ফরহাদ মজহার 14 May 2020 From his Facebook presentation
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, বাংলাদেশের জনগনের দুই প্রকার দুষমনদের মধ্যে প্রথম প্রকার হোল কমিউনিস্ট। তারা ব্যক্তিগত মালিকানা উৎখাতের কথা বলে, কিন্তু সম্পত্তি সব রাষ্ট্রের নামে আত্মসাৎ করে। তারপর নিজেরা মালিক বনে যায়। মজলুমকে আরও শোষণ করে। কামাল হোসেন সংবিধানে লিখে রেখেছেন ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’। ‘মালিকানা’ ছাড়া পেটি বুর্জোয়া যেমন সম্পদ ও সম্পত্তির ধারণা করতে পারে না, তেমনি রাষ্ট্র বা প্রজাতন্ত্রকেও জমিদারি বা ব্যক্তিগত মালিকানা দিয়েই বোঝে। মালিকানা তত্ত্বের ফাঁক দিয়ে প্রজাতন্ত্রের মালিকানা অনায়াসেই একজন ব্যক্তির মালিকানায় পরিণত হয়। দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছরের তিক্ত ইতিহাসের পরও বাংলাদেশীদের কোন শিক্ষা হয় নি।
আর মওলানা, আলেম-ওলেমারা মুখে বলে সব কিছুরই মালিক আল্লাহ। কিন্তু জমি, বাড়ি, ব্যবসা সবই নিজের মালিকানায় তারা রেজিস্ট্রি করে। তারাই মালিক: দ্বীন এবং দুনিয়ার। ইহকাল এবং পরকাল, উভয়েরই — মনে হয় কে জাহান্নাম পাইব আর কে বেহেশত পাবে তার দলিল তারা তাদের দরবার থেকেই লিখে দিতে সক্ষম। আল্লা তাগোরে এতোই ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছে। আল্লাহ দ্বীন-দুনিয়ার মালিক — এটা স্রেফ তাদের মুখের কথা। তারাই মালিক। আল্লাহ তাদের ঈমানে কার্যত অনুপস্থিত। অতএব কমিউনিস্টদের পাশাপাশি এরা বাংলাদেশের জনগণের দুষমণ।
ভাসানী কাকে দুষমন গণ্য করেছেন? কমিউনিজম কে? না ‘কমিউনিজম’ না, বাস্তবের কমিউনিস্টদের। কারণ কমিউনিজম আদর্শ হিশাবে রক্ষা করতে হলে কমিউনিস্টদের হাতে এটা আর জিম্মা রাখা যাবে না। বাংলাদেশী ‘কমিউনিস্ট’ নামধারী যে কোন ব্যক্তি বা দলের কথাই ভাবতে পারেন, এদের বিরুদ্ধে পরিষ্কার লড়াই ছাড়া আপনি বাংলাদেশের জনগণের জন্য কিছুই করতে পারবেন না। ভাসানির ইসলাম আর কার্ল মার্কসের কমিউনিজমের মধ্যে পার্থক্য একটাই, ভাসানীর কাছে ইসলাম কমিউনিজমেরই আরেক নাম। তাহলে মার্কসের সঙ্গে পার্থক্য কি? আলবৎ আছে। ভাসানীর কমিউনিজমে যিনি গায়েব তিনি সব সময়ই হাজির থাকেন। কারন তিনি আছেন বলে আর সবকিছু ‘বর্তমান’ আছে। কমিউনিজমও কায়েম হতে পারে যদি তিনি থাকেন। নইলে না। ইসলামের সোজা হিশাব। ভাসানীর হিশাবও সোজা।
মার্কস রুহানি বিষয়াদি নিয়ে কিছু লিখেন নাই, তাঁর গুরু হেগেলের পর্যালোচনা করতে গিয়ে এই সকল বিষয় মীমাংসার বিশেষ দায় বোধ করেন নাই। হেগেল ইসলাম কিছুটা বুঝেছিলেন, কিন্তু যা গায়েব, অনুপস্থিত বা নাই তা কি করে ‘আছে’ হয় — এই কঠিন দিকটা ধরতে পারেন নাই। তাই ইসলামে গায়েবে ঈমান আনাকে কেন ‘দ্বীন’ বলা হয় তার রুহানি শক্তির মর্ম পাশ্চাত্য বোঝে নাই।
কার্ল মার্কস আমাদের তত্ত্ব দিয়েছেন, ভাসানী দিয়েছেন হৃদয়। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে কার্ল মার্কসের ডায়ালেক্টিকাল কারেকশান বলতে পারেন। তিনি আগামি বৈশ্বিক বিপ্লবের মতাদর্শিক নেতা। তিনি সময় মতো ‘খামোশ’ বলে খাড়া হয়ে যাবেন। নিশ্চিত থাকেন।
