১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাস। তৎকালীন বিএনপি সরকার যখন একপেশে সাধারণ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, বিরোধীদল আওয়ামী লীগ তখন রাস্তায় তুমুল আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। হরতাল, অবরোধ, হামলা এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দেশ তখন বিপর্যস্ত।
১৯৯৪ সালে মাগুরা জেলায় একটি উপনির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ এনে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে।
নানা কর্মসূচী পালনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে আওয়ামী লীগ। আন্দোলন শুরুর নয় মাসের মধ্যেই জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা। তাদের মতো পদত্যাগের রাস্তা বেছে নেয় জামায়াতে ইসলামী, এবং জাতীয় পার্টির এমপিরাও পদত্যাগ করেন।
১৯৯৫ সালের পুরো বছরজুড়ে হরতাল এবং অবরোধসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচী দেয় আওয়ামী লীগ।
১৫ই ফ্রেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশ করতে থাকেন। খালেদা জিয়া যেখানে সমাবেশ করতে যাচ্ছিলেন সেখানেই হরতালের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ।
খালেদা জিয়া তার নির্বাচনী এলাকা ফেনীতে সমাবেশ করতে গেলে সেখানেও তিনি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়েন। সেখানে বিরোধী দলগুলো হরতালের ডাক দেয় এবং কালো পতাকা প্রদর্শন করে।
পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় ফেনীতে দুটো সমাবেশ বাতিল করতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
রাজনৈতিক সহিংসতা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিভিন্ন জেলায় বিএনপি নেতাদের বাড়ি কিংবা অফিসে হামলা হয়। রাজশাহীর তৎকালীন মেয়র মিজানুর রহমান মিনুর বাড়িতে বোমা হামলা হয়।
খালেদা জিয়া রাজশাহীতে সমাবেশ করতে গেলে সেখানে তার সমাবেশের কাছেই বোমা হামলায় একজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়।
এমনকি প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি বহর লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করা হয় বলে বিভিন্ন সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছিল।
বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের সমাবেশ ও মিছিলেও হামলা চালায় ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা। এছাড়া পুলিশও হামলা চালিয়েছিল নানাভাবে।
বিরোধী দলগুলোর তীব্র আন্দোলনে সরকারের ভেতরে উদ্বেগও বাড়তে থাকে। কিন্তু একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিএনপি সরকার ছিল অবিচল।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের বলেন যে বিরোধী দল যেসব ‘বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য’ সৃষ্টি করছে তাতে তিনি মোটেও বিচলিত নন।
তিনি বলেন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এই নির্বাচন করতে হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের তীব্র আন্দোলনে সড়ক, নৌ এবং রেল যোগাযোগ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য ১৯৯৬ সালের ১৪ ও ১৫ই ফেব্রুয়ারি লাগাতার হরতালের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের পাশপাশি জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি এবং জাসদ (রব) কর্মসূচী ঘোষণা করে।
আওয়ামী লীগের হরতালে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, দিনাজপুর, রংপুর সহ বিভিন্ন জায়গায় জীবনযাত্রা প্রায় অচল হয়ে যায়।
সে কর্মসূচীকে দৈনিক ইত্তেফাক বর্ণনা করেছিল এভাবে, ” নজিরবিহীন এই হরতালে শহরগুলিকে অনেকটা মৃতপুরীর মত হইয়াছিল। সন্ত্রাস, বোমাবাজি, অগ্নিসংযোগ ও ব্যালট পেপার এবং বাক্স ছিনতাইয়ের মধ্য দিয়া হরতালের প্রথম দিন অতিবাহিত হয়। রাজধানীর সচিবালয়ে উপস্থিতির হার শতকরা ৩/৪ শতাংশে নামিয়া আসে। সমগ্র শহরে ৫০০শ রিক্সাও চলে নাই।”
এমন অবস্থায় ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্র্রুয়ারি ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের দিন বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় অন্তত ১০ জনের নিহত হবার খবর প্রকাশিত হয় সংবাদপত্রে।
একতরফা সেই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই নগন্য। নির্বাচনে পর তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি একেএম সাদেক সাংবাদিকদের বলেন, কত শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে সেটি বড় কথা নয়। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেটাই আসল কথা।
