আদানির তর্জন-গর্জনের পেছনে শুধুই কি বকেয়া

আদানির তর্জন-গর্জনের পেছনে শুধুই কি বকেয়া

নভেম্বরের শুরু থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে ভারতের আদানি গ্রুপ। কোম্পানিটি দাবি করছে, বকেয়া ৮৫ কোটি ডলার আদায়ে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আদানির এই কার্যক্রমকে শুধুই বকেয়া আদায়ের পদক্ষেপ হিসেবে দেখতে নারাজ বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। রেল ও সড়কে ভারতীয় ঋণ ও উদ্যোগে চলমান একাধিক প্রকল্পের কাজ আটকে আছে। প্রতিবেশী দেশটির ব্যবসায়ীরা গুটিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসা। সাধারণ ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে। আদানির বিদ্যুৎ কমানো সেই ধারাবাহিকতারই অংশ হতে পারে। কারণ গ্রুপটি ভারতের মোদি সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। আর নরেন্দ্র মোদির পরামর্শেই শেখ হাসিনা আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করেছেন।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য পর্যালোচনা করেও বিশ্লেষকদের মতামতের সত্যতা মেলে। আদানির বকেয়ার প্রায় পুরোটাই শেখ হাসিনার সরকারের আমলের। গত জুলাই পর্যন্ত আদানির পাওনা ছিল ৮০ কোটি ডলার। তখন এভাবে সরবরাহ কমানো হয়নি। বরং অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই বিল দেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। গত অক্টোবরে আদানিকে বাংলাদেশ দিয়েছে ৯ কোটি ডলার, যা গত কয়েক মাসের সর্বোচ্চ। তার পরও কমানো হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ।

অসম চুক্তির ফাঁদে বাংলাদেশ
২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথম বাংলাদেশ সফরের সময় তাঁর ঘনিষ্ঠ দুই ব্যবসায়ী রিলায়েন্স ও আদানির জন্য বিদ্যুৎ ব্যবসার বিষয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করেন। মোদির সফরের দুই মাসের মাথায় আদানি পাওয়ারের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের ভেতরেই একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র করার প্রস্তাব ছিল আদানির। তবে সমঝোতার দু’বছর পর ২০১৭ সালে ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডা জেলায় ১ হাজার ৪৯৮ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি হয়।

চুক্তি অনুযায়ী, এই কেন্দ্র থেকে ২৫ বছর বিদ্যুৎ কিনবে পিডিবি। দীর্ঘমেয়াদি এই চুক্তির পরতে পরতে ছিল অসমতা। চুক্তিতে এমন অনেক শর্ত আছে, যেগুলোর কারণে ২৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা বাড়তি নিয়ে যাবে আদানি। চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ তিন মাস পরপর কত বিদ্যুৎ নেবে, তা আগেই ঘোষণা করতে হবে। যদি বাংলাদেশ এর চেয়ে কম বিদ্যুৎ নেয়, তাহলেও ঘোষিত পরিমাণের সমান দাম পরিশোধ করতে হবে। অথচ বাংলাদেশে যেসব বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে, সেগুলোর সঙ্গে এমন কোনো শর্ত নেই।

চুক্তি অনুযায়ী, এই কেন্দ্র থেকে পিডিবি কখনোই ৩৪ শতাংশের নিচে বিদ্যুৎ নিতে পারবে না। কম বিদ্যুৎ নিলে ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে যত কয়লা ব্যবহার করা হতো, তার দাম ও কয়লা পরিবহন খরচের অর্থ দিতে হতো। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার পরিমাণ, ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বেশি ধরা হয়েছে। আদানির সঙ্গে চুক্তিতে কয়লার সিস্টেমলস ধরা হয়েছে ১ দশমিক ১০ শতাংশ; দেশের অন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রর চুক্তিতে এমন বিধান নেই। দেরিতে বিল পরিশোধের জন্য বছরে ১৫ শতাংশের সুদ ধরা আছে আদানির চুক্তিতে, যা পায়রার বিদ্যুৎকেন্দ্রে নেই।

গত অর্থবছর আদানির কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে প্রায় ৮১৬ কোটি ৬৬ লাখ ৭৭ হাজার ইউনিট। এই বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ পড়েছে ৬ টাকা ৬০ পয়সা এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচলন (ওঅ্যান্ডএম) খরচ ১ টাকা। জ্বালানি (কয়লা) খরচ প্রতি ইউনিটের জন্য ৭ টাকা ৫৪ পয়সা। অর্থাৎ আদানির বিদ্যুৎ কেনায় গড়ে ব্যয় হয়েছে ১৫ টাকা ১৪ পয়সা। চুক্তিতে অসম সুবিধার জন্য আদানির ওঅ্যান্ডএম ব্যয়ও অন্য কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রর চেয়ে বেশি দিতে হচ্ছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, আদানির চুক্তির সবখানেই বাংলাদেশের স্বার্থ লঙ্ঘিত হয়েছে। এই চুক্তি বাতিল করতে হবে।

কয়লায় গচ্চা ৩ হাজার কোটি
রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আদানির কয়লার দাম বেশি, মানও খারাপ। অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা কেনায় সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ ছাড় মিললেও আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে তা পাচ্ছে না পিডিবি।

