- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৯ ডিসেম্বর ২০২২, ১৭:০৪
ফ্রান্সের পরিকল্পনার ফসল এমবাপ্পে, পোগবারা। খনি থেকে কয়লা তোলেন ফুটবল শ্রমিকরা। যে জ্বালানি বছরের পর বছর একই গতিতে ছোটাবে জাতীয় দলকে। কয়লা খনি থেকেই পাওয়া যায় এমবাপের মতো হিরে। ফুটবলে ফ্রান্সের ধারাবাহিক সাফল্যের পিছনে রয়েছে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা।
১৯৯৮ সালে প্রথম বার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগে পর পর দু`বার বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি ফ্রান্স। তার আগে বিশ্বকাপে ফ্রান্সের সেরা পারফরম্যান্স ছিল ১৯৮৬ এবং ১৯৫৮ সালে তৃতীয় স্থান। ১৯৯৮ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকে বদলে গিয়েছে ফ্রান্সের ফুটবল। যে বদলের হাত ধরে ২০১৮ সালে চ্যাম্পিয়ন এবং ২০০৬ সালে রানার্স হয়েছিল তারা। কী ভাবে বদলে গেল ফ্রান্সের ফুটবল?
এক দিনে নয়। বরং দীর্ঘ পরিকল্পনার ফসল ফ্রান্সের ফুটবলের পরিবর্তন। যে পরিবর্তনের হাত ধরে শেষ সাতটি বিশ্বকাপের চারটিতেই ফাইনালে উঠল তারা। ফ্রান্সকে বলা হয় আধুনিক ফুটবলার তৈরির কারখানা। প্রতি বছর বিশ্বমানের নতুন ফুটবলার তুলে আনাই লক্ষ্য ফ্রেঞ্চ ফুটবল ফেডারেশনের। সারা বছর ফেডারেশনের প্রতিনিধিরা ঘোরেন দেশের প্রান্তে প্রান্তে। যে কোনো ফুটবল প্রতিযোগিতার কথা শুনলেই তারা চলে যান দেখতে। যদি কোনো প্রতিভার খোঁজ পাওয়া যায়। কাউকে চোখে পড়লে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ফুটবল স্কুলে। ঠিক যেভাবে প্যারিসের উত্তর শহরতলির একটি উদ্বাস্তু শিবির থেকে খুঁজে আনা হয়েছিল কিলিয়ন এমবাপ্পে, পল পোগবাকে।
এমবাপ্পে বড় হয়েছেন ছোট্ট একটি ঘরে। সেই উদ্বাস্তু শিবিরের এক তৃতীয়াংশ মানুষই ছিলেন দারিদ্র্যসীমার নিচে। এই ধরনের শিবিরগুলিতে সাধারণভাবে অপরাধপ্রবণ মানুষের বসবাস বেশি হয়। ফ্রান্সের ফুটবল কর্তারা এই দু`টি বিষয়কে কাজে লাগিয়েছেন ইতিবাচকভাবে। দরিদ্র পরিবারের অভিভাবকরা সহজেই অনুমতি দেন সন্তানদের ফুটবল স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পাশাপাশি ফুটবল থেকে রোজগারের সুযোগ অপরাধ প্রবণতা কমায়। আরো শিশুদের খেলার প্রতি আকৃষ্ট করে।
শুধু প্রতিভা খুঁজে বার করলেই তো হবে না। তাদের প্রতিপালনের জন্য দরকার নির্দিষ্ট পরিকল্পনা। প্যারিসের উপকণ্ঠে গড়ে তোলা হয়েছে ১৪টি ফুটবল স্কুল। রয়েছে প্রায় ১০০টি ক্লাব। স্কুল শেষ হওয়ার পর ক্লাবের জন্য চিন্তা করতে হয় না। স্কুলগুলি থেকেই পছন্দের ফুটবলারদের বেছে নেয় ক্লাবগুলি। অনেকটা ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ের আদলে খেলা শেখার পর রোজগারের জন্য চিন্তা করতে হয় না উঠতি ফুটবলারদের। এমবাপ্পের প্রথম ক্লাব এএস বন্ডি তেমনই একটি ক্লাব। যেখান থেকে তাকে নেয় মোনাকো। এই পরিকল্পনার সুবাদে ফ্রান্সের উদ্বাস্তু শিবিরের অভিভাবকরা অনেকেই মনে করেন পড়াশোনার থেকে ফুটবল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই সন্তানদের তারা স্কুলে না পাঠিয়ে খেলার মাঠে পাঠান।
