এ কে এম জাকারিয়া : নির্বাচন প্রশ্নে দুই দলের অনড় অবস্থানের কারণে রাজনীতি যে সংঘাত পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, সেই আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল। কিন্তু ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের দিনই তা শুরু হবে, এমনটা সম্ভবত অনেকেই মনে করেননি। ধারণা ছিল যে বিএনপির মহাসমাবেশটি শান্তিপূর্ণভাবে হবে এবং সেখান থেকে হয়তো কঠোর কর্মসূচি আসবে। সেই বিবেচনায় বলা যায়, সংঘাত-সহিংসতার যে ভয় ছিল, তা একটু আগে শুরু হয়ে গেছে, তবে তা মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না।
বিএনপির মহাসমাবেশের দিন সংঘাতের সূচনা কীভাবে হলো, কারা করল, কেন করল—এ নিয়ে ঘটনার দিন থেকেই আমরা নানা ভাষ্য শুনেছি এবং এখনো শুনে যাচ্ছি। সময়টা এত পিচ্ছিল ও ঘটনাগুলো এত জটিল কায়দায় ঘটছে যে এসব নিয়ে তাৎক্ষণিক বা সরল সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকের কাছেই বিষয়গুলো নিজের মতো করে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। ২৮ অক্টোবর ঘটনার দিন সহিংসতা নিয়ে কোনো একজন যে ধারণা পোষণ করতেন, আজ সপ্তাহখানেকের মাথায় এসে তিনি সেখানে না-ও থাকতে পারেন।
নির্বাচন নিয়ে সরকার এখন কোন পথে এগোতে চায়, তার কিছুটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছে ২৮ অক্টোবর ও এরপর সরকারের কঠোর অবস্থান ও নানা কর্মকাণ্ডে। সরকার সম্ভবত সবকিছু উপেক্ষা করার নীতি নিয়েছে। সংঘাত-সহিংসতার ঝুঁকি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক চাপ—সবকিছুই। প্রায় সবাই বলছেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন এবার হবে না। ইতিহাসেরও নাকি কখনো হুবহু পুনরাবৃত্তি হয় না। তাহলে সরকার যে নির্বাচন করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তা কেমন হবে? গত দুটি নির্বাচনের মিশ্র কিছু? নাকি একেবারেই নতুন কোনো চমক।
বিএনপি কোন পথে হাঁটবে বা তাদের আন্দোলন কোন পথে চলবে, তা বোঝা অবশ্য বেশ দুষ্কর হয়ে পড়েছে। দলটির মহাসচিবসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতা আটক হয়েছেন। বাকিরা গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বোঝা যায়, সামনে আরও অনেকেই আটক হবেন। দলটি কার্যত তখন নেতাবিহীন হয়ে পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে কী করবে বিএনপি? কী হবে তাদের কৌশল?
২৮ অক্টোবর থেকে রাজনীতিতে যে সহিংসতা শুরু হয়েছে, তা অব্যাহত আছে। এর মধ্যে বিএনপি এক দিনের হরতাল ও তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। দলটির অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে আনুষ্ঠানিক কোনো সংবাদ সম্মেলন করার অবস্থায়ও নেই। দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলন করে নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দিতে হয়েছে। বিএনপির আন্দোলনের কৌশল আদৌ কার্যকর কিছু হবে কি না, তা বোঝার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
২.
দেশের রাজনীতিকে আমরা দেশে রাখতে পারিনি। দেশের বাইরের কিছু ফ্রন্টেও আমাদের নির্বাচন নিয়ে নানা-হিসাব নিকাশ ও তৎপরতা চলছে। এগুলো গোপন কোনো বিষয় নয়। বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে একটি জোরালো অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এরই মধ্যে এমন কিছু পদক্ষেপ তারা নিয়েছে, যা সরকারের জন্য কোনোভাবেই সুখকর নয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে, সরকার এখন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে উপেক্ষা করার নীতিই নিয়েছে। অন্যদিক যুক্তরাষ্ট্রও তার অবস্থান থেকে সরে এসেছে বলে মনে হয় না। এর ফলাফল শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কিছু দেশ আছে, যারা যুক্তরাষ্ট্রকে সব সময় অনুসরণ করে চলে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে সাতটি দেশ বিবৃতি দিয়েছে, সেখানে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার যুক্ততা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ (বাকি দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে)। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই একে এক নতুন বার্তা হিসেবে বিবেচনা করছেন। বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের প্রতি সামনে এই দেশগুলোর সম্মিলিত সমর্থন থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন প্রশ্নে ভারতের অবস্থানের সঙ্গে যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান মিলবে না, তার আভাস বেশ আগে থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। তবে গত দুটি নির্বাচনের মতো ভারতের তৎপরতা এবার এখনো তেমন প্রকাশ্য হয়ে ওঠেনি। আড়ালে-আবডালে কী ঘটছে, তা আমাদের পক্ষে বোঝা কঠিন।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ধারণা, সামনের নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপি হলে বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র এবং এতে চীন ও ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা আরও বেড়ে যাবে। ক্রাইসিস গ্রুপের এই পর্যবেক্ষণকে বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, সত্যিই যদি তেমন কিছু ঘটে, তবে চীন ও ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতাকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখা কঠিন হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও বৈশ্বিক পশ্চিমকে উপেক্ষা করে যদি একটি নির্বাচন হয়, তবে সেই চাপ সামাল দিতে সরকারে যে মাত্রার সমর্থন দরকার পড়বে, তা চীনের মতো একটি পরাশক্তির পক্ষেই হয়তো নিশ্চিত করা সম্ভব। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ যদি চীনর দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে, তবে তা হবে ভারতের জন্য চরম অস্বস্তিকর। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ভারতের হিসাব-নিকাশটি তাই আগের তুলনায় এবার অনেক বেশি জটিল।
৩.
দেশে ও দেশের বাইরে—দুই ফ্রন্টেই বাংলাদেশের রাজনীতি এক অনিশ্চিত জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। আগামীকাল রোববার সারা দেশে আবার শুরু হচ্ছে বিরোধী দলগুলোর ৪৮ ঘণ্টার সড়ক রেল ও নৌপথ অবরোধ। নতুন করে সংঘাত ও সহিংসতার আশঙ্কার মধ্যে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করাই যেন এখন আমাদের নিয়তি।
- এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক