আতাউস সামাদের মত পেশাদার সাংবাদিক একজনও নেই এখন

 আমার দেশ
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

অলিউল্লাহ নোমান

অলিউল্লাহ নোমান

অলিউল্লাহ নোমান

১৯৯১ সালের শেষ দিকে ঢাকায় আসি মাস্টার্স পড়ার জন্য। প্রথমে উঠেছিলাম নয়াপল্টনের মসজিদ গলিতে ১৩ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায়। এখানে আরো কয়েকজন ব্যাচেলর থাকতেন। তাদের সাথে একটি রুম নিয়েছিলাম। ১৩ নয়াপল্টনের ঠিক উল্টা দিকে বৃটিশ আমলের পুরাতন মডেলের লাল ইটের একটি বাড়ি। গেইটের সামনে লেখা আতাউস সামাদ, বিবিসি। বাড়ির গেইটে ছোট করে লেখাটি চোখে পড়া মাত্রই চমকে উঠলাম। এটা কি সেই আতাউস সামাদের বাড়ি, বিবিসিতে যার কণ্ঠ শোনার জন্য তীর্থের কাকের মত অপেক্ষায় থাকতাম!

তাঁর কণ্ঠে বিবিসি বাংলায় প্রতিবেদন শুনেছি নিয়মিত। তাই তাঁকে না দেখলেও কণ্ঠের সাথে খুব পরিচিত। তাঁকে দেখার আগ্রহ নিয়ে প্রায়ই বাড়িটির গেইটে দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কখন তিনি বের হন বা বাইরে থেকে বাড়িতে ঢুকতে আসেন সেই অপেক্ষায় ছিলাম। হঠাৎ করেই একদিন জানালা দিয়ে চোখ রাস্তার দিকে যেতেই দেখি রিক্সা থেকে সুঠাম দেহের উঁচা-লম্বা এক ব্যক্তি নামছেন। ঢিলেঢালা সাদা পায়জামা ও সাদা পাঞ্জাবি গায়ে। মাথায় হেডফোন লাগানো। বুঝলাম তিনি-ই সাংবাদিক আতাউস সামাদ। দৌড়ে নিচে নামলাম, তাঁকে একটি সালাম দিব। কিন্তু তৃতীয়তলা থেকে নেমে দেখি তিনি গেইটের ভেতরে চলে গেছেন। সেদিন আর সালাম দেওয়ার সুযোগ পাইনি।

ছোটবেলা থেকে বিবিসি বাংলা শুনলেই তাঁর নাম শুনতাম। বিশেষ করে ছাত্রজীবনে এইচ এম এরশাদের দু:শাসনের সময় বিবিসি বাংলা ছিল খুবই জনপ্রিয়। বিবিসি বাংলার রাত ১০টার সংবাদ না শুনলে তখন ঘুমই ভাল হত না। দলবেঁধে এক জায়গায় বসে মানুষ বিবিসি শুনত তখন। বিবিসি ছিল তখন নির্ভরযোগ্য সংবাদ মাধ্যমে। লন্ডনের হেড অফিস থেকে সিরাজুর রহমান এবং ঢাকা থেকে আতাউস সামাদ রিপোর্ট করতেন।

পড়াশোনার পাশাপাশি ঢাকায় যুক্ত হই সাংবাদিকতার সাথে। শুরুটা ছিল অনেক চড়াই-উৎরাই এর মধ্য দিয়ে। ১৯৯৮ সালে এক পর্যায়ে থিতু হই দৈনিক ইনকিলাবে। ইনকিলাব তখন দেশে প্রচার সংখ্যায় সর্বোচ্চ। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতেই তখন অনেকের সাথে পরিচয় হয়। ইনকিলাবের এক সিনিয়র সহকর্মী একটা ছোট বাড়তি আয়ের প্রস্তাব দিলেন। তখন সিটিসেল দিনের ঘটনা গুলো নিয়ে তাৎক্ষণিক অতি সংক্ষেপে মূল নিউজটা শোনানোর ব্যবস্থা করেছিল। আমাকে প্রস্তাব করা হল, আইনাঙ্গনে বা সুপ্রিমকোর্টে বড় ঘটনা গুলোর সংক্ষিপ্ত নিউজ তাদেরকে টেলিফোনে বলে দিতে। এজন্য মাসে সম্ভবত ২ হাজার টাকা দেওয়া হত। মনে করলাম কাজতো খারাপ না। এমনিতেই নিউজের জন্য দৌড়ঝাঁপ করি। মূল ঘটনাটা সংক্ষেপে টেলিফোনে বলে দেই। এটার অফিস ছিল লাল ইটের পুরাতন মডেলের তৈরি আতাউস সামাদ স্যারের বাড়িতে। এখানেই পরিচয় হয় মুজাহিদ আকাশের সাথে। তরুণ দাঁতের ডাক্তার। কিন্তু সাংবাদিকতার প্রতি নেশা তাঁর।