৩০০ আসনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২৫০টি আসনে। ৪৬টি আসনে একাধিক প্রার্থি না থাকায় বিএনপির প্রার্থিরা ভোটের আগেই নির্বাচিত হয়ে যান।
আন্দোলন আরো জোরদার
১৫ই ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচনের পর তৎকালীন বিরোধী দলীয় শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহবান জানান, তারা যাতে সেই সরকারকে স্বীকৃতি না দেয়।
সে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে ‘অবৈধ সরকার’ হিসেবে বর্ণনা করেন শেখ হাসিনা।
একই সাথে আওয়ামী লীগের রাস্তার কর্মসূচীও চলমান থাকে। আওয়ামী লীগ টানা ১০৮ ঘণ্টার অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়।
সবচেয়ে বড় সহিংসতা হয় বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, দোকানপাটে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেনাবাহিনীর একটি জিপ গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। একই সাথে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর অফিসেও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
বিরোধী দলের আন্দোলন থামাতে তাদের কিছু সিনিয়র নেতাকেও গ্রেফতার করা হয়।
কূটনীতিকদের দেনদরবার
বাইশ মাসের রাজনৈতিক অচলাবস্থার পরেও সরকার এবং বিরোধী দল কোন ফলপ্রসূ আলোচনা করতে পারেনি।
১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড এন মেরিল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে রাজনৈতিক মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাতে রাজনৈতিক বিবাদের কোন মীমাংসা হয়নি।
বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে তখন পর্দার আড়ালে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনাও চলছে মাঝেমধ্যে।
পর্দার আড়ালে দুপক্ষের মধ্যে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
দুপক্ষের মধ্যে সমঝোতা হলে নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দেবার আলোচনাও উঠে।
এমন অবস্থায় নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে এবং ৭ই ফেব্রুয়ারি ভোট গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়।
জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে আওয়ামী লীগের তিন নেতা – আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ এবং মোহাম্মদ নাসিম – রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের সাথে দেখা করেন।
রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য তারা প্রেসিডেন্টকে আহবান জানান।
প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করে আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থাকার কারণে সংকটের সমাধান হচ্ছে না।
সমঝোতার আশা শেষ
একপেশে নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছিল, সমঝোতার আশা ততই শেষ হয়ে যাচ্ছিল।
যদিও তখন অনেকে ধারণা করেছিলেন যে নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দেয়া হবে।
কিন্তু আওয়ামী লীগ পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি ফয়সালা না হলে নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দিয়ে লাভ হবে না। এমন অবস্থায় সংকট সমাধানের জন্য জোরালো চেষ্টা করছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড এন মেরিল।
তিনি বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
আওয়ামী লীগের দাবি ছিল খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ একটি উপদেষ্টা পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে এবং সেই উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান উপদেষ্টার হাতে নির্বাহী ক্ষমতা থাকবে।
অন্যদিকে বিএনপি রাষ্ট্রপতির অধীনে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে প্রেসিডেন্টের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা দেবার প্রস্তাব দিয়েছিল। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে আরা বলা হয়,নির্বাচনের আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পদত্যাগের প্রস্তাব দিয়েছেন।
তবে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির উপর রাখার প্রস্তাব করেন তিনি। তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন আব্দুর রহমান বিশ্বাস, যিনি বিএনপির মনোনীত রাষ্ট্রপতি ছিলেন।
নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছিল, কূটনীতিক এবং নাগরিকরা সমঝোতা আশা ততই ছেড়ে দিয়েছেন।
