- সৈয়দ আবদাল আহমদ
- ০৪ অক্টোবর ২০২১
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ ফেব্রুয়ারি ২০২২ শেষ হচ্ছে। ফলে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে ক্ষমতাসীন সরকার সার্চ কমিটি করতে যাচ্ছে।
আগামী নির্বাচনের আরো দুই বছর বাকি। কিন্তু এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডেকে দলকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন ও সরকারি দলের নির্বাচনী প্রস্তুতির প্রেক্ষাপটে রাজনীতির মাঠে শুরু হয়েছে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা। দেশের ৫৪ বিশিষ্ট নাগরিক এক যুক্ত বিবৃতিতে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন। এ বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এর আগেও যেভাবে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে, এবারো সেভাবেই হবে। সার্চ কমিটি গঠন করে রাষ্ট্রপতির কাছে তাদের সুপারিশ পাঠানো হবে। সেই তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও সদস্যদের নিয়োগ দেবেন।
আগামী নির্বাচন নিয়ে বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা, কমিশনার মাহবুব তালুকদার ও কবিতা খানমও নানা মন্তব্য করেছেন। বিশিষ্টজনদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি আবদুল মতিন ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান তাদের নির্বাচনী অভিমত তুলে ধরেছেন। দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, আগামী নির্বাচনটি কেমন হবে? কারণ নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। গণমাধ্যমে নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের যে মন্তব্য প্রকাশিত ও প্রচারিত হচ্ছে তাতে দেখা যায়, তারা স্পষ্ট করেই বলছেন, তাদের এ নিয়ে তেমন কোনো মাথা ব্যথা নেই; কারণ যেখানে ভোট দেয়ারই সুযোগ নেই, সেখানে ভোট নিয়ে আলোচনা নিরর্থক বলেই তারা মনে করেন।
বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে বিবিসি ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ভোট দিয়েছিলেন কয়েকজন ভোটারের ভাবনা কী জানতে চেয়েছিল। অনেকেই বলেছেন, তারা এখন আর ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ পান না। গৃহিণী সালসাবিল বলেন, যদি আমি ঠিকঠাক মতো ভোটটি দিতে পারতাম তা হলে কোন সরকারকে নির্বাচন করা উচিত সে জিনিসটি অন্তত ভোট দিয়ে আমি বোঝাতে পারতাম। যেহেতু আমি ভোটই দিতে পারছি না, আমার মতামতের তো কোনো গুরুত্ব নেই। শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান ঐশী বলেন, আমি যখন নাম এন্ট্রি করলাম একজন লোক এসে বলল, আমার সামনে ভোট দিতে হবে। অবশ্যই এ তৎপরতায় আমি মর্মাহত হয়েছি। আমি চাই আমার গণতান্ত্রিক যে অধিকার সেটি চর্চা করতে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতার কারণে আমি দ্বিতীয়বার আবার ভাবব, আগামীতে ভোট দিতে যাবো কি না। যদি ভোট দেয়ার ব্যাপার থেকে উপসংহারে আসতে চাই, সে ক্ষেত্রে বলব, আমি গণতন্ত্র চর্চা করতে পারছি না।
শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন মাহি বলেন, গণতন্ত্র সম্পর্কে বই পড়ে যতটা না উৎসাহিত হই, বাস্তবে বা মাঠে চর্চা দেখে ততটা হতাশ হই। শিক্ষার্থী মরিয়ম আজিজ মৌরিন বলেন, শুধু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভোট দিতে পারছি না, গণতন্ত্র চর্চা করতে পারছি না, ব্যাপারটি এমন নয়। আমরা ব্যক্তিগত জীবনেও কোনো ক্লাব বা সংগঠনে সে ভোটাধিকার চর্চাটা পাচ্ছি না। কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি এসে সে ভোটটি দিয়ে দিচ্ছেন। ব্যক্তি হিসেবে যে মতামত প্রকাশ করব; সে জায়গাটি পাচ্ছি না। ব্যবসায়ী মাহমুদুল হাসান বলেন, ভোটের ক্ষেত্রে দেশে এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, মনে হয় না আর ভোট দিতে যাবো। তারা আরো বলেন, গণতন্ত্রে প্রথম যে জিনিসটি সেটি হচ্ছে ভোটাধিকার। যে দিন