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে একটি তথাকথিত প্রগতিশীল গ্রুপ আছে। বিএনপি যে একটি ‘সেন্টার রাইট’ দল, সেটা তারা ধরতে দেয় না। তারা নিজেরাই জানে না কোন পথ নেবে। তাদের নেতৃত্বের মধ্যে একটা আদর্শিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব প্রায়ই প্রকাশ পায়, এটা বিএনপির একটা বড় সমস্যা।

তিনবার আন্দোলনে হোঁচট

২০২২ সালের জুলাই থেকে দেড় বছর টানা আন্দোলন-কর্মসূচিতে ছিল বিএনপি। এর মধ্যে অন্তত তিনবার কর্মসূচিতে সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পায়। আন্দোলনে প্রথম ধাক্কা আসে ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর, ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপি বিভাগীয় সমাবেশের কর্মসূচি নিয়ে। ওই সময় অনেক হামলা, বাধা, প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও দলটি সারা দেশে বিভাগীয় পর্যায়ে বড় বড় সমাবেশ করে কর্মী-সমর্থকদের উজ্জীবিত করে। এরপর ঢাকার সমাবেশ নয়াপল্টনে করার জেদ ধরে বিএনপি। এ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নিলে নয়াপল্টনে পুলিশের গুলিতে স্বেচ্ছাসেবক দলের একজনের মৃত্যুসহ অসংখ্য নেতা-কর্মী আহত হন। ৭ ডিসেম্বর রাতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে আটক করা হয়। সে সময় প্রায় চার শ নেতা-কর্মীকে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে আটক করে জেলে পাঠানো হয়। শেষ পর্যন্ত বিএনপি গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করে। কার্যত এ ঘটনায় সে দফায় আন্দোলন অনেকটাই দুর্বল হয়ে যায়।

আবার আন্দোলন চাঙা করতে আরও সাত মাস সময় লাগে বিএনপির। সারা দেশে নতুনভাবে কর্মসূচি পালন করে দ্বিতীয় দফায় গত বছরের ২৮ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশ করে দলটি। ওই মহাসমাবেশ থেকে পরদিন ২৯ জুলাই ঢাকার চার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে প্রথম সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পায়। যার কারণে আগের দিন মহাসমাবেশে লাখো মানুষের জমায়েত হলেও পরদিনের অবস্থান কর্মসূচিতে কয়েক হাজার নেতা-কর্মীও উপস্থিত করতে পারেনি বিএনপি। পরে জানা যায়, দেশে থাকা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের কারও সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই লন্ডন থেকে ওই কর্মসূচির সিদ্ধান্ত আসে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক নেতা জানান, ২৯ জুলাইয়ের ব্যর্থতার ওই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে নতুন করে একেবারে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় পর্যন্ত তিন মাস ধরে দফায় দফায় নানা কর্মসূচি করতে হয়। আন্দোলন চূড়ান্ত ধাপে নিতে ২৮ অক্টোবর আবার ঢাকায় মহাসমাবেশ ডাকা হয়। কিন্তু সংঘাত ও সহিংসতায় পড়ে সেই মহাসমাবেশ পুলিশের অভিযানে পণ্ড হয়ে যায়। মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর বিএনপি এবং জোটের শরিকদের মধ্যে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়। তাদের অভিযোগ, মহাসমাবেশ ঘিরে বিএনপির নেতৃত্বের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ পণ্ড করা বা এ নিয়ে সরকারের ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় আলোচনা হয়। কিন্তু মহাসমাবেশের নিরাপত্তার জন্য কোনো জায়গায় দলের পক্ষ থেকে কোনো স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়নি। পরে এ নিয়ে বিএনপির ভেতরে প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্ন তোলে জোটের শরিকেরাও।

২৮ অক্টোবরের পর সারা দেশে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযান শুরু করে। দল দুটির পৃথক হিসাব অনুযায়ী, ২৮ অক্টোবরের তিন-চার দিন আগে থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত গত আড়াই মাসে প্রায় ২৭ হাজার নেতা-কর্মীকে (বিএনপি সাড়ে ২৩ হাজার, জামায়াত ৩ হাজার ৪৬৬ জন) গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

বিএনপি ও সমমনা জোটের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, এবারের আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন আট বছরের বেশি সময় ধরে ভারতে অবস্থানরত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। দেশের বাইরে থেকে তাঁর এই দায়িত্ব পালন নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। সালাহউদ্দিনের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার রাতে ফোনে যোগাযোগ করা হলে, তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি।

সর্বশেষ সমন্বয়হীনতার অভিযোগ ওঠে, সরকারকে ‘অসহযোগিতার’ আহ্বান নিয়ে। লন্ডন থেকে তারেক রহমান দেশবাসীকে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল না দিয়ে সরকারকে অসহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ কর্মসূচি সম্পর্কে জোটের নেতারা, এমনকি দেশে থাকা বিএনপির অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাও জানতেন না বলে জানা গেছে। টানা অবরোধ-হরতালের কর্মসূচি ঢিলেঢালা হয়ে আসার মধ্যেই হঠাৎ করে ‘অসহযোগের’ আহ্বান কার পরামর্শে, সে প্রশ্ন ওঠে দলে ও জোটে।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো আন্দোলনে-কর্মসূচিতে কমবেশি দুর্বলতা থাকবে। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রশক্তিকে দলীয় শক্তিতে পরিণত করা হয়েছে এবং এর একচেটিয়া ব্যবহার হচ্ছে। এটা নতুন বাস্তবতা। এর মোকাবিলায় বিরোধী দলগুলোকে বাস্তবতা উপযোগী কর্মপন্থা নিয়ে ভাবতে হবে। গণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করে যেকোনো মূল্যে মাঠে থাকতে হবে।

এ বক্তব্যের সঙ্গে বিএনপির নেতাদের খুব একটা দ্বিমত নেই। তবে নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি কীভাবে এগোবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

প্রথম আলো