ডা. আকাশ একদিন প্রস্তাব করলেন আতাউস সামাদ স্যারের সাথে পরিচিত হতে। তখন সাপ্তাহিক “এখন” নামে একটি পত্রিকা বের করার প্রস্তুতি চুড়ান্ত করেছেন আতাউস সামাদ স্যার। এর আগেই অবশ্য বিবিসি ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। স্যারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন ডা. আকাশ। স্যার অনেক কথা বললেন। প্রস্তাব করলেন সাপ্তাহিক এখন বের হলে নিয়মিত লেখার জন্য। যে আতাউস সামাদ স্যারকে দেখার জন্য কৌতূহল ছিল, তিনি আমাকে লেখার প্রস্তাব করছেন। আমার তো খুশির অন্ত নেই।

যেহেতু আমি একটি দৈনিক পত্রিকার নিয়মিত স্টাফ রিপোর্টার, সুতরাং দুই জায়গায় কাজ করার সুযোগ নেই। এজন্য একটি ছদ্মনাম ঠিক করে দিলেন সাপ্তাহিক এখন-এ লেখার জন্য। সাপ্তাহিক এখন পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় কভারস্টোরি ছিল আমার লেখা একটি রিপোর্ট। এই রিপোর্টের শিরোনাম ছিল-সুপ্রিমকোর্টের আকাশে কালো মেঘ। এতে উঠে এসেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সুপ্রিমকোর্টকে কিভাবে দলীয়করণের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এই কালোমেঘ থেকে এখন সুপ্রিমকোর্টে দলীয় করণের ঝড় বইছে। স্যার আমার লেখাটি খুবই পছন্দ করলেন এবং অনেক ধন্যবাদ জানালেন। এর পর থেকে নিয়মিত সাপ্তাহিক এখন-এ লিখি। মাঝে মধ্যেই আমার রিপোর্ট কভারস্টোরি হয়। মাস শেষ হলে কিছু টাকাও পাওয়া যায়। ইনকিলাবে নিয়মিত বেতনের বাইরে এই বাড়তি আয় আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে। তবে টাকা কামাইয়ের চেয়ে বড় অর্জন ছিল, স্যারের নিকট থেকে শিখেছিলাম সততা ও পেশাদারিত্ব বজায় রেখে সাংবাদিকতা কিভাবে করতে হয়।

এরপর ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে যোগ দেই আমার দেশ পত্রিকায়। পত্রিকাটি তখন কল্পনায়। অফিস কোথায় হবে কেউ জানে না। কবে বের হবে সেটাও নিশ্চিত নয়। তারপরও যোগ দিলাম ইনকিলাবের মত একটি বড় পত্রিকা ছেড়ে। ইনকিলাব তখনো বাংলাদেশে সর্বোচ্চ সার্কুলেশনের পত্রিকা। বছরে ৩টা বোনাস। সরকারি ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী বেতন-ভাতা।

দিন যায়, মাস যায় আমার দেশ পত্রিকা কবে বের হবে সেটার কোন সঠিক নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। লোকবল নিয়োগ শরু হয়েছে মার্চ মাসের শেষ দিক থেকে। যদিও আমাকে যোগ দিতে হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসে। এপ্রিলের শেষ দিকে জানতে পারলাম অফিস হবে কাওরানবাজারে। কিছুটা স্বস্তি পেলাম। পত্রিকা বের হয়েছিল ২৩ সেপ্টেম্বরে। ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেতন দিয়েছে বসিয়ে।