সেই ব্যক্তিস্বাধীনতাটা পাবো, নিজের ভোট নিজে দিতে পারব, সে দিন হয়তো বা আমার ভোট দেয়ার ইচ্ছা তৈরি হবে। গণতন্ত্র চর্চার প্রথম যে ধাপ, সেখানেই আমি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছি এবং আমাকে থামিয়ে দেয়া হচ্ছে। তখন আমরা সবাই চুপ করে থাকতে থাকতে আরো চুপ হয়ে যাই। প্রতিবাদ করারও উপায় নেই। মামলার ভয়, জেলে যাওয়ার ভয় এবং আরো নানা ধরনের ভয়। এক কথায় বলতে গেলে বলা যায়, দেশে গণতন্ত্র হারিয়ে গেছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা বলতে এখন আর কিছু নেই। চলছে ভয়ের শাসন।
ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে ২০০৮ সালে ২৯ ডিসেম্বর দেশে যে নির্বাচনটি হয়েছিল, সেটিও ছিল একটি বিতর্কিত নির্বাচন। কিন্তু জরুরি অবস্থার অবসানে গণতন্ত্রের স্বার্থে সে নির্বাচনটি মানুষ মন্দের ভালো হিসেবে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অধীনে যে দু’টি নির্বাচন হয়, তা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ, কলঙ্কিত নির্বাচন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি ছিল ভোটহীন, ভোটারহীন ও প্রার্থীহীন একটি নির্বাচন। এ নির্বাচনে ভোট ছাড়াই সরকারি দলের ১৫৪ জন প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করে দেয়া হয়। এসব আসনের চার কোটি ৫৩ লাখ ভোটারকে ভোটদানে বঞ্চিত করা হয়। তারা ভোটকেন্দ্রেই যেতে পারেননি, বাকি ১৪৬টি আসনে গড়ে ৫ শতাংশ ভোটও পড়েনি। সে দিন নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে কুকুর-বিড়াল ঘুমিয়ে থাকার দৃশ্য দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনটি ছিল আরো বাজে; কারণ ওই নির্বাচনে দিনের ভোট রাতেই হয়ে গিয়েছিল। কেন্দ্রে কেন্দ্রে ৩০ ডিসেম্বরের আগের রাতে ক্ষমতাসীনদের ক্যাডার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঢুকে ব্যালটে সিল মেরে বাক্সভর্তি করে রেখেছিল, যা ভোটের দিন গণনা করে ক্ষমতাসীন প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এরপর স্থানীয় পর্যায়ের যেসব নির্বাচন হয়, সেগুলোও একই কায়দায় হয়।
তাই প্রশ্ন উঠেছে দুই বছর পর যে নির্বাচনটি হবে, সেটি কেমন নির্বাচন হবে? দেশে ভোটারবিহীন নির্বাচন এবং দিনের ভোট রাতে হওয়ার নজির সৃষ্টি হয়েছে। আর আগামী নির্বাচনটি যে ‘ইভিএম জালিয়াতি’ করে হবে, তা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে; কারণ এরই মধ্যে ইভিএম জালিয়াতি করে নির্বাচনের বেশ কয়েকটি মহড়া অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। ইভিএম জালিয়াতির পাশাপাশি আর কোনো খারাপ নজির সৃষ্টির যে ছক আঁকা হবে না, তাও বলা যায় না। সাধারণ মানুষের এখন বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে, এ সরকারকে অন্তত ভোটে কিংবা নির্বাচনে সরানো যাবে না; কারণ নির্বাচন জালিয়াতির সব কলাকৌশল তাদের জানা। ফলে বর্তমান নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় মানুষের আস্থা নেই। তারা ভোটবিমুখ হয়ে পড়েছেন; কারণ এখন যে নির্বাচন হচ্ছে তা নির্বাচন নয়, প্রহসন। একপ্রকার নির্বাচন নির্বাচন খেলা।
গত ২২ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া নির্বাচন নিয়ে চলমান অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের কারণে ভোটারদের নির্বাচনবিমুখতা গণতন্ত্রের জন্য অশনি সঙ্কেত। তার বক্তব্যে স্বীকারোক্তি আছে যে, ভোটাররা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন হওয়ায় ভোটাররা এখন ভোটবিমুখ।
কৌতূহলোদ্দীপক বক্তব্য দিয়েছেন আরেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম। তিনি বলেছেন, নির্বাচন কমিশন প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চায় না। তার কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে প্রশ্ন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনকে তিনি সার্টিফাই করেছিলেন কেন?