এমবাপ্পে ফ্রান্সের এই প্রকল্প বা পরিকল্পনার উদাহরণ মাত্র। এ ভাবেই প্রতি বছর কয়েক ডজন ফুটবলার তুলে আনে ফ্রান্স। ২০০২ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপ খেলা প্রায় ৬০ জন ফুটবলার উঠে এসেছেন প্যারিসের শহরতলির বিভিন্ন জায়গা থেকে। সকলের সাথে এমবাপেকে এক করে দেখতে চান না ফ্রান্সের ফুটবল কর্তারা। তাঁদের মতে, এমপাবে বিরল প্রতিভা। একটা প্রজন্মে এমন ফুটবলার এক জনই হয়।
ফ্রান্সের ফুটবল কর্তারা হিরে খোঁজেন না। তাঁরা খনি থেকে কয়লা তোলেন। যে কয়লা জাতীয় ফুটবল দলের জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হবে। বছরের পর বছর একই গতিতে ছুটবে জাতীয় দল। সেই কয়লা খনি থেকেই এমবাপের মতো হিরে খুঁজে পাওয়া যায়। সে জন্যই প্রতি বিশ্বকাপে বা ইউরো কাপে ফ্রান্সের পারফরম্যান্সের নির্দিষ্ট মান বজায় থাকে।
ফুটবল বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলেন, ফ্রান্স হল আধুনিক ফুটবলের সব থেকে বড় এবং সেরা কারখানা। ফ্রান্সকে শুধু সেরা ফুটবলার উৎপাদক বললে ভুল বলা হয়। বিশ্বের সেরা ফুটবলার রফতানিকারকও ফ্রান্স। কারণ প্রতি বছর ফ্রান্স যত ফুটবলার তৈরি করে সকলকে জাতীয় দলে সুযোগ দেয়া সম্ভব নয়। সকলের ফ্রান্সের জার্সি গায়ে দেয়ার দক্ষতা বা যোগ্যতা হয়তো থাকে না। সেই সব ফুটবলাররা চলে যান অন্য দেশে। যেখানে গেলে আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলার সুযোগ পাবেন। এর সব থেকে বড় উদাহরণ কাতার বিশ্বকাপ। ফ্রান্স ছাড়া অংশগ্রহণকারী আরো ৮টি দেশের হয়ে খেলেছেন ৩৭ জন ফুটবলার। যারা বড় হয়েছেন প্যারিসের শহরতলির ফুটবল স্কুলগুলিতে।
এই ফুটবলাররা শুধু ফ্রান্সের ফুটবলকেই বদলে দেননি, বদলে দিয়েছেন উদ্বাস্তু শিবিরগুলির অর্থনীতিকেও। সফল ফুটবলাররা বিপুল অর্থ আয় করেন। সেই অর্থের অনেকটাই তারা নিজেদের ছোট বেলার এলাকার উন্নতির জন্য দান করেন। আর্থিক সাহায্য করেন বন্ধু, প্রতিবেশীদেরও। তারা তাদের ছোট বেলার স্কুল বা ক্লাবকেও অর্থ সাহায্য করেন। তাতে সার্বিক ভাবে উন্নত হয় ফুটবল কারখানার পরিকাঠামোও।
ফ্রান্সের এই ফুটবল বিপ্লব নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। ফ্রান্সের মতো করেই ফুটবলার তুলে আনার চেষ্টা করছে বিভিন্ন দেশ। ফ্রান্স এই প্রকল্প শুরু করেছিল প্রথম বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে। অন্য দেশগুলি এই পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও ফ্রান্সের কাছাকাছি পৌঁছতে আরো সময় লাগবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।