একতরফা নির্বাচনের আগে দুই দলের মধ্যে সমঝোতার জন্য শেষবারের মতো চেষ্টা করেন ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা।
আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ডেভিড এন মেরিল আবারো আলোচনার উদ্যোগ নেন।
মনোনয়নপত্র দাখিলের আগের দিন ছয়টি দেশের রাষ্ট্রদূতরা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সাথে দীর্ঘ বৈঠক করেন।
আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূতরা বৈঠকে অংশ নেন। কিন্তু তারা সমঝোতা করতে ব্যর্থ হন।
এদিকে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নিকোলাস বার্নস এক ব্রিফিং-এ বলেন সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনা সুগম করার জন্য রাষ্ট্রদূত ডেভিড এন মেরিল দুই মাস যাবত কাজ করছেন।
মি. বার্নস বলেন, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র কোন সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে না।
তিনি আরো বলেন, নির্বাচন হওয়া উচিত, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমুন্নত করা উচিত এবং সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সহযোগিতা হওয়া উচিত।
দ্রুত আরেকটি নির্বাচনের ইঙ্গিত
একদিকে সমঝোতার চেষ্টা যেমন চলছে, অন্যদিকে নির্বাচন করার জন্য বিএনপি সরকারের অগ্রসর হওয়া এবং রাস্তায় আওয়ামী লীগের জোরালো আন্দোলন।
এমন অবস্থায় ২৪শে জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জাতির উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেন।
সে ভাষণে তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচনের মাধ্যমে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হবে যাতে ভবিষ্যৎ নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
খালেদা জিয়ার সে ভাষণে বোঝা যায়, নির্বাচনের পরে দ্রুত আরো একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং হয়তো বিরোধী দলের দাবি মেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারও প্রতিষ্ঠা করা হবে।
খালেদা জিয়া বলেন, ২১শে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশে সাংবিধানিকভাবে কোন নির্বাচিত সরকার থাকবে না।
সেজন্য এই নির্বাচনটিকে তিনি ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত’ রাখার নির্বাচন হিসেবে বর্ণনা করেন।
নির্বাচনের জন্য তখন সেনাবাহিনীও মোতায়েন করা হয়েছিল।
অস্ত্র উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনী দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান শুরু করে এবং রাস্তায় টহল দেয়। কিন্তু সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেবার দাবি তোলে বিরোধী দলগুলো।
নির্বাচনের প্রতি পশ্চিমা দেশ এবং দাতা সংস্থাগুলো যাতে সমর্থন না দেয় সেজন্য আহবান জানান শেখ হাসিনা।
নির্বাচন ঠেকানোর জন্য ১৪ এবং ১৫ই ফেব্রুয়ারি হরতালের ডাক দেয় বিরোধী দলগুলো।
নির্বাচন সফল করার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশ করেছেন।
ফেনীতে এক জনসভা শেষে খালেদা জিয়া বলেন, বিরোধী দলের আন্দোলনে তিনি বিচলিত নন।
খালেদা জিয়া বলেন, নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নিলে তিনি আনন্দিত হতেন। তারা অংশ নিলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হত।
কূটনীতিকদের আবারো চাপ ও চেষ্টা
বিরোধী দলের তুমুল হরতাল এবং সহিংস প্রতিবাদের মধ্যেই ১৫ই ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। খালেদা জিয়া আবারো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
নির্বাচনের কিছু দিনের মধ্যেই মার্কিন কংগ্রেস সদস্য বিল রিচার্ডসন দুই দিনের এক সফরে ঢাকায় আসেন।
বিমানবন্দরে নেমেই তিনি সাংবাদিকদের জানান যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তার কিছু অভিমত আছে এবং সেসব অভিমত তিনি সরকার ও বিরোধী দলকে জানাবেন।
বিল রিচার্ডসন ঢাকায় আসার আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর এবং ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড এন মেরিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাকে অবহিত করেন।
মি. রিচার্ডসন বলেন, তিনি ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন।
ঢাকায় এসে মি. রিচার্ডসন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করেন। তৎকালীন বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্টে জানা যায়, রাজনৈতিক সংকট দ্রুত সমাধানের জন্য মি. রিচার্ডসন উভয়পক্ষকে তাগাদা দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ছেড়ে যাবার আগে বিমানবন্দরে তিনি বলেন, কোন রকম শর্ত ছাড়াই অবিলম্বে দুই দলের মধ্যে সংলাপ শুরু করা প্রয়োজন।