২০২৩ সালের জুন থেকে এই বছরের জুন পর্যন্ত প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার দাম গড়ে পায়রা নিয়েছে ৬ টাকা ৭৪ পয়সা, রামপাল ৭ টাকা ৯২ পয়সা। একই সময়ে আদানির দাম পড়েছে গড়ে ৮ টাকা ১৫ পয়সা। অর্থাৎ পায়রার চেয়ে ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ৪১ পয়সা, রামপালের চেয়ে ২৩ পয়সা বেশি নিয়েছে আদানি। এই হিসাবে ১৫ মাসে শুধু কয়লার দামেই প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বাড়তি নিয়েছে ভারতীয় কোম্পানিটি।

বর্তমানে প্রতি টন ৪ হাজার ৬০০ কিলোক্যালরির কয়লা ৯০ ডলারে কিনছে আদানি। অন্যদিকে, একই মানের কয়লা পায়রা কিনছে ৬৮ ডলারে। সে হিসাবে প্রতি টনে ২০ থেকে ২২ ডলার বেশি নিচ্ছে আদানি।

পিডিবির একজন সাবেক প্রকৌশলী বলেন, পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে পিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে কয়লা কেনায় ছাড়ের বিষয়টি রয়েছে। পায়রা ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা কেনার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে দামে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় পায়, যার সুবিধা প্রকৃতপক্ষে পিডিবি ভোগ করে। রামপালও বছরজুড়ে কয়লা কেনার সময় ছাড়ের শর্তেই চুক্তি করে। আদানি নিজের খনির কয়লা সরবরাহ করে। তার চুক্তিতে ছাড়ের বিষয়টি নেই। ফলে কয়লার দাম বেশি নিচ্ছে ভারতীয় কোম্পানিটি।

পিডিবির কর্মকর্তারা আরও জানান, অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লার কেনা দাম ধরেই বিল করে। তবে চুক্তি অনুসারে আদানির আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার সূচকের (কোল ইনডেক্স) গড় মূল্য হিসাব করা হবে। গড় দাম ধরার কারণে আদানির বিল বাড়তি আসছে। তারা বলেন, আন্তর্জাতিক দুই সূচকে বিভিন্ন মানের (ক্যালরিফিক ভ্যালু) কয়লার দাম প্রকাশ করা হয়। দুই সূচকে উন্নতমানের (৪৬০০-৬০০০ কিলোক্যালরি) কয়লার দাম ধরে তার গড় হিসাব করে আদানি। তবে তারা যে মানের কয়লা ব্যবহার করছে, সেটির দাম হিসাব করলে প্রতি টনে দর ২০ থেকে ২৫ ডলার কমবে।

আদানির হুমকি
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ ৬০ শতাংশের বেশি কমিয়েছে আদানি। গত ৩১ অক্টোবর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমানো শুরু করে কোম্পানিটি। ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিচ্ছিল ভারতীয় গ্রুপটি। ৩১ অক্টোবর তা কমে আসে ৫০০ মেগাওয়াটে। পরে অবশ্য তা বেড়ে ৭০০-৭২০ মেগাওয়াট হয়। এর পর ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭ নভেম্বরের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ না করলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করবে আদানি। যদিও কোম্পানিটি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এমন হুমকির কথা অস্বীকার করে বলে, তারা পিডিবির সঙ্গে সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। তবে ৭ নভেম্বর রাত ৯টার পরই সরবরাহ ৫০০ মেগাওয়াটে নেমে আসে। গত শনিবার বিকেল ৫টায় আদানি বাংলাদেশকে ৫১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেয়।

এদিকে সোমবার দ্য হিন্দুর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানির বকেয়া পরিশোধে হাসিনা সরকারকে ২০০ কোটি ডলার ঋণ দিতে চেয়েছিল ভারত সরকার। এই ঋণের ওপর প্রায় ২ শতাংশ সুদ ভর্তুকি দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনায় ছিল। তবে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আলোচনা ভেস্তে গেছে।

চলতি মাসের শুরু থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে ভারতের আদানি গ্রুপ। কোম্পানিটি দাবি করছে, বকেয়া ৮৫ কোটি ডলার আদায়ে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

কারা কী বলছেন
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ সমকালকে বলেন, আদানির চুক্তির কোনো প্রয়োজন ছিল না। একটি অন্যায্য চুক্তি জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আদানি তো চুক্তি অনুসারে সুযোগ নেবেই। তিনি বলেন, সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার পেছনে রাজনৈতিক চাপ থাকতেই পারে। তাই সরকারের উচিত কীভাবে দ্রুত এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তা খতিয়ে দেখা।

অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সমকালকে বলেন, আদানির বকেয়া পরিশোধের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ সরবাহ কমিয়ে আদানি সরকারকে চাপ দিতে চায় কিনা– এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, আমরা এসবে উদ্বিগ্ন না। আদানি সরবরাহ কমালে বিকল্প উপায় আছে। কয়লার বাড়তি দামসহ বিভিন্ন অসম ধারার কারণে অনেকেই আদানির চুক্তির বাতিল চাইছে– এমন প্রশ্নে ফাওজুল কবির বলেন, একটি শক্তিশালী কমিটি আদানিসহ ১৩টি প্রকল্প খতিয়ে দেখছে। তারা যে সুপারিশ করবে, সরকার সে অনুসারে ব্যবস্থা নেবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here