তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেছিলেন, ‘শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখা ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপদ শিক্ষাজীবন নিশ্চিত করার স্বার্থে সব মতের প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ছাত্রদলের সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে।’
আমি যদি একটা সিট না দিই, …তোদের কোন বাপ সিট দেবে? ম্যাডামরা দেবে? ক্ষমতা আছে ম্যাডামদের?
তামান্না জেসমিন, সভাপতি, ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ
ছাত্রলীগের কাছে গত মে মাসে দুই দফা মার ‘হজম’ করার পরও দমে যায়নি ছাত্রদল। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কড়া পাহারার মধ্যেও তারা ‘সুযোগ’ খুঁজছিল। ফুল-মিষ্টি নিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার চেষ্টাকেও তাই ‘ভালো লক্ষণ’ নয় বলে মনে করেছে ছাত্রলীগ। তাই ক্যাম্পাসে ঢোকার পথেই পিটিয়ে আহত করা হয়েছে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের। তবে সবার চোখের সামনে বেদম মারধর করার পর ছাত্রলীগ ঘটনাটিকে ‘ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বহিঃপ্রকাশ’ বলে উল্লেখ করেছে। ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেনের এই বক্তব্যকে ‘মুখ ফসকে বলে ফেলা কথা’ ভাবলে ভুল হবে। ভিডিও ফুটেজে যে সত্যই বেরিয়ে আসুক না কেন, তিনি ‘অন্তরের বিশ্বাস’ থেকেই কথাটি বলেছেন।
গত কয়েক দিন বেশ ব্যস্ত সময় যাচ্ছে ছাত্রলীগের। কোথাও ছাত্রদল বা অন্যদের সামলাতে হচ্ছে, কোথাও ঘরের শত্রু ‘বিভীষণকে’ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ইডেন কলেজে ছাত্রলীগেরই একটি প্রভাবশালী পক্ষ নিজেদের কমিটিরই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে পিটিয়ে ‘ছাত্রদলের মতো’ ক্যাম্পাস ছাড়া করেছে। মাসখানেক আগে ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিনের একটি অডিও রেকর্ড কে বা কারা ফাঁস করেছিল। অডিও রেকর্ডে তাঁকে বলতে শোনা গেছে, ‘ইডেন কলেজের প্রেসিডেন্টের ওপরে আর কেউ নাই।’ ওই সময় ফাঁস হওয়া আরেকটি অডিও রেকর্ডে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি যদি একটা সিট না দিই, …তোদের কোন বাপ সিট দেবে? ম্যাডামরা দেবে? ক্ষমতা আছে ম্যাডামদের?’
তবে এত ক্ষমতাবান সভাপতিকে কেন ছাত্রলীগের আরেকটি পক্ষ ‘তাড়িয়ে’ দিল, সেটি নিশ্চয়ই একদিন পুরোপুরি জানা যাবে। তবে আপাতত ছাত্রলীগের নেত্রীরা যা বলেছেন, সেটিও ভয়াবহ। নিজ সংগঠনের কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে তাঁরা চাঁদাবাজি, আসন-বাণিজ্য ও ছাত্রীদের দিয়ে জোর করে অনৈতিক কাজ করানোর অভিযোগ এনেছেন।
অবশ্য ইডেনের ছাত্রলীগের নেত্রীরা দাবি করতে পারেন, চাঁদাবাজি, সিট–বাণিজ্য আর টেন্ডারবাজি করা ‘অপরাধ’ হলে এর দায় তারা এককভাবে নেবেন কেন। দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাদের তাহলে কী হবে?