পত্রিকাটি বের হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে শুনলাম আতাউস সামাদ স্যার যোগ দিচ্ছেন উপদেষ্টা সম্পাদক হিসাবে। শুনে খুব খুশি হলাম। কারণ, স্যারের সান্নিধ্যে অনেক কিছু শিখেছি। এখানে আরো সুযোগ পাব। আমার দেশ-এর উপদেষ্টা সম্পাদকের পাশাপাশি সাপ্তাহিক এখনও চালিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি।

আমার দেশ-এ চীফ রিপোর্টার কোন রিপোর্ট নিয়ে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে ভয় দেখাতেন স্যারকে দিয়ে। রিপোর্ট ভাল না হলেই চীফ রিপোর্টার বলতেন রিমান্ডে পাঠাতে হবে। রিমান্ড মানেই হল আতাউস সামাদ স্যারের কাছে পাঠানো হবে রিপোর্টটা দেখে দেওয়ার জন্য। তখন ওই রিপোর্ট যিনি লিখেছেন তাকে হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হত। একটি রিপোর্ট তৈরি করার পর এটি নিয়ে যাতে কোন রকমের প্রশ্নের উত্তর বাকী না থাকে। প্রতিটি লাইনের তথ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করতেন তিনি। স্যারকে শতভাগ সন্তুষ্ট না করতে পারলে ওই রিপোর্ট প্রকাশ হত না। রিপোর্ট সম্পর্কে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব আগে দিতে হত। তাই সব রিপোর্টার ভয়ে থাকতেন, যাতে স্যারের কাছে রিপোর্টটি প্রকাশের আগে না যায়। আবার অনেক সময় প্রকাশিত রিপোর্ট নিয়েও তিনি মিটিংয়ে প্রশ্ন তুলতেন। এটা এরকম না হয়ে ওই রকম হল না কেন? এরকম প্রশ্ন তিনি হরহামেশা করতেন। অর্থাৎ স্যারের কাছে সাংবাদিকতার ফাঁকি দেওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দলীয় চিন্তার উর্ধ্বে।

স্যারের সাথে আরেকটি ঘটনা দিয়ে আজকের লেখা শেষ করব। ২০০৫ সালের শেষ দিকের ঘটনা। সুইডেন প্রবাসী ঝিন্টুকে ফাঁসি মওকুফ করেছে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি। এই ঘটনা নিয়ে আওয়ামী ও ইন্ডিয়াপন্থী পত্রিকা গুলোতে তোলপাড়। সুইডেন প্রবাসী ঝিন্টু ছিলেন একটি হত্যা মামলায় ফাঁসির আসামী। তিনি হঠাৎ করে দেশে ফিরে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। কয়েক দিনের মধ্যেই ফাঁসির দণ্ড মওকুফ করে দেওয়া হলে কারাগার থেকেও মুক্তি পেয়ে যান। এই ঘটনায় আওয়ামী পত্রিকা গুলো চার দলীয় জোট সরকারকে বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টায় লিপ্ত। তখন একদিন আইন মন্ত্রণালয় থেকে কয়েকজন সাংবাদিক বের হচ্ছেন না। তারা যেহেতু বের হচ্ছেন না, আমিও বসে থাকলাম। মনে করলাম তারা নিশ্চয়ই বড় কোন ঘটনার অপেক্ষায় বসে আছেন। এক পর্যায়ে জানতে পারলাম ঝিন্টুর ঘটনায় আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদের চাকুরি চলে যাচ্ছে। আজই তাঁর শেষ কর্মদিবস। মওদুদ আহমদ শেষ কর্মদিবসে অফিসে কি কি করলেন এটা নিয়ে তারা নিউজ করার জন্য বসে আছেন।

সেদিন আর মওদুদ আহমদের চাকুরি যায়নি। পরের দিন আবার সচিবালয়ে গেলাম। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে ঝিন্টুর মুক্তির ফাইল দেখার চেষ্টা করলাম। তখন পুরাতন মামলাটির ঘটনা জানলাম। এতে দেখা যায়, এরশাদের সামরিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল ৩ জনের। এরমধ্যে একজনকে এরশাদ তখনই খালাস দিয়েছেন রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে। একজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। ঝিন্টু পলাতক ছিলেন। যেহেতু এই হত্যা মামলার বিচার হয়েছিল সামরিক আদালতে। তাই আসামীরা আপিলের সুযোগ পায়নি। এছাড়া এ মামলায় এরশাদ নিজেই একজনকে দণ্ড মওকুফ করেছেন। সুতরাং এই দুই সূত্রে (আপিলে সুযোগ ছিল না এবং একজনকে মওকুফ করা হয়েছে আগেই) ঝিন্টুকে দণ্ড মওকুফ করেছেন রাষ্ট্রপতি।