মি. রিচার্ডসন ঢাকা ছেড়ে যাবার কয়েকদিন পরে ছয়টি দেশের রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনাররা আবারো বৈঠক করেন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাথে।
দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এসএএমএস কিবরিয়ার ধানমন্ডির বাসভবনে প্রায় তিনঘণ্টা ধরে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে রাষ্ট্রদূতরা বলেন যে পরিস্থিতি অবনতির দিকে।
সমঝোতার কাছাকাছি আসা
কূটনীতিকদের সমঝোতা চেষ্টা এবং তীব্র চাপের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালের ৩রা মার্চ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে বলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য সংসদে বিল আনা হবে।
তিনি বিরোধী দলকে আলোচনার জন্য আহবান জানান।
এর দুইদিন পরে বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে আলোচনায় বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
কিন্তু একদিন পরে বিরোধী দলীয় শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেন। এসব দাবির মধ্যে রয়েছে . ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাতিল . ১১ই মার্চের মধ্যে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বৈঠক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন . মে মাসের মধ্যে ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন প্রেসিডেন্ট কর্তৃক আলোচনার উদ্যোগ নেবার জন্য বিরোধী দল যে দাবি তুলে ধরেছে সেটি একদিন পরেই মেনে নেয় বিএনপি।
১০ই মার্চ বিরোধী দলগুলো আলাদাভাবে রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের সাথে আলোচনায় বসে। এরপর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপিও রাষ্ট্রপতির সাথে আলোচনায় বসে।
সে বৈঠকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন এবং মে মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে রাজি হয় বিএনপি।
তবে ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এবং সংসদ বাতিল করার জন্য বিরোধী দল যে দাবি তুলে ধরেছিল সেটি মানেনি বিএনপি। এছাড়া খালেদা জিয়া পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানান। বিএনপির তরফ থেকে বলা হয়, ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস হওয়া উচিত।
অন্যদিকে ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এবং ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ বাতিল করার জন্য বিরোধী দলগুলো তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখে। চলতে থাকে অসহযোগ আন্দোলন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু
১৯৯৬ সালের ১৯ শে মার্চ বাংলাদেশে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের প্রথম যে অধিবেশন শুরু হয়, তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা। অধিবেশনের চতুর্থ কার্যদিবস অর্থাৎ ২৪শে মার্চ রাতে জাতীয় সংসদে সংবিধানে যুক্ত করার জন্য বাছাই কমিটির রিপোর্টসহ বিলটি উত্থাপন করা হয়। ২৬ শে মার্চ ভোররাতে বহুল আলোচিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল সংসদে পাশ হয়।
তখনও বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন চলতে থাকে। এরসাথে যুক্ত হয় সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
তাদেরও একটি অংশ আওয়ামী লীগের গঠিত ‘জনতার মঞ্চে’ গিয়ে সংহতি প্রকাশ করে।
রাজনীতির মাঠে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য বিএনপি তাদের অফিসের সামনে গঠন করে ‘গণতন্ত্রের মঞ্চ’।
খালেদা জিয়ার পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে দেরি হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগ।
কারণ, বিরোধী দলগুলোর সন্দেহ ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাশ করলেও বিএনপি হয়তো সহজে ক্ষমতা ছাড়বে না।
সেজন্য বিরোধী দলগুলো তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করেনি।
এক পর্যায়ে ১৯৯৬ সালের ৩০ শে মার্চ খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন এবং ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টার শপথ গ্রহণ করেন সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।
সে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে ৭ম জাতীয় সংসদের নির্বাচন আয়োজন করে যার মাধ্যমে ২১ বছর পরে ক্ষমতায় ফিরে আসে আওয়ামী লীগ।