লিওনিড রাগোজিন
২১ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে তাঁর ধরা বাজি বিপজ্জনক মাত্রায় নিয়ে গেছেন। বড় সেনা সমাবেশ ও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছেন তিনি। রাশিয়ার জাতীয় টেলিভিশনে এক ভাষণে পুতিন বলেন, ‘এটা মোটেই ধাপ্পাবাজি নয়। যারা পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে আমাদের ব্ল্যাকমেল করতে চাইছে, তাদের জানা উচিত যে আবহাওয়ার নির্দেশকটি যেকোনো সময় ঘুরে যেতে পারে এবং তাদের দিকেই সেটা তাক হতে পারে।’
পুতিনের এ বক্তব্যের পরই রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সার্গেই শোইগু ঘোষণা দেন, সেনাবাহিনীতে নতুন করে তিন লাখ সেনা নিয়োগ দেওয়া হবে। যাহোক, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। নির্বাসিত রাশিয়ানদের সংবাদমাধ্যম নভায়া গেজেট ক্রেমলিনের একটি সূত্রের বরাতে জানিয়েছে, ১০ লাখ নতুন সৈন্য নিয়োগ করতে চলেছে রাশিয়া। যদিও ক্রেমলিন এ দাবি নাকচ করে দিয়েছে।
একই সঙ্গে রাশিয়া নিজেদের অধিকৃত ইউক্রেনের চারটি অঞ্চলে গণভোটের আয়োজন করেছে। শেষ পর্যন্ত এ গণভোট ওই চার অঞ্চলকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে নেওয়ার আয়োজন। এই ভুয়া ভোটের মাধ্যমে ক্রেমলিন দাবি করার সুযোগ পাবে, ইউক্রেন ‘রাশিয়ার ভূখণ্ড’-এ হামলা চালাচ্ছে। এর পরিণামে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে মস্কোর জন্য।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপথ নির্ধারণে ও রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পুতিনের এই কঠোর সিদ্ধান্তের কী প্রভাব পড়তে যাচ্ছে, সেটা অনুমান করা খুব কঠিন নয়। পুতিন উন্মাদের মতো একটি ঝুঁকি নিয়েছেন, যেটা তাঁর সরকারের পতন ঘটাতে পারে। একই সঙ্গে এ সিদ্ধান্ত ইউক্রেনকে রক্তের সাগরে ডুবিয়ে দিতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের পরাজয় ডেকে আনতে পারে।
পুতিন এখন রাশিয়ার বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিলেন, যেটা তাদের বাঁচা-মরার লড়াই। পুতিনের সরকার এখন নিজ দেশে বড় ধরনের প্রতিরোধের মুখে পড়তে পারে। কিন্তু সুযোগসন্ধানীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে, সেই ঝুঁকি রয়েছে। এটা বিশ্বাস করা ভুল হবে যে একটি যুদ্ধ ভুলভাবে পরিচালনা করলে তার ফলাফল হিসেবে যে সামাজিক অসন্তোষ তৈরি হবে, তাতে রাশিয়ার বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর পতন হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেনা সমাবেশ করতে দেখা যায়নি রাশিয়াকে। এ ঘটনা রাশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ রক্ষণশীল জনগণের জন্য পুতিন সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পাদিত সামাজিক চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার বিনিময়ে তারা তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা বিক্রি করে দিয়েছে। পুতিন সরকারের অধীন রাশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ রাজনীতি থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পুতিন সরকার বিরোধীদের ওপর সীমাহীন দমনপীড়ন চালায়। পুতিনের সেই রাজনৈতিক দমনপীড়নে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর ছোট একটি অংশ আক্রান্ত হয়।
অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করলে দেখা যাবে, পশ্চিমাদের কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়ার মানুষ তাদের স্মরণ-ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে সচ্ছল জীবন যাপন করছে। ১৯৯০-এর দশকে উদারীকরণ সংস্কারের যুগের হতাশা অনেক পেছনে ফেলে এসেছে তারা। কিন্তু পুতিনের ঘোষণা অনুযায়ী যদি সেনা নিয়োগ করা হয়, তাহলে পুতিনের এই আত্মঘাতী পররাষ্ট্রনীতির কারণে লাখ লাখ মানুষ সরাসরি আক্রান্ত হবে। এর বিয়োগান্ত পরিণতির শিকার হবে অজস্র মানুষ। বিশ শতকে ঘটে যাওয়া দুটি বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে যে রকম দেশপ্রেমের উন্মাদনা দেখা দিয়েছিল, তার থেকে এ ঘটনা ভিন্ন কিছু হবে না। যদিও এ ঘোষণার পর এখন রাশিয়ার সীমান্তগুলোতে দেশ ছাড়তে চাওয়া মানুষের দীর্ঘ সারি দেখা যাচ্ছে; বিমানের টিকিটের দাম অত্যধিক বেড়ে গেছে। রাশিয়ার অনেকে এখন দেশ ছাড়তে মরিয়া।