আমি একে ‘রুহানিয়াত’ বলি। আমার ভাল লাগে। মনে হয় রাসুলে করিমের পেছনে সালাত আদায় করতে দাঁড়িয়েছি মদিনা মনোয়ারায়। রুহানিয়াত বুঝলে আমি ইসলামের ঝাণ্ডা হাতে পাশ্চাত্য মোকাবিলা করতে পারি। সেটা হেগেল হোক, হেইডেগার, দেরিদা, ফুকো কিম্বা একালের আগামবেন।
আর দ্বিতীয় প্রকার দুষমন হোল জান্নাত ও জাহান্নামের ফেরিওয়ালা আলেম-ওলেমা মওলানাসহ নানান কিসিমের ধর্মবেত্তা। না এই ক্ষেত্রেও ‘ইসলাম’ না। জমি জমা ধন সম্পদ লোভীদের হাত থেকে ইসলামকে রক্ষা করার জন্যই মওলানা এদের শত্রু গণ্য করেছেন। ‘ইসলাম’ অনেক গভীর ব্যাপার। ভাসানীর চেয়ে পরহেজগার এবং আল্লার রাহে জীবনের সবকিছু বিলিয়ে দেওয়া জীবন কেউ যাপন করেছেন বলে আমার জানা নাই। কিন্তু জালিমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যুদ্ধের ময়দান তিনি কখনই ত্যাগ করেন নি। সহজে বোঝাবার জন্য বলা যায়, ইসলামকে মসজিদে ঢোকান নাই, কিন্তু প্রতিটি ঘরকেই মসজিদে পরিণত করবার সবক দিয়েছেন, প্রত্যেক মানুষের হৃদয়কে কাবায় পরিণত করতে চেয়েছেন।
মওলানা ইসলাম কায়েম করবার জন্যই সারা জীবন লড়েছেন, কারণ তিনি পরিষ্কার বুঝছিলেন জুলুম মুক্ত সমাজকে যে নামেই ডাকেন ঘুরে ফিরে কথা একটাই: মানুষ মানুষের সঙ্গে রুহানি সম্পর্কই পাতাতে চায়। একই বিশ্ব-সমাজে একসঙ্গে সবাই মিলে বাস করতে চাওয়াই মানুষের মনোবাঞ্ছা। অনেকে এই মিস্ট্রি ধরতে পারে না বলে একে স্পিরিচুয়াল ব্যাপার-স্যাপার গণ্য করেন। আসলে কোনই রহস্য নাই। মানুষের মনের আকুতি সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকা, বিশ্ব-সমাজ বা ‘উম্মাহ’ গড়ে তোলা। বর্ণ, জাতি, শ্রেণী, লিঙ্গ ইত্যাদির বিভেদ জুলুম ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার ফল।
আসন্ন সমাজকে কমিউনিজম বা রুহানি সমাজ যে নামেই ডাকেন কিচ্ছু যায় আসে না। ভাল লাগলে ইসলামি সমাজ বলেন। না লাগলে আরেকটা শব্দ বানান। আদত কথা হোল সেই সমাজ দাস, সামন্ত, পুরুষতন্ত্র বা পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ হবে না। অর্থাৎ মার্কসের কথা মতো কমিউনিজম নতুন কোন মতাদর্শ না। মানুষের পুরানা স্বপ্নেরই বাস্তবায়ন।
যে দেশে ইসলাম জনগণের ধর্ম হিশাবে হাজির সেই দেশে কমিউনিজমকে ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর অর্থ হচ্ছে নিজের বুকে নিজে ছুরি মারা। তাই বাংলাদেশে চরম ইসলাম বিদ্বেষী কমিউনিস্ট নামধারীদের বিরুদ্ধে সাফ সাফ দাঁড়ানো ছাড়া মজলুমের মুক্তি অসম্ভব। অন্যদিকে আল্লার নামে যারা ইহলোক ও পরলোকে তাদের ব্যক্তিগত মালিকানা কায়েম রাখতে চায়, এদের হাতে ইসলাম জিম্মি করে রাখবেন না। যদি কেউ রাজনৈতিক ঐক্য নিয়ে কোন বয়ান ছাড়েন তাহলে এটা মনে রাখবেন। এই দুই প্রকার দুষমণের হাত থেকে বাংলাদেশের জনগণকে রক্ষ করতে হবে। নইলে মুক্তি নাই। সেটা পরিষ্কার ভাষায় সাফ সাফ বলবেন।