প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাও গত ২৯ সেপ্টেম্বর বলেছেন, এখন সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নতুন কমিশন হওয়া উচিত এবং নির্বাচন প্রশ্নে সব দলের রাজনৈতিক সমঝোতা হওয়া প্রয়োজন। নির্বাচনব্যবস্থার সর্বনাশ সাধনের জন্য বিপুলভাবে সমালোচিত এ ব্যক্তির ওই বক্তব্যও কি রসিকতা নয়? আসলে এখন তো তার যাওয়ার সময় হয়েছে। প্রোটেকশন তো আর পাওয়া যাবে না। এ জন্য এসব বক্তব্য বের হচ্ছে। সম্প্রতি সিইসি নুরুল হুদা রাশিয়ায় গিয়ে নির্বাচনপদ্ধতি দেখে এসেছেন। রাশিয়ার নির্বাচনব্যবস্থা কী? যিনি সরকারে আছেন অর্থাৎ ভ্লাদিমির পুতিন একবার হন প্রেসিডেন্ট, আরেকবার প্রধানমন্ত্রী। একই লোক এক মেয়াদে হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট, অন্য মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী। মজাই না? আর এ পদ্ধতি দেখে এসেছেন নুরুল হুদা। তামাশা ছাড়া একে আর কী-ই-বা বলা যায়?
গত ১ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, দেশে নির্বাচন নির্বাচন খেলা আর হতে দেয়া হবে না। আগামী নির্বাচন হতে হবে অবশ্যই নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীন এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায়। যদি নির্বাচনকালে নিরপেক্ষ সরকার না থাকে, আমরা সে নির্বাচন মেনে নেব না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ এখন চেষ্টা করছে আবার ক্ষমতায় আসতে ওই ধরনের একটি নির্বাচন দিতে, যে নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারবে না। এবার ইভিএমকে তারা হাতিয়ার বানাচ্ছে। তিনি বলেন, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, রাষ্ট্রযন্ত্র এমনকি গণমাধ্যমকেও নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে এ সরকার। এভাবে দলে পিষে তারা ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করছে। ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর আইন করে, ত্রাসের সৃষ্টি করে পুরো দেশ, জনগণকে পায়ের তলে দাবিয়ে রেখে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে চাচ্ছে তারা। সেই খেলা বন্ধ করতে হবে। ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা এমপি বলেছেন, আওয়ামী লীগকে আমরা আর ওয়াকওভার দেবো না।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? নির্বাচন ছিনিয়ে নেয়ার অপতৎপরতা থামাতে হলে তো জনপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সেই প্রতিরোধ কি বিএনপি গড়ে তুলতে পারবে। এখন পর্যন্ত এর লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না। ড. আকবর আলি খান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিপন্ন গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
এ ব্যাপারে এক সাক্ষাৎকারে বিচারপতি আবদুল মতিন সুন্দরভাবে তার মতামত তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, যে জাতি ইংরেজকে তাড়িয়েছে, পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীকে তাড়িয়েছে। সে জাতি যেকোনো জঞ্জাল তাড়াতে পারবে, যদি চায়। আমরা পেরেছি, আমরা পারবÑ এটি হতে হবে প্রত্যয়।
ঐক্যবদ্ধভাবে ভোট রক্ষার ফর্মুলা বের করতে হবে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় যাতে গ্রহণযোগ্যভাবে আগামী নির্বাচন হতে পারে, সে জন্য সরকারকে বাধ্য করতে সে রকম আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টিরও ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেস ক্লাব