‘‘হাফিজের বাসায় গিয়ে ‘কিংস পার্টি’তে যোগ দিয়েছিলেন সাকিব’’ শীর্ষক সচিত্র সংবাদ সোমবার সমকালে প্রকাশিত হওয়ার পর দেশজুড়ে রাজনৈতিক ও ক্রীড়াঙ্গণে ব্যাপক তোলপাড় চলছে। বিশেষ করে খবরটির চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। আলোচনা-সমালোচনা চলছে দলের ভেতর-বাইরে। বিশেষ করে মেজর হাফিজের সঙ্গে বৈঠক ও যোগাযোগকারী বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা কিছুটা আতঙ্কে রয়েছেন। তাদের বৈঠকের ছবি ও তথ্যপ্রমাণ প্রকাশিত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন তারাও। এমনকি বিএনপি’র যুগপৎ আন্দোলনের সমমনা দলগুলোর মধ্যেও খবরটি নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে। ক্রীড়াঙ্গনপাড়ায়ও খবরটি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে নানা নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন অনেকে। অন্যদিকে মেজর হাফিজের নির্বাচনী এলাকা ভোলা-৩ এবং সাকিব আল হাসানের নির্বাচনী এলাকা মাগুরা-১ আসনের মানুষদের মাঝেও আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
‘কিংস পার্টি’ খ্যাত বিএনএমে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ না দিলেও নতুন এই দল গঠনে নেপথ্যের কারিগর ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম। প্রতিবেদনের এই অংশের সঙ্গে নেতাকর্মীরা কমবেশি অবগত থাকলেও এই দলের নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন ফরম তিনি সংগ্রহ করিয়েছিলেন এমন তথ্য আগে কেউ জানতেন না। এমনকি নতুন এ দলে যোগ দিতে মেজর হাফিজের হাতেই আবেদন ফরম তুলে দিয়েছিলেন সাবেক বিশ্ব সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। এমন সচিত্র প্রতিবেদনে অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। সাকিবের এই ডিগবাজির ঘটনায় অনেকে তার অতীত কর্মকাণ্ড স্মরণ করছেন।
বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, পুরো প্রতিবেদনে অনেক অজানা তথ্য তারা জানতে পেরেছেন। আর এটা নিয়েই চলছে তাদের মধ্যে নানামুখী আলোচনা। এতে দলের হাইকমান্ডও হাফিজের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। কেউ কেউ মেজর হাফিজের বিগত দিনের রাজনৈতিক ভুলগুলোকে সামনে নিয়ে আসছেন। এর মধ্যে অনেকে বলছেন, হাফিজউদ্দিন আহমেদ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে জেড ফোর্সের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করলেও ’৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর তিনি জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। তখন তাকে বন্দিও করা হয়েছিলো। ওয়ান-ইলেভেনের আগে বিএনপি সরকার তাকে দু’টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলো। অথচ ওয়ান-ইলেভেনে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তিনি বিএনপির সংস্কারপন্থি অংশের মহাসচিব হয়ে দল ভাঙ্গার ষড়যন্ত্রে ছিলেন। এমনকি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং হাওয়া ভবন নিয়ে নানা সমালোচনা করেছেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি বলে মনে করছেন তারা।
এবার দল ভাঙার প্রক্রিয়ায় বিএনপির আর কোন কোন নেতা জড়িত ছিলেন– তা নিয়েও শুরু হয়েছে কানাঘুষো। বিশেষত, মুক্তিযোদ্ধা দলের শীর্ষ নেতা নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধনের ফরম সংগ্রহ করেছিলেন– এমন বিষয়ে নেতারা ওই নেতাকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন। দলের সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী হিসেবে যারা মেজর হাফিজের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তাদেরকে চিহ্নিত করারও চেষ্টা করছেন নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে, যেসব নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য হাফিজের সঙ্গে বৈঠক বা যোগাযোগ করেছেন তারাও কিছুটা আতঙ্কে রয়েছেন। কোনোভাবে বৈঠকের ছবি বা যোগাযোগের তথ্যপ্রমাণ বিএনপির হাইকমান্ড জানতে পারলে দলের ভেতর বেকায়দায় পড়ার আশঙ্কা করছেন তারাও।
আবার বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর মতে, মেজর (অব.) হাফিজকে দিয়ে এবারও বিএনপিকে ভাঙার মিশন শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ। সেই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়। তবে দলের শীর্ষ নেতাদের সময়োপযোগী তৎপরতায় সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এখানে বিএনপির রাজনৈতিক বিজয়কে সামনে আনতে চাইছেন তারা।
এদিকে সমকালে প্রকাশিত খবরটি নিয়ে সোমবার বিএনপির একাধিক নেতাকর্মীর সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। প্রকাশ্যে কোনো নেতা স্পর্শকাতকর বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে এ ধরনের সাহসী প্রতিবেদনের অকপটে প্রশংসা করেছেন সকলেই। সমমনা অন্যান্য দলের নেতারাও বলেছেন অভিন্ন কথা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান সোমবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার একটি প্রকল্প নিয়েছিল, সে প্রকল্প ব্যর্থ হলে আরও ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্প নেয় সরকার। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনকে আহমেদকে নিয়ে গণমাধ্যমে যে প্রতিবেদন এসেছে, সেটি সরকারে ব্যর্থ প্রকল্পের বহি:প্রকাশ।
দলের যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল খবরটির বিষয়ে বলেন, সমকালের নিজস্ব ‘অসংকোচ প্রকাশের দূরন্ত সাহস’ স্লোগানকে যথার্থ প্রমাণ রাখছে বিভিন্ন সাহসী প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে। এজন্য সমকালকে তিনি আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
১২ দলীয় জোটের শরীক জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, সমকালের এই প্রতিবেদনটি ছিলো ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। এখানে শুধু মেজর হাফিজ নয়– পুরো দেশটাকে যারা ধ্বংস করছে, রাজনীতিকে যারা ধ্বংস করছে তাদের বিষয়ে তথ্য উঠে এসেছে।
ক্রীড়াঙ্গনে বিস্ময়: এদিকে নির্বাচনের আগে সাকিব আল হাসানের কিংস পার্টিতে যোগ দেওয়ার বিষয়ে সমকালের সচিত্র প্রতিবেদনে ক্রীড়াঙ্গনেও তোলপাড় ফেলে। ক্রিকেটপাড়ায় সাংবাদিক, সংগঠক এবং খেলোয়াড়দের মধ্যেও এ নিয়ে কথা হয়। তবে বেশিরভাগ ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব সাকিবের নতুন দলে যোগ দেওয়া এবং আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় বিস্মিত হয়েছেন।
নাম গোপন রাখার শর্তে জাতীয় দলের সাবেক এক অধিনায়ক বলেন, ‘মানুষ এখন রাজনীতিবিদদের পছন্দ করে না। সাকিব নির্বাচন করায় সমর্থকরা দু’পক্ষে ভাগ হয়ে গেছে। গ্যালারি থেকে আমরা ভুয়া ভুয়া দুয়োধ্বনি শুনতে পাই তাকে নিয়ে। কিংস পার্টিতে যোগ দেওয়ার তথ্যপ্রমাণ প্রকাশের পর মানুষ হয়তো আরও আক্রমণ করবে।’
সমকাল