পুতিন তাঁর দুঃসাহসিক পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জনগণকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। কেননা, রাশিয়ার জনগণের জন্য একটা স্থিতিশীল পরিস্থিতি তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছেন। পুতিনের শাসনের প্রথম ১০ বছরে এর শক্ত ভিত্তি গড়ে ওঠে। ১৯৯০-এর দশকের অস্থিরতা ও দুর্দশার যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, তা থেকেই রাশিয়ার সমাজ এই স্থিতিশীলতাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে। এটাই পুতিনের বৈধতার কারণ। কিন্তু পুতিনের শাসন নিয়ে সেই বদ্ধমূল ধারণা প্রথম বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ১০ বছর আগে বলতনায়া প্রতিবাদের সময়।
এর পর থেকে পশ্চিমের সঙ্গে সংঘাতকে পুতিন তাঁর শাসনের বৈধতা দেওয়ার নতুন উৎস হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন। সে সময় থেকে পুতিন জনতুষ্টিবাদী-গরিষ্ঠবাদী নেতা থেকে যুদ্ধকালীন স্বৈরশাসকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন। নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য পুতিনের একটা বিষয় খুব করে প্রয়োজন। তা হলো রাশিয়ার জনগণ যাতে মনে করে পশ্চিমারা তাদের জন্য সত্যিকারের হুমকি। রাশিয়ার অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়ছে, এ রকম একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় পুতিনের ক্ষমতা পোক্ত করার জন্য আদর্শ। ভূরাজনৈতিকভাবে রাশিয়ার অবস্থান বিচ্ছিন্ন। এতে পুতিন তাঁর হাতের খেলার বিষয়ে পরিণত করতে পেরেছেন পশ্চিমাদের। একই কারণে ইউরোপের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হয়েছে রাশিয়া।
পুতিন এখন রাশিয়ার বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিলেন, যেটা তাদের বাঁচা-মরার লড়াই। পুতিনের সরকার এখন নিজ দেশে বড় ধরনের প্রতিরোধের মুখে পড়তে পারে। কিন্তু সুযোগসন্ধানীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে, সেই ঝুঁকি রয়েছে। এটা বিশ্বাস করা ভুল হবে যে একটি যুদ্ধ ভুলভাবে পরিচালনা করলে তার ফলাফল হিসেবে যে সামাজিক অসন্তোষ তৈরি হবে, তাতে রাশিয়ার বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর পতন হবে। সত্যি বিষয় হচ্ছে, যখন বেশির ভাগ মানুষকে বাঁচা-মরা নিয়েই ভাবতে হয়, তখন তারা বিপ্লবীতে পরিণত হয় না। যুদ্ধ খুব কম ক্ষেত্রেই বিপ্লব ঘটাতে পারে।
নতুন সেনাদের মধ্যে প্রেরণার ঘাটতি থাকবে। সে কারণে তাঁরা বিদ্রোহ করে বসতে পারেন অথবা ইউক্রেনের সেনাদের কাছে দলে দলে আত্মসমর্পণ করে বসতে পারেন। তবে সেনা নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত ও অসচ্ছল শ্রেণিকে বেছে নেওয়া হয়, তাহলে এই চিত্র কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, সম্ভাব্য বিদ্রোহের নেতৃত্ব কি কেউ গ্রহণ করবেন? সশস্ত্র উগ্র জাতীয়তাবাদীরা এরই মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা ও উদারতার অভিযোগ এনে পুতিনের ওপর চড়াও হয়েছেন। ফলে সেখানে মধ্যপন্থীরা জয়ী হবেন, সেটার সুযোগ খুব কম। পরিস্থিতি বলছে, পুতিন এখন নিজের পাশে আর কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না। সে ক্ষেত্রে শেষ অবলম্বন হিসেবে তিনি মরিয়া হয়ে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার করে বসতে পারেন।
একটা পারমাণবিক যুদ্ধের কিনারায় আমরা এখন দাঁড়িয়ে। এই সংকটের খুব কেতাদুরস্ত, দায়িত্বশীল ও দূরদর্শী নীতি খোঁজা প্রয়োজন। এ সময়ে নেতৃত্বের ব্যর্থতা এমন এক বৈশ্বিক বিপর্যয় ঘটাতে পারে, যেটা আগে কখনোই ঘটেনি।
- লিওনিড রাগোজিন লাটভিয়ার ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত