একটানা ১৫ বছরের বেশি সময় দেশ শাসনের পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় আওয়ামী লীগ। তাদের সেই শাসনের দোসর হিসেবে দুর্নাম কুড়িয়েছে জাতীয় পার্টি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নির্বাচন চেয়ে সরব হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু সেই সারিতে সামনে থাকা দেশের অন্য দুই প্রধান দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর চাওয়ায় যেন কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
বিএনপি দ্রুততম সময়ে নির্বাচন চাইলেও তাদের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছে না জামায়াত। বিএনপি দ্রুত কমিশন গঠন করে নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করলেও, নির্বাচনের চেয়ে সংস্কারে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে জামায়াত।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপকে ঘিরে দল দুটির বিপরীতমুখী অবস্থানের চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণে রাজধানীর হেয়ার রোডে তাঁর সরকারি বাসভবনে গতকাল সংলাপে অংশ নেয় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল।
বেলা আড়াইটায় বিএনপিকে দিয়ে শুরু হয় তৃতীয় দফার সংলাপ। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও সালাহউদ্দিন আহমেদ সংলাপে অংশ নেন। ঘণ্টাব্যাপী সংলাপের পর বিএনপির নেতারা বেরিয়ে এলে দ্বিতীয় দল হিসেবে সংলাপে বসে জামায়াতের প্রতিনিধিদল। এতে নেতৃত্ব দেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, আ ন ম শামসুল ইসলাম ও মুজিবুর রহমান এবং সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল হালিম।
সংলাপ শেষে বেরিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘উনি (প্রধান উপদেষ্টা) আমাদের বলেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠান উনাদের এক নম্বর অগ্রাধিকার। প্রধান উপদেষ্টা আমাদের দাবি শুনে বলেছেন, নির্বাচন তাঁদের অগ্রাধিকার। বিষয়গুলো অত্যন্ত সহযোগিতার সঙ্গে তাঁরা দেখছেন। তাঁরা মনে করেন, আমাদের দাবিগুলো জনগণের দাবি, আমাদের দাবিগুলো তাঁদেরও দাবি।’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন স্থগিত করে প্রধান রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। আমরা একটা রোডম্যাপ দিতে বলেছি। নির্বাচন কমিশন কবে নির্বাচন করবে, সে ব্যাপারে একটা রোডম্যাপ দিতে বলেছি।’
একই সঙ্গে বিতর্কিত কোনো ব্যক্তি যাতে নির্বাচন সংস্কার কমিশনে না যায়, সে কথাও বিএনপির পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টাকে বলা হয়েছে বলে জানান মির্জা ফখরুল।
অন্যদিকে আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের সামনে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এ সরকার দেশ শাসনের জন্য আসেনি, দেশ শাসনের সুষ্ঠু পথ বিনির্মাণের জন্য তাঁরা এসেছেন। তাঁদের কাজ হচ্ছে, গত তিনটি নির্বাচনে জাতি যা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তার একটা গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করা। এ জন্য কিছু মৌলিক বিষয়ে তাঁদের সংস্কার করতেই হবে। কী কী মৌলিক বিষয়ে তাঁরা সংস্কার করবেন, আমরা সে বিষয়ে কথা বলেছি।’
জামায়াত সংস্কারকে এক নম্বরে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানান আমির শফিকুর রহমান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সংস্কারের টাইমলাইন কী হবে, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা দুইটা বিষয় দেশবাসীর কাছে চেয়েছি এবং সরকারের কাছে জানিয়েছি। একটা রোডম্যাপ হবে সংস্কারের, আরেকটা নির্বাচনের। সংস্কার সফল হলে নির্বাচন সফল হবে। দুইটা বিষয়ে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি।’
সংলাপে জামায়াতের পক্ষ থেকে কী কী প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা এখনই সামনে আনতে চান না দলটির আমির। তিনি বলেন, ‘৯ অক্টোবর (বুধবার) আমরা আমাদের চিন্তা জাতির সামনে তুলে ধরব। এ মুহূর্তে কী কী সংস্কার প্রয়োজন, সংস্কার-পরবর্তী পর্যায়ে কী কী আমাদের লাগবে, আমরা মনে করি, নির্বাচন থেকে সংস্কার বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের তিন দিন পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব বুঝে নেয় মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ। আওয়ামী লীগকে বাদ রেখে অন্যান্য দল ও সেনাবাহিনী আলোচনা করে এই সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সরকার গঠনের পর গত ১২ আগস্ট প্রথম দফায় এবং ৩১ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসেন প্রধান উপদেষ্টা।
এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল তৃতীয় দফায় দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সরকারের পক্ষে তাঁর সঙ্গে ছিলেন উপদেষ্টা হাসান আরিফ ও আদিলুর রহমান খান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম।এদিন বিএনপি-জামায়াত ছাড়াও গণতন্ত্র মঞ্চ, বাম গণতান্ত্রিক জোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), খেলাফত মজলিস, গণঅধিকার পরিষদ সংলাপে অংশ নেয়। এ সময় নির্বাচন ও সংস্কারকেন্দ্রিক আলোচনার বাইরেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিশেষ করে আসন্ন দুর্গাপূজায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে করণীয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয়। পাশাপাশি আরও কিছু বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দলগুলো।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপ করে গণতন্ত্র মঞ্চের ১২ সদস্যের প্রতিনিধিদল। তাঁদের নেতৃত্ব দেন মঞ্চের সমন্বয়ক নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, ভাসানী অনুসারী পরিষদের শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম প্রমুখ।
সংলাপ শেষে বেরিয়ে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘সংস্কার নিয়ে আলাপ হয়েছে। দুর্গাপূজা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে পারে। গার্মেন্টস এলাকায় যে অসন্তোষ, এগুলোর ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। পূজার ব্যাপারে আমরা বলেছি, দরকার হলে জনগণের সঙ্গে মিশে আমরা কাজ করব।’
নির্বাচনের বিষয়ে মান্নার বক্তব্য, ‘ভালো নির্বাচনের জন্য আমাদের সংস্কার প্রয়োজন। যত দূর পর্যন্ত জাতীয় ঐক্য করতে পারব, তত দূর পর্যন্ত সংস্কার করতে হবে। বাকি যেগুলো ব্যাপার আছে, আগামীতে নির্বাচনের মাধ্যমে যে সংসদ গঠিত হবে, সেই নির্বাচিত সরকার করবে।’
বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘সব সংস্কার করার দায়িত্ব এই সরকারের নয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আমরা ধন্যবাদ জানাই। তবে এর মধ্যে প্রধান হবে নির্বাচনীব্যবস্থার সংস্কার। আজকে থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করে নির্বাচন কবে হবে, সেই রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। অন্য সংস্কারের যে কাজগুলো আছে, সে প্রস্তাব তাঁরা করে যাবেন এবং পরবর্তী নির্বাচিত সরকার সে কাজগুলো করবে। আমরা বলেছি, এই সরকারের এমন কোনো কাজ করা ঠিক হবে না, যা মানুষের কাছে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে ৬টি কমিশনের বাইরে আরও ৯টি সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটির আমির মুফতি রেজাউল করিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা নির্বাচন সংস্কারের কথা বলেছি। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, সবগুলো নির্বাচন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা প্রতিনিধিত্ব হারে আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট চাই। সবার ভোটের অধিকার থাকবে। সরকার হবে জাতীয় সরকার। তাঁরা আমাদের এ প্রস্তাবকে ভালোভাবে নিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, এ প্রস্তাব নিয়ে তাঁরা আলোচনা করবেন।’
দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষে গতকাল রাতে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম।
নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্যের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শফিকুল আলম বলেন, ‘এখনই আমরা টাইমটা বলতে পারছি না।’ তবে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী রোডম্যাপের ব্যাপারে যে আলাপটা হচ্ছে, ছয়টা কমিশন গঠন করা হয়েছে, তার পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়েছে। বাকিটা দু-এক দিনের মধ্যে ঘোষণা করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ছয়টি কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথা বলবে, তাদের তিন মাসের টাইমলাইনের মধ্যে। এরপর তিন মাসের মধ্যে একটা করে প্রতিবেদন দেবে। প্রতিবেদনগুলো নিয়ে আবার উপদেষ্টা পরিষদ রাজনৈতিক দল, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। এরপর সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একটা ন্যূনতম ঐকমত্যে আসবে। ঐকমত্যের ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনের টাইমলাইন।
প্রেসসচিব আরও বলেন, একই সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন যে নির্বাচনী কাজগুলো এগিয়ে যাবে। নির্বাচনের প্রস্তুতি, নির্বাচন কমিশন গঠনের কাজগুলোও এগিয়ে যাবে।
Ajker Patrika