এই ঘটনার তথ্য নিয়ে অফিসে গেলাম। তখন আমার দেশ-এ আওয়ামীপন্থীদের কিছুটা দাপট ছিল। তারা নির্বাহী সম্পাদক ও বার্তা সম্পাদকের উপর চাপ সৃষ্টি করলেন যাতে এই নিউজ ছাপানো না হয়। যাদের যুক্তি হল এই নিউজ ছাপানো হলে আমার দেশ-এর ক্রেডিবেলিটি থাকবে না। এটা দলীয় পত্রিকা হিসাবে পরিচিত পাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন একটি পরিস্থিতিতেও আমি দ্রুত রিপোর্ট লিখে ফেললাম। মনে করলাম আতাউস সামাদ স্যারকে দেখাবো। তিনি যদি রাজি হন তাহলে কেউ বাধা দিলে কাজ হবে না।

রিপোর্ট লিখে শেষ করতে না করতেই দেখি স্যার চলে যাচ্ছেন। দৌড়ে লিফটের সামনে গিয়ে বললাম, আপনি কি চলে যাচ্ছেন স্যার। বললেন, কেন? আমি তো আজকের মত চলে যাচ্ছি। অনুরোধ করলাম আমার রিপোর্টটি একটু পড়ে দেখার জন্য। তিনি আবার ফিরে আসলেন রুমে। আমার লেখা নিউজটি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। দুই/একটা জিজ্ঞাসা ছিল স্যারের। আমি বুঝিয়ে দিলাম। তিনি খুবই সন্তুষ্ট হলেন। তারপর বললাম, স্যার, নিউজটা মনে হয় ছাপা হবে না। কারণ, রিপোর্টারদের মধ্যে সিনিয়র কয়েকজন এই নিউজ ছাপানোর বিরোধীতা করতেছেন। স্যার তখন নিউজটা হাতে নিয়ে সোজা চলে গেলেন বার্তা সম্পাদকের টেবিলে। গিয়ে বললেন, এই নিউজ আমি (আতাউস সামাদ স্যার) দেখে দিয়েছি। এটা আজকে লিড স্টোরি হওয়ার মত নিউজ। যদি লিড স্টোরি দিতে সমস্যা হয়, প্রথম পাতায় গুরুত্ব দিয়ে ছাপতে হবে।

বার্তা সম্পাদকের দায়িত্বে তখন রশিদ উন নবী বাবু ভাই। তিনি নিউজটা হাতে নিয়ে টেবিলের এক কোণে রেখে দিলেন। যেভাবে রাখলেন, মনে হল বাবু ভাই স্যারের কথায় খুব একটা পাত্তা দিলেন না। আমি সেদিন আর অফিস থেকে বের হচ্ছি না। একটু পরপরই বাবু ভাইয়ের সামনে গিয়ে দেখি পত্রিকার ম্যাকআপ। এক পর্যায়ে দেখলাম তিনি লিড নিউজ বাদে ম্যাকআপ প্রায় শেষ করেছেন। একেবারে শেষ দিকে আমাকে ডাকলেন বাবু ভাই। ডেকে একটি হেডলাইন দেখালেন। জিজ্ঞেস করলেন, এই হেডলাইন কি তোমার নিউজে দিলে চলে? বললাম একেবারে পারফেক্ট। বাবু ভাই আমার নিউজটি লিডে বসালেন। তখন বললেন, সামাদ ভাই দেখে দিয়েছেন। সুতরাং আর পড়ার কোন দরকার নেই।

বাংলাদেশের যে ক’জন সাংবাদিকের নাম চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন আতাউস সামাদ। যার মধ্যে পেশাদারিত্বের কোন অভাব ছিল না। সাংবাদিকতায় তিনি ছিলেন দলীয় চিন্তার উর্ধ্বে শতভাগ পেশাদার। ২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্যার দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। আল্লাহ স্যারকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন।

লেখক: যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত সাংবাদিক
২৬/০৯/২০২