ঢাকায় ছাত্রলীগের ছেলে ও মেয়েরা যখন প্রতিপক্ষ ও দলীয় পক্ষকে মোকাবিলা করছেন, তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগও বসে নেই। নিজেরা নিজেরা মারামারি করে এই সেপ্টেম্বর মাসেই তিন দিন বিশ্ববিদ্যালয় ‘অচল’ করে দিতে পেরেছেন। আর গত দেড় মাসে নিজেরা সংঘর্ষে জড়িয়েছেন সাতবার। ক্যাম্পাসে ছাত্রী হেনস্তা ও যৌন নিপীড়নের ঘটনায় নাম এসেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের।
‘ক্ষমা ও সাবধান’
বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও চাঁদাবাজির অভিযোগে সমালোচনার মুখে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরিয়ে দেওয়া হয় রেজওয়ানুল হক চৌধুরী ও গোলাম রাব্বানীকে। চাঁদাবাজির অভিযোগে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুজন নেতার একসঙ্গে পদ হারানোর ঘটনা সংগঠনটির দীর্ঘ ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি।
ওই দুজনের জায়গায় নেতৃত্বে আসেন আল নাহিয়ান খান ও লেখক ভট্টাচার্য। এখন তাঁরাই ছাত্রলীগ চালাচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা নানা অভিযোগ তুলেছেন।
আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ। এখন এই সংগঠন দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। ছাত্রলীগের কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে ওই চার নেতার কাছে বিচার যায়।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগ নেতাদের সতর্ক করে বক্তব্য দেন। তিনি নিজেও দুই দফায় ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০১৫ সালের আগস্ট মাসে র্যাব ও পুলিশের পৃথক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ঢাকা ও মাগুরায় একই দিনে ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক দুই নেতা নিহত হন। তাঁদের দুজনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ ছিল। দুই ছাত্রলীগ নেতা নিহত হওয়ার পর ওবায়দুল কাদের তখন বলেছিলেন, ‘অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। খুব দ্রুত এই প্রবণতা (অপরাধ) কমে যাবে। ইতিমধ্যে তারা (ছাত্রলীগ) বার্তা পেয়ে গেছে।’ তিনি আরও বলেছিলেন, কেউ খারাপ কাজ করলে দল তাকে ছাড় দেবে না।
আজকের জন্য ক্ষমা করলাম। ভবিষ্যতের জন্য সাবধান করলাম।
ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক
তবে ছাত্রলীগ যে বার্তা পায়নি, সেটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের আগ্রাসী মনোভাবের মধ্যেই প্রকাশ পায়। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘাতে জড়ায় ছাত্রলীগ। তখন জন্ম হয় ‘হেলমেট বাহিনীর’। এই বাহিনীর যাঁদের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে, তাঁরা ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত। যদিও হেলমেট বাহিনীর কারও বিচার হয়নি।
ছাত্রলীগে শৃঙ্খলা যে ফেরেনি, সেটি সংগঠনের নেতা-কর্মীদের আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের নেতাদের ওপর তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সময় ও শৃঙ্খলার বিষয়ে সচেতন হতে কঠোর বার্তা দিয়ে তাঁদের তিনি বলেছিলেন, ‘আজকের জন্য ক্ষমা করলাম। ভবিষ্যতের জন্য সাবধান করলাম।’
কেউ বকরকে মনে রাখেনি
মৃত্যুর পর বিখ্যাত মানুষদের কথাই এখন আর কেউ বেশি দিন মনে রাখতে পারে না। সেখানে আবু বকরের কথা কে মনে রাখবে! টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার গোলাবাড়ী গ্রামের এই তরুণ পড়তে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক যুগ আগে তাঁর নির্মম মৃত্যু আলোড়ন তুলেছিল দেশজুড়ে। একইভাবে আলোড়ন তুলেছিল বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাটিও। তাঁকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন ছাত্রলীগের কিছু নেতা–কর্মী। আর বকরের নিহত হওয়ার ঘটনাতেও নাম এসেছে ছাত্রলীগের।
২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাতে স্যার এ এফ রহমান হলে সিট দখল নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় গুরুতর আহত হয়েছিলেন আবু বকর। এর এক দিন পর তিনি মারা যান। পরে এই ঘটনায় করা হত্যা মামলায় ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের আসামি করা হয়। তবে বিচারে সব আসামি খালাস পেয়ে যান।
বকর হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হয় ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে। যদিও বিষয়টি জানাজানি হয় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের (আবু বকরকে কেউ খুন করেনি!) মাধ্যমে। কে বা কারা আবু বকরকে হত্যা করেছে, বিচারে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। হত্যাকারী চিহ্নিত করার মাধ্যমে বিচার নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালতে আপিল করার যে সুযোগ ছিল, তা-ও রাষ্ট্রপক্ষ নেয়নি। ফলে নিহত ব্যক্তির পরিবার বিচার পাওয়ার অধিকার থেকেই বঞ্চিত রয়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে আবু বকর তৃতীয় সেমিস্টার পর্যন্ত সিজিপিএ-৪-এর মধ্যে ৩.৭৫ পেয়েছিলেন। ওই বিভাগে তাঁর আগে এমন ভালো ফল কেউ করেননি। অথচ তাঁর করুণ মৃত্যু হলো ছাত্রলীগের দুই পক্ষের হানাহানিতে।
২০১০ সালে বকরের মৃত্যুর পরও বিভিন্ন ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নিজেদের মধ্যেই সংঘর্ষে জড়াচ্ছিল ছাত্রলীগ। ওই সময়কার পরিস্থিতি কেমন ছিল, তা বোঝা যাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের (তখন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য) একটি বক্তব্যে। তখন তিনি একটি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘ছাত্রলীগ বর্তমানে যেভাবে চলছে, তাতে একে হোমিওপ্যাথি আর অ্যালোপ্যাথি নয়, সরাসরি সার্জারি করতে হবে।’
প্রশ্ন হলো, সেই ‘সার্জারি’ কি হয়েছে। কে করবে সেই ‘সার্জারি।’
ইমাম হোসেন সাঈদ, ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো